ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সহায়ক সরকার নয়, এবার বিএনপির চার শর্ত

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ জুলাই ২০১৮

 সহায়ক সরকার নয়, এবার বিএনপির চার শর্ত

শরীফুল ইসলাম ॥ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা থেকে পিছু হটেছে বিএনপি। এর পরিবর্তে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে এখন চারটি শর্ত দিয়ে বলা হয়েছে এসব শর্ত পূরণ না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির দেয়া শর্ত আমলে না নিয়ে বলা হচ্ছে সংবিধানে উল্লিখিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এদিকে কী কারণে বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরির পরও তা ঘোষণা থেকে পিছু হটে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কিছু জানা যায়নি। সূত্রমতে, বিএনপি যে সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছিল তা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন না করার ব্যাপারে অনড়। বিভিন্নভাবে বিএনপি এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা থেকে পিছু হটে। তবে তারা এখন চায় যে কোনভাবেই হোক মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ। বিএনপির সাম্প্রতিক এক সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হলে তিনটি শর্ত পূরণের দাবি জানান। তার দেয়া এক নম্বর শর্ত হচ্ছে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া। দুই, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। তিন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং চতুর্থ শর্ত হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন। এর ক’দিন পর বিএনপির থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চার শর্ত পূরণের কথা বলেন। তবে তিনি এই চার শর্তের পাশাপাশি কারাবন্দী খালেদা জিয়াসহ বিএনপির সকল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার ও নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ৩ থেকে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার দাবি জানান। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া এসব শর্ত নজরে আসার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদসহ দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, বিএনপির দেয়া কোন শর্ত কাজে আসবে না, কারণ নির্বাচনকালীন সরকার হবে সংবিধান অনুসারে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করার কোন সুযোগ নেই। আর বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না সেটা সম্পূর্ণ তাদের বিষয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বছরখানেক আগেই সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা ঠিক করে বিএনপি। কিন্তু এ রূপরেখা ঘোষণার আগেই এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজা নিয়ে কারাবন্দী হন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি কবে মুক্তি পাবেন তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে সহায়ক সরকারের বিষয়ে কৌশল পরিবর্তন করে বিএনপি। জানা যায়, বিএনপি এমনভাবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছিল যাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতার বাইরে রেখে নির্বাচন করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সংবিধান অনুসারে এটা অসম্ভব। কারণ, বিএনপির কথায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তন করবে না। কারণ, যেখানে নির্বাচনের আগে সংলাপের মাধ্যমে সরকারী দলের সঙ্গে সমঝোতা করাই সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে কি করে আওয়ামী লীগকে সংবিধান সংশোধনে রাজি করাবে বিএনপি। এদিকে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যেই দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে দলটি। তারা জানিয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। দলের নেতারা জানিয়েছেন, এটা নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখার রাজনৈতিক কৌশল। এ কৌশলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায় কিনা সে চেষ্টাই করা হচ্ছে। তবে এই তিন সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিএনপির অনাস্থা প্রকাশের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশে নির্বাচনে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরার কৌশলও দলটির রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলকে সোচ্চার করার সুযোগ পাবে। জানা যায়, বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা ও দলীয় থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত ক’জন বুদ্ধিজীবীর চেষ্টায় সহায়ক সরকারের একটি খসড়া রূপরেখা বছরখানেক আগেই তৈরি করে বিএনপি। গতবছর ১৫ জুলাই লন্ডন যান খালেদা জিয়া। ৩ মাস লন্ডনে অবস্থানকালে এ বিষয়ে ছেলে তারেক রহমানের মতামতও নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেও এ বিষয়ে মতামত নিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অপেক্ষা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তা তুলে ধরার। কথা ছিল সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফর করবেন। এ ছাড়া তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সহায়ক সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে এ বিষয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করবেন। বিভিন্ন জেলা নেতাদের খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সফর সম্পর্কে জানিয়ে দিয়ে এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের কাছে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করে চরম বেকায়দায় পড়ে দলটি। এর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেশ ক’বার ক্ষমতায় থাকা এ রাজনৈতিক দলটি। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি কিছু নতুন কৌশল অবলম্বন করে। ৩ মাস লন্ডনে অবস্থানকালে ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে এসব কৌশল নিয়ে খালেদা জিয়ার বিস্তারিত আলোচনা হয়। সূত্র জানায়, কঠোর আন্দোলনে সরকারকে চাপে ফেলতে না পারা, ২০ দলীয় জোটের পরিধি বৃদ্ধি করে একটি বৃহত্তর জোট গঠন করতে না পারা এবং কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সনের মুক্তির বিষয়ে অনিশ্চয়তার কারণে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়ে বিএনপি কৌশল পরিবর্তন করে। তাই এখন চার শর্তের কথা বলে এর পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন এই ৪ শর্ত পূরণ হলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির সুবিধা হবে।
×