ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র এক লাখ টাকার জন্য আটকে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্রোপচার

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৯ জুলাই ২০১৮

মাত্র এক লাখ টাকার জন্য আটকে আছে বীর মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্রোপচার

মোরসালিন মিজান ॥ আজ যে বিরুদ্ধ স্রোত, বিভ্রান্ত প্রজন্ম, একটু পেছন থেকে শুরু না করলেই নয়। সেই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর সবকিছু উলটপালট হয়ে গিয়েছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছিল একাত্তরের চেতনা। মুক্তিযোদ্ধারা নিজ পরিচয়ে কোথাও দাঁড়াতে পারেননি। চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। নতুন করে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাববে, তেমন সরকার ছিল না। এর কুফল হিসেবে যারা দেশ দিয়েছেন তারাই হয়ে যান করুণার পাত্র! হ্যাঁ, এর বহু বহু কাল পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দায় স্বীকার করার সুযোগ পেলেন। সরকারে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর উদ্যোগ নিলেন তিনি। বাস্তব প্রয়োজনের নিরিখে জরুরী কিছু সিদ্ধান্ত হলো। শুরু হলো বাস্তবায়ন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রজন্ম দাঁড়িয়ে গেছে মাথা তুলে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, দীর্ঘকাল ধরে চলা উদাসিনতা, বিচ্যুতি, বিকৃতি তরুণ সমাজের একটি অংশকে বিভ্রান্ত করেছে। স্বাধীন দেশে রাজাকারদের পুনরুত্থান দেখে উৎসাহিত হয়েছে সুবিধাবাদ। ব্যক্তিস্বার্থ। এখন লেখাপড়া জানা অনেক ছেলেমেয়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করে কথা বলছে! ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। তারা বলতে চাইছে, মুক্তিযোদ্ধারা অনেক পেয়েছেন। যুদ্ধ করেছেন বলে কী দেশটা তারা কিনে নিয়েছেন? তাদের ছেলেমেয়ে নাতি নাতনীদের সরকার কেন দেখবে? আলোচনার এ পর্যায়ে মূল প্রসঙ্গটিতে আসা যাক। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের কথাটি হোক। হ্যাঁ, তার কথা বলতেই এত কথা বলা। এত কথা বলতে হলো। জেনে অনেকে চোখ কপালে তুলবেন, লজ্জায় পড়ে যাবেন, লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার হার্টের অপারেশন আটকে আছে মাত্র ১ লাখ টাকার জন্য! আজকের বাংলাদেশে ১ লাখ টাকা, এ টাকার কী এমন মূল্য আছে? অথচ মুক্তিযোদ্ধারা এমন নিঃস্ব এত অসহায় যে, ১ লাখ টাকাও তাদের কাছে অনেক টাকা। জীবন বাঁচাতে সামান্য টাকার সংস্থান তারা করতে পারনে না। চট্টগ্রামের ছোট্ট ভাড়া বাসায় কাতরাচ্ছেন আবুল বাশার। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্দরনগরীতে গত ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন আবুল বাশার। সর্বশেষ একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ছোট্ট চাকরি করতেন। ২০১০ সালে অবসরে যান। তখন থেকে টিকে থাকার নতুন সংগ্রাম। দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধা এখন আর বিছানা ছেড়ে ওঠতে পারেন না। গত চার বছর ধরে অসুস্থ তিনি। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। তবে হার্টের সমস্যাই প্রকট। ইতোমধ্যে পাঁচবার হার্ট এ্যাটাকের শিকার হয়েছে। অবস্থার ক্রমঅবনতি দেখে সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয় তাকে। পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে ডাক্তাররা জানান, হার্টে মোট ৩টি ব্লক। অন্তত দুটিতে রিং বসাতে হবে। কাল ক্ষেপণ করা যাবে না। এখনই অপারেশন করা চাই। তা না হলে যে কোন মূহূর্তে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। কিন্তু