ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

স্বপ্ন জয়ের পথে দেশের বিদ্যুত খাত

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৯ জুলাই ২০১৮

স্বপ্ন জয়ের পথে দেশের বিদ্যুত খাত

১০ বছর আগেও বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি ছিল পর্যুদস্ত। শিল্প-বাণিজ্য ছিল স্থবির এবং জনজীবনে লোডশেডিং ছিল অসহনীয়। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদের সাড়ে চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে নয় বছরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুত খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। লক্ষ্য সবার জন্য বিদ্যুত যৌক্তিক ও সহনীয় মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করা। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশের মোট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট এবং প্রকৃত বিদ্যুত উৎপাদন ছিল ৩২৬৮ মেগাওয়াট। সে সময় নতুন সরকার বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানপূর্বক বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধিসহ এ খাতের সার্বিক ও সুষম উন্নয়নে তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। একই সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল, কয়লা, ডুয়েল ফুয়েল, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও নিউক্লিয়ার এনার্জিভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুত আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের সাড়ে নয় বছরে ২০০৯ সাল থেকে ১৮ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত বিদ্যুত খাতে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হয়েছে। সরকারের ৯ বছরের চেষ্টায় বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে ১১৮টিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। ২০০৯ সালে মোট ১২টি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেগুলোর মোট ক্ষমতা ৩৫৬ মেগাওয়াট। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ৯টি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৭৭৫ মেগাওয়াট। একইভাবে ২০১১ সালে এক হাজার ৭৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২২টি, ২০১২ সালে ৯৫১ মেগাওয়াটের ১১টি, ২০১৩ সালে ৬৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি, ২০১৪ সালে ৬৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার সাতটি, ২০১৫ সালে এক হাজার ৩৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সাতটি, ২০১৬ সালে এক হাজার ১৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি এবং ২০১৭ সালে দেশে ১ হাজার ৮৪০ মেগাওয়াট ১০টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারী খাতে ৬ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি এবং বেসরকারী খাতে ৪ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৮টি বিদ্যুত কেন্দ্রসহ মোট ১১ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো চলতি বছর থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারী খাতে ২ হাজার ৭৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৮টি এবং বেসরকারী খাতে ২ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৬টি বিদ্যুত কেন্দ্রসহ সর্বমোট ৪ হাজার ৯১৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৪টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন সরকারী খাতে ৬ হাজার ৪১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির কার্যক্রম চলমান। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র হতে ২০২৩ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থায় আমূল পরবর্তন ঘটবে। এক নজরে ২০০৯ সাল থেকে ১৮ জুলাই ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে নয় বছরে বিদ্যুত খাতের উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৩১০০ মেগাওয়াট থেকে ১৭২০০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ৩২৬৮ মেগাওয়াট হতে ১১৩৮৭ মেগাওয়াটে উন্নীত করা, বিদ্যুত সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭% থেকে ৯০% উন্নীত করা; মাথাপিছু বিদ্যুত উৎপাদন ২২০ কিলোওয়াট আওয়ার হতে ৪৬৪ কিলোওয়াট আওয়ারে উন্নীত করা; ৯৬ লাখ নতুন গ্রাহক সংযোগের মাধ্যমে প্রায় ৩ কোটি গ্রাহককে বিদ্যুত সুবিধা প্রদান; প্রায় ২০০০ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ মোট সঞ্চালন লাইন (সা.কি.মি.): ১১,১২২ সর্বমোট বিতরণ লাইন ৪ লাখ ৫৫ হাজার, এবং জুন ২০১৭ সাল পর্যন্ত সিস্টেম লস দাঁড়িয়েছে ১২.১৯% বিতরণ লস: ৯.৯৮%। ২০০৯ সালে গ্রিড সাবস্টেশনের ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ। এখন যার পরিমাণ ৩০ হাজার ৯৯৩ এমভিএ। আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে ৬৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন ও ভেড়ামারা বিদ্যুত উপকেন্দ্র নির্মাণপূর্বক ৫ অক্টোবর ২০১৩ তারিখ হতে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি করা হচ্ছে। ২৩ মার্চ ২০১৬ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মি. নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত দ্বিতীয় গ্রিড আন্তঃসংযোগ উদ্বোধনের মাধ্যমে ত্রিপুরা হতে কুমিল্লা উপকেন্দ্রে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি শুরু হয়েছে। ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির কার্যক্রম চলমান আছে। এছাড়া ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও জাপানের সহযোগিতায় কয়লাভিত্তিক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুত খাতে স্বচ্ছতা আনয়ন ও জবাবদিহিতা আনয়নের লক্ষ্যে ভার্টিক্যাল সেপারেশনের মাধ্যমে সঞ্চালন খাতকে উৎপাদন ও বিতরণ খাত থেকে পৃথকীকরণের জন্য কোম্পানি আইনের আওতায় ১৯৯৬ সালে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন করা হয়। পিজিসিবি সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন ও দক্ষ বিদ্যুত সঞ্চালন সিস্টেম নেটওয়ার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সঞ্চালন গ্রিড নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিদ্যুতের গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি, দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নি¤œলিখিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়: অন-লাইনের মাধ্যমে নিয়োগ ব্যবস্থাপনা চালু, সেচ কাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিতকরণ; কেপিআই ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ বিদ্যুত খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাকরণ; ই-টেন্ডারিং, ই-ফাইলিং ও সমন্বয় সভার জন্য অনলাইনভিত্তিক সফটওয়্যার চালুর মাধ্যমে বিদ্যুত খাতে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রবর্তন; অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি; মোবাইল ফোন ও অন-লাইনের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ; পিএমআইএস সফটওয়্যার পদ্ধতি চালুকরণ, অডিট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার বাস্তবায়ন, অন-লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত সংযোগের জন্য আবেদন ব্যবস্থাপনা, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুত সেবা প্রদান, প্রি-পেইড মিটারিং পদ্ধতি চালু ও অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নে বিদ্যুত বিভাগের প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি কার্যক্রম বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আর বিদ্যুত খাতের বড় যে প্রকল্পগুলো এখন বাস্তবায়নের পথে তা শেষ করে বিদ্যুত উৎপাদনে যেতেও সময় লাগবে। এই সময়ে দেশের সম্পদ কাজে লাগিয়ে তুলনামূলক কম অর্থ বিনিয়োগ করে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে এরই মধ্যে নবায়নযোগ্য খাত থেকে ৪০৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। আর সরকার চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ জন্য রোডম্যাপও প্রণয়ন করেছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিই আমাদের ভবিষ্যত। কারণ এই খাতে বিদ্যুত উৎপাদন ব্যয় অন্য যে কোন পদ্ধতির চেয়ে কম। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ঘিরে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার ও এর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি কার্যকর করা হয়। নীতিমালায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল উৎস হিসেবে সৌর শক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস, হাইড্রো, বায়ো ফুয়েল, জিও থার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে শনাক্ত করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ২০২০ সাল এবং তার পরবর্তী বছরগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি হতে ১০% বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি হতে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৩১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে যার মধ্যে পাবলিক সেক্টর ১১০০ মেগাওয়াট এবং বাকি অংশ বেসরকারী উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা শক্তির মূল পার্থক্য হলো শক্তির উৎসটির নবায়নযোগ্যতা, তথা যে উৎসটি ব্যবহার করা হবে সেটি যাতে সহজে নিঃশেষ না হয়ে যায়। জ্বীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায়। অপরদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুত ইত্যাদি ব্যবহারের সঙ্গে সাথে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায় না। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষম নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস কর্ণফুলী জলবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয় বিংশ শতকের ষাটের দশকে। যা পূর্ণ কর্মক্ষমতা অর্জন করে বিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে। বিংশ শতকের শেষের দিক থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যান্য উৎস যেমন সৌরশক্তি বাংলাদেশে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বেসরকারী উদ্যোগে ১৯৯৬ সাল থেকে গ্রামীণ শক্তি নামে একটি প্রতিষ্ঠান নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা দিতে কাজ শুরু করে। তবে সৌরশক্তির অধিকাংশ ব্যবহারই শুরু হয় ব্যক্তি পর্যায়ে, যা জাতীয় গ্রিডের বাইরে। ১৯৬২ সালে কর্ণফুলী জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে পাঁচটি ইউনিটে ২৩০ মেগাওয়াটে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর স্থাপন করা হয়। পানির প্রবাহ ছাড়া আর কোন জ্বালানি না লাগায় কাপ্তাই কর্ণফুলী পানি বিদ্যুত কেন্দ্রটি বাংলাদেশের একমাত্র বিদ্যুত কেন্দ্র যেখানে বিদ্যুত উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ২৫ পয়সারও কম। কর্ণফুলী জলবিদ্যুত কেন্দ্রটিকে ২০১৫ সালের জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যুত কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা ছিল সর্বোচ্চ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত উৎপাদনের স্বীকৃতি। বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে। মুহুরী প্রজেক্ট হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। মুহুরী প্রজেক্ট বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুত উৎপাদনের একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু হয়েছিল। বিদ্যুত কেন্দ্রে অবস্থিত ৪টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াাট (০.