ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার কারণে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২৯ জুলাই ২০১৮

নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার কারণে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বাড়ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পুঁজিবাজারে এলেও পাঁচটি বহুজাতিক কোম্পানি নামমাত্র পরিশোধিত মূলধন দিয়ে ব্যবসা করছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোকে পেছনে ফেলে উল্লেখযোগ্য হারে মুনাফা করছে ওই কোম্পানিগুলো। তা সত্ত্বেও দফায় দফায় তাগিদ দেয়ার পরও কোম্পানিগুলো পরিশোধিত মূলধন বাড়াচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এবং উৎপাদন ও আয়-মুনাফা বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। এতে কোম্পানিগুলো লাভবান হলেও এদেশের বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে, পাঁচ বছরে প্রতি বছর গড়ে ৯০ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করা চামড়া খাতের কোম্পানি বাটা সু বাংলাদেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। কোম্পানিটির মুনাফাও কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে গড়ে ৩১৩ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। দেশীয় কোম্পানিকে পেছনে ফেলে আয়-মুনাফায় এগিয়ে থাকা ওই বহুজাতিক কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। শেয়ারের ৭০ শতাংশই কোম্পানিটির বিদেশী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের আছে। তাই নগদ লভ্যাংশের বড় অংশই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এদিকে, ওষুধ ও রসায়ন খাতের বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল ও ভিটসহ স্বনাম খ্যাত কয়েকটি প্রসাধন পণ্যের কল্যাণে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটির আয়-মুনাফা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেইসঙ্গে এ সময়ে গড়ে ৬৩৩ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে রেকিট বেনকিজার। তবে কোম্পানিটির প্রায় ৮৩ শতাংশ শেয়ার বিদেশীদের হাতে, তাই লভ্যাংশের অংশ হিসেবে প্রায় ১২০ কোটি টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ সমাপ্ত আর্থিক বছর শেষে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা প্রায় ৩৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আয়-মুনাফায় এগিয়ে থাকা কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র চার কোটি টাকা, যা এদেশের পুঁজিবাজারের একই খাতের স্বল্পমূলধনী কোম্পানি কোহিনূর কেমিক্যাল, ওয়াটা কেমিক্যাল ও জেএমআই সিরিঞ্জের চেয়েও কম। তবে সহসাই ‘পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা কোম্পানিটির নেই’ বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেকিট বেনকিজারের শেয়ার বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। শুধু রেকিট বেনকিজার ও বাটা সু নয়। বহুজাতিক কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন, লিন্ডে বাংলাদেশ ও ম্যারিকো বাংলাদেশও একইপথে হাঁটছে। সর্বশেষ সমাপ্ত আর্থিক বছরেও প্রায় পৌনে ৭০০ কোটি টাকা আয় ও প্রায় ৬৭ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করা গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১২ কোটি চার লাখ টাকা। গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের তুলনায় একই খাতের বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন কয়েকগুণ বেশি। তবে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘদিনের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে’ বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। ‘ব্যবসা পরিস্থিতি বিবেচনা করে’ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাণিজ্যিক ঝুঁকিতে থাকা তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল বিজনেস ইউনিটের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধের প্রস্তাব করেছে। তবে জিএসকে বাংলাদেশ তাদের কনজিউমার হেলথকেয়ার ব্যবসা চালিয়ে যাবে এবং ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা বন্ধের কোন প্রভাব তাতে পড়বে না। একইভাবে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি লিন্ডে বাংলাদেশের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। অথচ একই খাতের অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় এ পরিমাণ খুবই কম। এছাড়া লিন্ডে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশী উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ওষুধ ও রসায়ন খাতের অপর বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশও পরিশোধিত মূলধনের দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে মূলধনে পিছিয়ে থেকেও ওই পাঁচ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছে বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ম্যারিকোর বিপরীতে একই খাতের অন্যান্য কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন অনেক বেশি। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বড় অঙ্কের মুনাফা করছে। সিংহভাগ শেয়ার হাতে রেখে তারা লভ্যাংশের বড় অংশ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে মুনাফার সুফল এদেশের বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছে না। আর সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পরও পরিশোধিত মূলধন না বাড়ানো রহস্যজনক। তাই কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বা পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন বাড়লে শেয়ার সংখ্যা বাড়বে। কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। তাই কোম্পানিগুলোকে সরকারের তরফ থেকে দিকনির্দেশনা দেয়া জরুরী। উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা ১১টিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, গ্রামীণফোন, বার্জার পেইন্ট, সিঙ্গার বাংলাদেশ, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট ও লাফার্জ-হোলসিমের মতো কোম্পানিগুলো এদেশে বড় বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাকি পাঁচটি কোম্পানি নামমাত্র বিনিয়োগ করেই ফি-বছর বড় মুনাফা করছে। নিজ নিজ খাতে শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না।
×