ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জ্যোৎস্নালিপি

গল্প-হুতুমপ্যাঁচার ভুতুমবাড়ি

প্রকাশিত: ০৭:২২, ২৮ জুলাই ২০১৮

গল্প-হুতুমপ্যাঁচার  ভুতুমবাড়ি

শানবাঁধানো পুকুরঘাট। তার উত্তরপাশে একটা আমগাছ। এই আমগাছটার মোটা ডালে বাস করে একটা হুতুমপ্যাঁচা। দিনের বেশির ভাগ সময় সে ঝিমোয়। আশপাশের গাছের ডালে অনেক পাখি বাস করলেও বেশ কিছুদিন ধরে হুতুম কারও সঙ্গে মেশে না। তার বাড়িতে বেড়াতে আসাটাও পছন্দ করে না। পাড়ার অন্য পাখিরা বলাবলি করে, হুতুম ভারি অহঙ্কারী হয়েছে আজকাল। নিশ্চয় তার বড়িতে এমন কিছু আছে, যা নিয়ে তার অহঙ্কার হয়েছে। এসব কারণেই অন্য পাখিরা হুতুমের বাড়িটির নাম দিয়েছে ভুতুমবাড়ি। একদিন সবার কৌতূহল হলো- কী আছে এমন বাড়ির মধ্যে, যা হুতুম লুকিয়ে রাখে। দেখতে হয় তো। শালিক, চড়–ই, টিয়া, কাক, কাঠঠোকরা, ঘুঘু, দোয়েল- সবাই মিলে পরিকল্পনা করল হুতুম যখন ঘুমে থাকবে, তখন তারা লুকিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখে আসবে কী আছে সেখানটায়। কিন্তু এমনভাবে সে বাড়িটিকে পাহারা দিয়ে রাখে, ঢোকবার উপায় পর্যন্ত নেই। তাছাড়া সে নিজের বাসার মধ্যে না ঢুকে গাছের ডালেই ঘুমায়। সবাই ভেবে পায় না, নিজ বাসা ছেড়ে কেন সে ডালে বসে ঘুমায়। একদিন দুপুরবেলা। ঘুমে পড়ে যায় হুতুম। ক’দিন তার খাবার সংগ্রহ করতে যাওয়া হয়নি, তাই দানা পড়েনি পেটে। ক্ষুধায় শরীর চলে না। যেহেতু অন্য পাখিদের সঙ্গে সে মেশে না, তাই কেউ তাকে খাবারের কথা শুধোয় না। কারণ যারা তার সঙ্গে মিশতে চেয়েছে, বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে; সে তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ইচ্ছে করে খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু হুতুম জানে, সে একসময় এমন ছিল না। এই কিছুদিন আগেও সবার সঙ্গে মিশত, কথা বলত। হঠাৎ করেই এমনটা হলো তার। সবাই মিলে ঠিক করে, ভুতুমবাড়িতে তারা হানা দেবে আর খুঁজে বের করবে রহস্য। গভীর ঘুমে হুতুম। চড়–ই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ভুতুমবাড়িটির দিকে। তার পাশে অন্যরা। বাসাটিকে তারা ঘিরে ধরে। আজ তারা কোন বাধা মানবে না। যদি হুতুম জেগে ওঠে তবুও। কাঠঠোকরা তার ঠোঁট দিয়ে বাসার মুখটা টেনে ধরে। টিয়া উঁকি দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভুল দেখছে না তো সে! ভুলই মনে হয় তার! সে কাকের কানে কানে কী যেন বলে। কাক বাসাটার মধ্যে উঁকি দেয়। সে-ও ভয়ে শিউরে ওঠে। এবার শালিক উঁকি দেয়। সেও দুপা পিছিয়ে আছে। সবাই জানতে চায়- এমন কী আছে বাসাটার মধ্যে যে সবার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে। কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় হুতুমের। সে অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব রেগে যায়- তার অনুমতি না নিয়ে বাসার সামনে জটলা করার জন্য। বলে, তোমরা কী আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমি তো তোমাদের বাসায় যাই না, তোমরা কেন আমার বাসার পাশে ঘুরঘুর করছ। চলে যাও। আর কোন দিন আমার বাসার কাছে আসবে না। কথাও বলবে না। এখনি যাও। কিন্তু কেউ ডাল থেকে নড়ে না। এমনকি হুতুমের কথাতেও কেউ অপমানিত বোধ করে না। বরং হুতুমের জন্য মন কেমন করে তাদের। আর হুতুমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে থাকে। কেউ গাছের ডাল ছেড়ে নড়ছে না দেখে হুতুম আবার বলে, কী হলো তোমাদের? নড়ার