৯) বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে, ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় চালু হয় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ২য় বায়ুচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রটি। ২০ কিলোওয়াাট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া ৪০৪.৪৬ মেগাওয়াটের বেশি সৌর বিদ্যুতের মধ্যে ২০১.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতই জাতীয় গ্রিডের বাইরে। এর মধ্যে রয়েছে ৬০ লাখের বেশি সোলার হোম সিস্টেম যার পরিমাণ প্রায় ১৯৮.৮৪ মেগাওয়াট। আরও রয়েছে প্রায় ৫০০টি সোলার পাম্প যাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৬.৪৩ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ১৫৫০টি সোলার ইরিগ্রেশন পাম্প স্থাপন করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিঃ। এছাড়া ও সারা দেশের সরকারী অফিস বাণিজ্যিক ভবন, শপিংমলসমূহে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অসংখ্য সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে। বায়োগ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র, হাইড্রো ভিত্তিতে ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে ৫-৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার বাড়িতে নতুন করে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কক্সবাজার, কুতুবদিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। ইতিবাচক বিষয় এই যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে এটি দ্রুত ও সফলতম নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নবায়ন যোগ্য জ্বালানি খাতে মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কোস্টারিকা ২০১৭ সালের প্রায় পুরোটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে পার করেছে। তেল-গ্যাস-কয়লার মতো পরিবেশবিধ্বংসী জ্বালানি ছাড়াও যে বিদ্যুত চাহিদা মেটানো সম্ভব, তা ভালমতোই প্রমাণ করেছে মধ্য আমেরিকার এই দেশটি। কোস্টারিকার মোট চাহিদার ৯৯ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যম থেকে। এছাড়া বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ্যাপল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও ভারতসহ বিশ্বের ৪৩ দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সবুজ হওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা করেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এ্যাপল ঘোষণা দিয়েছে তাদের সব স্টোর, ডাটা সেন্টার এবং করপোরেট অফিস এখন শতভাগ নির্মল জ্বালানিতে চলছে। এ্যাপল বিভিন্ন ধরনের নির্মল জ্বালানি ব্যবহার করছে। এর মধ্যে রয়েছে সৌরবিদ্যুত, বায়ু বিদ্যুত, বায়োগ্যাস ফুয়েল সেলস এবং বিদ্যুত তৈরিতে মাইক্রো-হাইড্রো জেনারেশন ব্যবস্থা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নবিষয়ক সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্যানুযায়ী সরকার দেশের সব মানুষকে বিদ্যুত সুবিধা দিতে বদ্ধপরিকর। সরকার ২০২১ সাল পর্যন্ত নতুন যে সকল বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আনার পরিকল্পনা করেছে। সে অনুযায়ী এ বছর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে চার হাজার ৬৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত। একইভাবে ২০১৯ সালে চার হাজার ৮৩৩, ২০২০ সালে চার হাজার ৭২ এবং ২০২১ সালে তিন হাজার ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। এ চার বছরে যুক্ত হওয়া বিদ্যুতের মধ্যে সরকারী খাত থেকে আসবে আট হাজার ২৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত এবং বেসরকারী খাত থেকে সাত হাজার ৪৯৫ মেগাওয়াট। পিডিবির মতে বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পর বিদ্যুতের যে মহাপরিকল্পনা করেছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মানুষ শতভাগ বিদ্যুত পাবেন। তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে চাহিদাও। সে চাহিদা পূরণে সরকারও বদ্ধপরিকর। মহাপরিকল্পনা অনুসারে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা। সেখানে আছে বড় বড় বিদ্যুত কেন্দ্র। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ বছর বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। বর্তমানে মাতারবাড়ি, রামপাল ও পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে।’ সরকার বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কয়েকটি বড় কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এখন পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া বড় কেন্দ্রের সব ক’টিই কয়লাভিত্তিক। এ কাজে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের ৪০ ভাগের মতো কাজ শেষ হয়েছে। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের পাইলিংয়ের কাজ চলছে এখন। এছাড়া মাতারবাড়ির কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪০০০ মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০০০০ মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’ ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুত’-এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ও কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের আপত্তি রয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×