ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শহুরে শিশুরা ভুলে যাচ্ছে খেলাধুলা ॥ সময় কাটে টিভি দেখে কম্পিউটারে গেম খেলে

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৮

শহুরে শিশুরা ভুলে যাচ্ছে খেলাধুলা ॥ সময় কাটে  টিভি দেখে কম্পিউটারে গেম খেলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর অগ্রণী স্কুল এ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে আফরিন জাহান। সকালে সে স্কুলে যায়, বিকেলে থাকে কোচিং। তাই খেলার কোন সময় পায় না। কাছাকাছি বয়সের দুই ভাইবোন নাদিম ও নূপুর থাকে আজিমপুরে। লেখাপড়ার সময়ের বাইরে সারাক্ষণই প্রায় ঘরে টিভি দেখে। খেলাধুলার কথা জিজ্ঞেস করলে নূপুর বলে, ‘ভাইয়া বাইরে খেলতে যায়, কিন্তু আমাকে মা যেতে নিষেধ করেছে, তাই যাই না।’ ছোট্ট উৎস এসেছে মায়ের সঙ্গে এসেছে আজিমপুর মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠানামা করছে। জিজ্ঞেস করায় সে বলে, ‘আমি ঘরের মধ্যে বল খেলি। আর কম্পিউটারে গেম খেলি।’ রাজধানীর অধিকাংশ শিশুর অবস্থাই আফরিন-নূপুর-উৎসর মতো। একে তো স্কুল-কোচিংয়ের বাইরে সময় পায় না তারা, উপরন্তু খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধাও খুব কম। অথচ খেলাধুলা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহযোগিতা করে। যেকোন ধরনের ট্রমা, দুঃখ এমনকি না পাওয়ার ক্ষোভও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা ভুলে থাকতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, এই এলাকায় ৩১ খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে। অন্যদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ৫৪। তবে এসব মাঠ ও পার্কের অনেকই খেলাধুলার পরিবেশ নেই। বেশ কয়েকটি রয়েছে অবৈধ দখলে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। কিন্তু এই শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। এই অবস্থা পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্রীড়া নীতি থাকা খুব জরুরী বলছেন সংশ্লিষ্টরা। শিশুদের কল্যাণে খেলার সুযোগ নিশ্চিত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করে খোদ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিশুদের জন্য খেলার নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় ক্রীড়া নীতি প্রণয়ন, শিশুদের খেলাধুলার গুরুত্ব নিয়ে সবাইকে সচেতন করা, মহল্লাভিত্তিক খেলার মাঠ নির্মাণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অটিস্টিক শিশুদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণ দেয়া, দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ, স্কুল মাঠগুলো ছুটির দিনে ও বিকেলে খোলা রাখা এবং সারাদেশের মাঠগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করা বড় চ্যালেঞ্জ। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘সরকারীভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদের খেলাধুলা করার সুযোগ থাকলে তা দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সহযোগিতা করে। যেকোন ধরনের ট্রমা, দুঃখ-বেদনা এমনকি না পাওয়া, এগুলো খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা ভুলে থাকতে পারে বা ভুলে যায়।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয়ভাবে শিশুদের কনভেনশন, শিশু নীতিমালা আছে- এগুলো খুব ভাল কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলো জাতীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক ক্ষেত্রে খেলার শিক্ষক নেই, মাঠ নেই। এগুলো অনেক বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে।’ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রসঙ্গে ওয়াহিদা বানু বলেন, ‘যে শিশু গৃহহীন, এতিম, শ্রমজীবী শিশুর জীবন আরও মানবেতর। তাদের থাকা খাওয়া হয়ে উঠছে না, তাদের জন্য মাঠ, টুর্নামেন্টের আয়োজন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুযোগ নেই।’ তিনি জানান, অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, পার্ক আছে কিন্তু সেখানে গরু চরছে, ড্রাগ ব্যবহারকারী বা বিক্রেতারা ব্যবহার করছে। দখল হয়ে আছে। মাঠগুলো শিশুদের জন্য খেলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকারী উদ্যোগ জরুরী বলে মত দেন তিনি। ওয়াহিদা বানু বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্পোর্টস পলিসি খুব জরুরী। এটার গাইডলাইন থাকতে হবে। খেলাধুলার শিক্ষক থাকবে অবশ্যই এবং তারা মাসে একটা করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। তাহলে অটিস্টিক, ডিজ্যাবলড, দলিত সব শিশু একসঙ্গে হওয়ার, ভাবার, খেলার সুযোগ পাবে। তাদের ভেতরে একাত্মবোধ থেকে দেশাত্মবোধ আসবে।’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘খেলার মাঠ নেই- এটা আসলে দুঃখজনক বিষয়। আমরা প্রস্তাব রেখেছি প্রতিটি এলাকাভিত্তিক মাঠ রাখার জন্য। প্রতিটি মহল্লাতে অন্তত একটি করে মাঠ যেন রাখে, যেন মাঠে শিশুরা খেলতে পারে। আসলে শহরের জন্য সত্যিই সমস্যা।’ তিনি বলেন, ‘স্কুলগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো তৈরি হয় কিন্তু মাঠ থাকে না। এই বিষয়ে ভালভাবে নজর দেয়া দরকার।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের মনের বিকাশ আমরা যদি নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে আমরা সমৃদ্ধ জগৎ পাবো না যারা আমাদের দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার হবে। তাদের জন্য আমাদের সবাইকেই ভাবতে হবে।’
×