ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাই হর্টিকালচারে গবেষণায় সাফল্য

এবার বারোমাসি কাঁঠাল

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ জুলাই ২০১৮

এবার বারোমাসি কাঁঠাল

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ সারাবছর কাঁঠাল উৎপাদনের সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। একদিকে সারা বছর জাতীয় ফল কাঁঠাল পাওয়া যাবে, অন্যদিকে কাঁঠালের দামও ভাল পাবেন কৃষক। কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কিন্তু এই অভিজাত ও নানান গুণে গুণান্বিত ফলটির উন্নয়নে তেমন কোন অগ্রগতি না থাকায় কোন সুফল পাচ্ছিল না কৃষক। এই জাতীয় ফলটিকে অভিজাত বানানোসহ বছর ধরে এর ফলন অব্যাহত রাখার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন কল্যাণপুর হর্টিকালচারের উপপরিচালক এবং গবেষক কৃষিবিদ ড. সাইফুর রহমান। তাকে সহযোগিতা করেন একই কেন্দ্রের গবেষক কৃষিবিদ জোহরুল ইসলাম। মাত্র বছর খানেকের একাগ্রতা ও গবেষণায় বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। কাঁঠালের উন্নত জাতের মাতৃগুণ বজায় রেখে দ্রুত সম্প্রসারণে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছেন এই গবেষক। ‘পিল গ্রাফটিং’ করার মাধ্যমে অতি আগাম, নাবি, আঠা ও ভোঁতাবিহীন বারোমাসি উন্নতজাতের কাঁঠাল সম্প্রসারণে আশাব্যাঞ্জক সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে কাঁঠালের নতুন পদ্ধতি ‘পিল গ্রাফটিং’ এর মাধ্যমে কলম করার ফলে সফলতার হার যেমন বেড়েছে তেমনি বছরের যে কোন সময় (অধিক শীত ব্যতীত) কলম করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে নতুন জাতের গুণাগুণ অক্ষুন্ন রেখে দ্রুত সম্প্রসারণ করা সম্ভব। বছরের বারোমাস জুড়ে ছোট ছোট গাছে কাঁঠাল আনা সম্ভব হবে। ফলে একদিকে তরকারি সমস্যা, অপরদিকে পাকা কাঁঠালের সব ধরনের গুণাগুণ অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হবে। কিভাবে সায়ন করা হয় ॥ এক বছর বয়সী কাঁঠালের চারা যেটি কলম করার ১৫-২০ দিন আগে মাটি থেকে এক ফুট ওপরে মাথা কেটে রাখতে হবে (মাথা না কাটলেও চলে তবে সেক্ষেত্রে বাকল পাতলা থাকে)। কাঠাল ধরা গাছের প্রান্তের দিকে ডগার গোড়ার দিকে স্পষ্ট বাড বা কুঁড়ি। চোখসহ সায়ন (বাদামি রংয়ের) (ডগার মাথা কলম করার ১০-১২ দিন আগে কেটে রাখলে বাড পাওয়া যায়), চাকু, বাডিং লাইট, চিকন পলিথিন (পেচান) ৪”দ্ধ৩” আকারের পলিথিন কভার, চিকন রাবার ব্যান্ড ইত্যাদি প্রয়োজন হবে। পলিব্যাগের উৎপাদিত ১ বছর বয়সী কাঁঠাল চারা (স্টক) কলম করে ১৫-২০ দিন আগে পলি ব্যাগের মাটি থেকে এক ফুট ওপরে মাথা কেটে দেয়া হয়। স্পষ্ট চোখ বা বাড পাওয়ার জন্য ১০-১২ দিন আগে ফলধরা গাছের প্রান্তের দিকের ডগার মাথা চিমটি দিয়ে কেটে দেয়া হয়। কলম করার দিন স্পষ্ট স্টকের মাথা হতে নিচের দিকে আলাদা