ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে মৎস্যসম্পদ

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ২৯ জুলাই ২০১৮

হুমকির মুখে মৎস্যসম্পদ

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ একের পর এক অভিযান হচ্ছে। জব্দ হচ্ছে লাখ লাখ বাগদা-গলদা চিংড়ির রেণু পোনা। আটক হচ্ছে পোনা পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরা। শাস্তিও হচ্ছে তাদের। কিন্তু এরপরেও পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকার সাগর ও নদীতে রেণু পোনা ধরা কিছুতেই থামছে না। উপরন্তু তা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। প্রতিদিন কোটি কোটি রেণু পোনা ধরা হচ্ছে। আর এতে করে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে মৎস্যসম্পদ। প্রতিটি রেণু পোনা ধরতে গিয়ে আহরণকারীরা অসংখ্য মাছের পোনা মেরে ফেলছে। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীর দক্ষিণের চার উপজেলা গলাচিপা, দশমিনা, কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী ছাড়াও ভোলা ও বরগুনা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ চিংড়ি মাছের রেণু পোনা ধরার কাজ করছে। চিংড়ি ঘেরগুলোতে চাষের জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদী এবং সাগরের প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত গলদা এবং বাগদা মাছের রেণু পোনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ সুযোগে এলাকায় গড়ে উঠেছে গ-ায় গ-ায় সিন্ডিকেট। চরাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেটের লোকজন আগাম দাদন দিয়ে তাদের সূক্ষ্ম ফাঁসের মশারির জাল নিয়ে সাগর-নদীতে নামিয়ে দিচ্ছে। এজন্য গ্রামে গ্রামে খোলা হয়েছে অসংখ্য আড়ত। যে গুলোতে দিনরাত অবাধে রেণু কেনাবেচা চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি চিংড়ি রেণু ধরার জন্য লোকজন ষাট পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা পাচ্ছে। অথচ চিংড়িঘেরগুলোতে তা চার-পাঁচ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ব্যাপক লাভের কারণে সিন্ডিকেট সদস্যরা এ খাতে আগাম কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। সূত্র জানায়, কেবলমাত্র গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলাতেই প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০ লাখ রেণু পোনা ধরা পড়ছে। ভোলা ও বরগুনা জেলায় ধরা হচ্ছে এর আরও কয়েক গুণ বেশি। মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতির বিষয়টি আমলে নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার প্রাকৃতিক উৎস থেকে সব ধরনের রেণু পোনা ধরা নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এরপরেও তা থেমে নেই। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই চলছে রেণু পোনা কেনাবেচার কারবার। এজন্য বুড়াগৌরাঙ্গ নদকে রেণু পোনা কেনাবেচার নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুড়াগৌরাঙ্গ নদের সঙ্গে দশমিনা, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী ছাড়াও ভোলার বিশেষ করে চরফ্যাশন ও লালমোহন উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। প্রতিদিন রাত গভীর হলেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলার ভর্তি পোনা নিয়ে একের পর এক ট্রলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পাড়ি দিয়ে বদনাতলী ঘাটে নোঙর করে। পরে সেখান থেকে ট্রাক ভর্তি করে পোনা পাচার করা হয় ঘেরগুলোতে। গত ৭ মে রাতে পুলিশের সহায়তায় উপজেলা প্রশাসন কেবলমাত্র একটি ট্রাকে অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ ৬০ হাজার পোনা জব্দ করে। ওই ট্রাক থেকে আটক করা হয় ১০ জন পাচারকারীকে। এর মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে গত ২৭ মে রাতে র‌্যাব-৮ এর একটি টিম বদনাতলী ঘাটে তিনটি ট্রলার থেকে ১০ লাখ ও গলাচিপা শহরের একটি আড়ত থেকে ২ লাখ পোনা জব্দ করে। র‌্যাব সদস্যরা ৬ জন পাচারকারীকেও আটক করে। গত ৩১ মে রাতে কোস্টগার্ড পটুয়াখালী স্টেশনের সদস্যরা জেলা শহরের চৌরাস্তায় অভিযান চালিয়ে একটি ট্রাক থেকে দেড় লাখ এবং একই রাতে দুমকি উপজেলা পাগলাবাজার মহাসড়কে অপর এক অভিযানে অপর একটি ট্রাক থেকে ৭ লাখ ৩৫ হাজার পোনা জব্দ করে। কোস্টগার্ড দুই অভিযানের সময়ে ৫ জন পরিবহন শ্রমিককে আটক করে। বরগুনার আমতলী উপজেলা প্রশাসন গত ৬ জুন গলাচিপা-পটুয়াখালীর সংযোগস্থল শাঁখাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে অভিযান চালিয়ে একটি ট্রাক থেকে ২০ লাখ রেণু পোনা জব্দ ও দুইজনকে আটক করে। গত ১৫ জুলাই উপজেলা প্রশাসন গলাচিপা শহরের ফেরিঘাটে অভিযান চালিয়ে সাড়ে তিন লাখ পোনা জব্দ ও তিনজনকে আটক করে। জব্দ সমস্ত রেণু পোনা বিভিন্ন নদীতে অবমুক্ত করা হয়। আটককৃতদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের আদেশ দেয়। এছাড়াও পটুয়াখালী জেলায় গত দু’মাসে আরও কয়েক লাখ পোনা জব্দ হয়েছে। এভাবে একের পর এক অভিযানে রেণু পোনা জব্দ ও পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আটক হলেও মাঠ পর্যায়ে এর তেমন প্রভাব পড়ছে না। কিছুতেই থামছে না রেণু পোনা ধরা। দিন দুপুরে প্রকাশ্যেই চলছে পোনা আহরণ ও কেনাবেচা। প্রতিদিন কোটি কোটি চিংড়ির রেণু পোনা ধরার কারণে উপকূলের মৎস্যসম্পদ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়ছে। পোনা আহরণকারীরা মশারির কাপড় দিয়ে প্রধানত রেণু পোনা ধরছে। এ সময় রেণু পোনার সঙ্গে অন্যান্য মাছের পোনাও উঠে আসছে। পোনা শিকারিরা অন্যান্য মাছের পোনা শুকনো জায়গায় ফেলে দিয়ে কেবলমাত্র চিংড়ির রেণু রেখে দিচ্ছে। এতে অন্যান্য মাছের রেণু পোনা মারা যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতের মৎস্যসম্পদ ধংস হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিসের গবেষণা সহকারী ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, একটি রেণু পোনা ধরতে গিয়ে আহরণকারীরা ৮০ থেকে ১০০টি অন্যান্য মাছের পোনা ধ্বংস করছে। এছাড়া, মাছের খাদ্যকণা জু প্লাঙ্কটন ও ফাইটো প্লাঙ্কটনসহ জলজ সম্পদের পাশাপাশি পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি করছে। অবিলম্বে চিংড়ির রেণু পোনা ধরা বন্ধ করা না গেলে তা ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। চিংড়ির রেণু পোনা ধরা প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ মশিউর রহমান জানান, নদী কিংবা সাগর থেকে বাগদা ও গলদা রেণু পোনা ধরা, পরিবহন ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর গলাচিপা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মোজাম্মেল হক জানান নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও অবাধে পোনা ধরা এবং পাচার বন্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
×