এ জন্য টাকা লাগবে ২ লাখ। মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে ১ লাখ ছাড় আছে। বাকি ১ লাখের বন্দোবস্ত পরিবারকেই করতে হবে। তবেই অস্ত্রোপচারে যেতে পারবেন চিকিৎসকরা। কিন্তু হায়! ১ লাখ টাকা তো দূরের কথা, ১ হাজার টাকাও পরিবারটির জন্য অনেক টাকা। চোখ ভর্তি জল ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই তাদের! সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক গত ৬ জুলাই হার্টে অস্ত্রোপচারের কথা জানিয়ে ছিলেন। আজ অবদি তা সম্ভব হয়নি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এখন রোগী। মৃত্যুতে তার ভয় নেই। কিন্তু পরিবারটির কী হবে? এই ভেবে বুক ধরফর করে ওঠে তার। অথচ আবুল বাশার ১৯৭১ সালে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীতে তখন। সিপাহী। বয়স মাত্র ১৫ বছর। এইটুকুন বয়সে জীবন নিয়ে কত সাধ স্বপ্ন। এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা। আর অযুত পিছুটান। সব ছেড়ে ছুড়ে যুদ্ধে যান তিনি। ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। অনেক দুঃসাহসিক অভিযানে জীবন বাজি রেখে অংশ নেন। একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিলেট ও আশুগঞ্জে, একটু পাঠ করলেই জানা যাবে, অনেক বড় অপারেশন চালিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরই দলে ছিলেন আবুল বাশার। জীবন তখন তুচ্ছ। যখন তখন মাথার খুলি উড়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। তবুও পিছু পা হওয়ার সুযোগ নেই। প্রশ্ন ওঠে না। সেই বীর আজ জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত। তাকে কিছুটা রক্ষা করেছে বর্তমান সরকারের দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। ভাতা গ্রহণ করে কোনরকমে চলছে পরিবারটি। কিন্তু মাত্র ১০ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া। খাওয়া। ছেলে মেয়ের লেখাপড়া। তার পর চিকিৎসার খরচ। কত আর পারা যায়? কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ৬৬ বছর বয়সী আবুল বাশার। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছিল দীর্ঘশ্বাস। অনুমান করা যাচ্ছিল, আর পারছেন না তিনি। হয়ত তাই একাত্তরে ফিরে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, আমার কত সাথী ভাই মারা গেল, আল্লার কী ইচ্ছা, আমি...। কথা শেষ হয় না। শিক্ষিত মানুষের শহর বড় লোকের শহর ঢাকায় এসে আছড়ে পড়ে তার কান্নার শব্দ। স্ত্রীর কণ্ঠেও কান্না। অসহায় কণ্ঠে তিনি বলেন, ডাক্তারদের মুক্তিযুদ্ধের এই কাগজ ওই কাগজ দেখাই। তারা তখন অর্ধেক মূল্যে কিছু ওষুধ দেন। বাইরে থেকে গায়ের দামে বাকি ওষুধ কিনতে হয়। এ অবস্থায় কী করে স্বামীকে বাঁচাবেন? সন্তানদের ভবিষ্যত কী হবে? কিছুই জানেন না তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটু দেড়ি করেই বিয়ে করেছিলেন তারা। তাই সন্তানরা এখনও ছোট। ধার দেনা করে কিছুদিন আগে এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলেটিও মাধ্যমিক পর্যায়ে। জীবন বাঁচে না, টিউটর রেখে উন্নত লেখাপড়ার নিশ্চয়তা দেবে কে? কোনরকমে পাস করার চেষ্টা করছে তারা। আর বড় ছেলেটির পায়ে সমস্যা। নামমাত্র কাজ করে। সব মিলিয়ে অথৈসমুদ্রে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটি। ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মুক্তিযোদ্ধার অসহায় স্ত্রী আল্লাহকে ডাকছিলেন। বলছিলেন, আর আমি কার কাছে যাব? যে দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার, প্রধানমন্ত্রী যেখানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, সে দেশে কার কাছে যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী!
×