নামটি পর্যন্ত করছ না। দেখ, আমি খুব ক্লান্ত এখন যাও তোমরা- এবার সকলকে অনুরোধ করে সে। সবার মধ্যে থেকে প্রথমে কথা বলে শালিক। বলে, হুতুম তুমি তো আমাদের পরম বন্ধু। এত দিন নিজের জীবনের মায়া না করে আমাদের রক্ষা করেছে। চড়–ই বলে, আমাকে ক্ষমা করে দাও; আমি না বুঝে তোমাকে নিয়ে মজার মজার গল্প বানিয়েছিলাম। আর তোমার বাড়িটির নাম দিয়েছিলাম ভুতুমবাড়ি। আমি তো তখন জানতাম না, কেন তুমি এমন কর- নিজবাড়ি ছেড়ে গাছের ডালে ঘুমাও। হুতুম কোন কথা বলে না। তার চুপ থাকা দেখে কাঠঠোকরা বলে, এবার তো কিছু বল? আমরা তোমার কথা শুনতে চাই? এবার হুতুম বলে, কিছুদিন আগে একটা দাঁরাশ সাপ এসে বলে, তার কোন থাকার জায়গা নেই; তাই সে হুতুমের বাসায় থাকবে। হুতুম বলে তুমি থাকলে আমি কোথায় থাকব? সে বলে বেশি কথা বললে এখনই তোর জীবনটা নিয়ে নেব। অন্যদের বাসা তো ছোট আমার শরীরটা দেখছিস তো কত বড়। আর তুই খেয়ে খেয়ে শরীরটা বেশ মোটাসোটা বানিয়েছিস। তোর বাসাটাও বেশ বড় এবং মজবুত; এখান থেকে পাশের বাড়ির কবুতরের ঘর থেকে ডিম খেতে আমার বেশ সুবিধা হবে। তাই আমি এখন থেকে তোর বাসাতেই থাকব। তুই ডালে বসে পাহারা দিবি আর মানুষ নামের প্রাণীরা ধারেকাছে এলে আমায় সংকেত দিবি। তা না হলে সবাইকে ধরে ধরে খেয়ে ফেলব। মনে থাকবে- এইটুকু বলে থামে হুতুম। এবার সবাই বলে ওঠে- তুমি আমাদের জীবন বাঁচাতে এমন করেছ। এবার আমরাও তোমাকে তোমার ঘর ফিরিয়ে দেব। হুতুম বলে, কিন্তু দাঁরাশটা অনেক দুষ্টু তার সঙ্গে তোমরা পারবে না। আমরা সবাই মিলে বুদ্ধি করে ওকে শাস্তি দেব। তুমি চিন্তা কর না। কাক বলে, আমাদের সবার শক্তির সঙ্গে সে একা সে পারবে না। দুষ্টু সাপটার গায়ে যত শক্তিই থাকুক সে আমাদের সকলের শক্তি আর বুদ্ধির কাছে হার মানবে। কারণ আমরা ভাল কাজ করতে যাচ্ছি আর সে জোর করে ভয় দেখিয়ে তোমার বাড়ি দখল করেছে- বলে টিয়া। একদিন ভোরবেলা কবুতরের ডিম খেয়ে বিভোরে ঘুমোচ্ছিল সাপটি। তার নাকডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকে। আগেই বুদ্ধি করে সকলে মিলে তৃণ জোগার করে বাবুইকে দিয়ে একটি শক্ত রশির মতো বানিয়ে রেখেছিল তারা। এবার সকলে ঠোঁট দিয়ে সেই রশি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা সাপটির গলা, পেট আর লেজ শক্ত করে বাঁধে। বেজিদের আগে থেকেই বলা ছিল তারা আমগাছের নিচে অপেক্ষা করে। সাপের তো ঘুম ভেঙে যায়। মনে মনেভাবে- সে নড়তে চড়তে পারছে না কেন! একি হলো তার! অসুখ করেনি তো! একি! তার চোখে সামনে হুতুমটি দাঁড়িয়ে কেন? হুতুমের চোখেমুখে কোনো ভয় নেই! হুতুমের সঙ্গে আরও অনেকে। এরা তাকে এমন করে বেঁধে রেখেছে কেন? আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধপ্পাস করে মাটিতে ফেলে দেয়া হয় তাকে। এখানে আরও বেশি বিপদ। অনেকগুলো বেজি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসে। বিপদ বুঝতে পেরে সে বলে, এবারের মতো মাফ করে দাও। হুতুম বলে, তুমি তো দুষ্টু, মাফ করলে আবার তুমি আমাদের ভয় দেখিয়ে এমন করতে পার। বেজিরা রশি ধরে সাপটিকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। আর বলে ক্ষমা করে দিলাম কিন্তু কিছুটা শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে- তুমি আর এই এলাকায় থাকতে পারবে না। সবাই খুশি। বিপদ কেটে গেছে। হুতুমপ্যাঁচা তার বাড়ি ফিরে পেয়েছে। সবাই হুল্লোড় করে বলে- তোমার বাড়িটিকে কিন্তু আমরা ভুতুমবাড়ি বলেই ডাকব। হুতুমপ্যাঁচা মুচকি হাসে।
×