করা হয়। এর জন্য বাকলের আয়তনের চওড়া পরিমাণ উভয় পার্শ্ব দিয়ে কেটে দিয়ে বাডিং লাইফের সাহায্যে আস্তে আস্তে আলতোভাবে চিহ্নিত বাকলের অংশ কাঠ হতে আলাদা করা হয়। আলাদা বাকলের দৈর্ঘের পরিমাণ সায়নে দেয়া তীর্যক কাঠের সমান। আলাদা করা বাকলটি শুকানোর হাত হতে রক্ষা করার জন্য আবার বাকলটি কাঠের সঙ্গে ঠেসে দেয়া হয়। সায়নের জন্য কর্তিত ১ ফুট সাইজের ডগা হতে বাদামি অংশে যেখানে স্পষ্ট বাড বা চোখ আছে সেখান থেকে বাডের পিঠসহ নিচের দিকের এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ অংশ কেটে নেয়া হয় অর্থাৎ এক বা দুই ফুট বিশিষ্ট দেড় থেকে পৌনে দুই ইঞ্চি পরিমাণ সায়ন ডগা তৈরি হয়। বাডের নিচ থেকে সায়ন ডগার উভয় পাশে একটি করে দুটি তীর্যক কাঠ দিয়ে গোঁজ আকারের সায়ন তৈরি করা হয়। গোঁজটি সেই আলাদা করা বাকলের ঠিক মাঝখানে আলাদাভাবে বসিয়ে দেয়া হয়। পেচনি দিয়ে কাটা অংশ মাঝারি শক্ত করে পেঁচিয়ে পলিথিন গিঁট দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। ৪”× ৩”আকারের পলিথিন কভার দিয়ে পেঁচানো অংশ পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হয় এবং একটি চিকন রাবার পলিথিনের খোলা অংশে আলাদাভাবে লাগিয়ে দেয়া হয় যাতে করে পলিব্যাগের মধ্যে জমা পানি সহজেই গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। এই কলম করা চারাগুলো একটি গাছের ছায়ার মাটিতে নালা করে তার মধ্যে বসিয়ে চারা পলিব্যাগের মাটির নিচে বসিয়ে গোড়ার মাটি দিয়ে ঢেকে হালকা পানি সেচ দেয়া হয়। পঞ্চম, দশম ও পনেরতম দিনে ডাটা দেয়া হয়। কলম করা অংশের নিচের দিকে স্টক গাছে কুশি গজালে তা ভেঙ্গে দিতে হবে। পলিথিন কভারে পানি জমলে দিনে একবার সেই পানি ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়। কল্যাণপুর হর্টিকালচারে কলম তৈরির সফলতার হার শতকরা একশত ভাগ। পাতা বড় হলে পলিথিন কভার খুলে ফেলা হয়। বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে সূক্ষ্মতা আনয়ন, ব্যক্তির দক্ষতা বাড়ায় সফলতার হার অনেক বেড়েছে। তবে অভিজ্ঞ কৃষিবিদ ও কল্যাণপুরের মতো হর্টিকালচার ফার্ম না থাকলে বেসরকারী পর্যায়ে এই জটিল বিষয়ে দক্ষতা বাড়ালেও সফলতা আনা খুবই কঠিন। এই প্রযুক্তি টক আতা ও জামে ব্যবহার করেও সফলতা এসেছে বলে গবেষক ড. সাইফুরের মন্তব্য। তবে কাঁঠালের গাছে বা চারায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি ব্যবহারে খুবই সচেতন হতে হবে। কারণ বিষয়টি খুবই জটিল। বারোমাসি কাঁঠাল গাছের চারা সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যেই চাউর হওয়ার কারণে আগ্রহী চাষী দর্শনার্থীদের ভিড় দিনের পর দিন বাড়ছে। তবে বারোমাসি কাঁঠাল গাছের চারা তৈরিতে যে হারে পরিশ্রম হয়েছে সেই তুলনায় চারাগাছের দাম নির্ধারণ করা হয়নি। কৃষকের সাধ্যের মধ্যেই দাম ধরা বা রাখা হয়েছে।
×