ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী সংস্কৃতির শিকড় নৌকাবাইচ

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২৮ জুলাই ২০১৮

বাঙালী সংস্কৃতির শিকড় নৌকাবাইচ

স্বল্প প্রশস্তের লম্বা নৌকা। ৪০ থেকে ৪৫ ফুট দীর্ঘ। কখনও আরও বড়। নৌকার দুই ধারে সারিবদ্ধ ৩০-৩৫ জন লোক। ছেলে-বুড়ো সকলেই আছে। প্রত্যেকের হাতে বৈঠা। নৌকার মধ্যে যারা আছে তাদের কারও হাতে ঢোলক, কারও হাতে খোল। একজন বয়াতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সহযোগীরা তুলছে সুর। নৌকার মাঝখানে যিনি আছেন তার হাতে পিতলের কাসর। হেলে দুলে বাজায়। বাদ্যের তালে মাঝি মাল্লারা দাঁড় ফেলে বৈঠা বাইয়ে নৌকাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিকের এক মাঝি লম্বা বৈঠা বাতাসে ঘুরিয়ে তাল মেলাচ্ছে। নৌকার পেছনে লম্বা বৈঠা হাতে দু’জন দিক নির্ণয় ঠিক রাখছে। প্রতিযোগিতায় স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার এই খেলা ‘নৌকা বাইচ’। দেশের প্রতিটি এলাকায় জাতীয় দিবসে, উৎসব পার্বণে নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান অধিকারী দলকে পুরস্কৃত করা হয়। বর্ষা ও শরত মৌসুমে অনেক গ্রামে গৃহস্থ ও কৃষক নৌকা বাইচের (প্রতিযোগিতা) উদ্যোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাইচওয়ালাদের অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। কবে-কোথায় এই নৌকা বাইচের শুরু তা স্পষ্ট করে জানা যায় না। ব্রিটেনের টেমস্ নদীতে বোট রেসের একটা তথ্য পাওয়া যায়। তারও আগে ১৩শ’ খিস্টাব্দে গনডোলেতে প্রথম নৌকা বাইচের কথা জানা যায়। সেই হিসেবে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নৌকা বাইচের ইতিহাস অনেক পুরনো। দেশের প্রতœসমৃদ্ধ এলাকায় টেরাকোটায় নৌকাসাদৃশ অঞ্চল দেখেও তাই ধারণা করা যায়। খোঁজ খবর করে জানা যায়, দেশের পূর্বাঞ্চলের মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জামিতরি ধলেশ্বরী নদী, পদ্মা তীরের এবং পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরের নৌকা বাইচ প্রাচীন। তবে নৌকা বাইচ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সংস্কৃতির বড় অনুষঙ্গ হয়ে আছে। নদ নদীগুলোতে চর পড়ায় নৌকা বাইচের আয়োজনও কমে গেছে। তার পরও বাঙালী সংস্কৃতির শিকড়ের এই ধারায় নৌকা বাইচের কথা কেউ ভোলেনি। আজও নৌকা বাইচ হয় প্রতিটি স্থানে। বাইচের নৌকার নানা নাম- ছিপা নৌকা (ছিপ), ঘাসি দোল, সুন্দরা, পানসী, ছান্দি, দক্ষিণ ছান্দি ইত্যাদি। একটা সময় ভরা যৌবনা নদীতে কোন উপলক্ষ তৈরি করেই আয়োজন করা হতো নৌকা বাইচের। একদা গৃহস্থ ও কৃষকের ঘরে ধান ওঠার মৌসুমে গ্রামীণ সমাজে নানা বিনোদনে ভরে থাকত দিনগুলো। কেউ মধ্য রাতে বজরা নৌকায় ঢুলিদের সঙ্গে নিয়ে মাঝ নদীতে গিয়ে ঢাকের বাদ্য বাজিয়ে উৎসব করত। নদী তীরের গ্রামের লোক জেগে উঠে ঢাকের তালে নাচানাচি করত। সেই দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছে। তবে টিকে আছে নৌকার বাইচ। আজও কেউ নৌকা বাইচের আয়োজন করে আশপাশের দশ গ্রাম মাতিয়ে দেয়। নৌকা বাইচের দিন হারজিতের পালায় অবিরাম বৈঠা টানা নাইয়াদের মুখে ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া আত্ম্যাতিক গানের তালে এগিয়ে যায় বাইচের নৌকা। গ্রামের লোক মাঝারি ডিঙির মতো লম্বা নৌকা দেখলেই বুঝতে পারে এটা ‘বাইচের নাও’। নাও (নৌকা) নদী আর নাইয়া, বাঙালীর হৃদয়ে এই তিনের রয়েছে নিবির সম্পর্ক। এই তিন দেশের সংস্কৃতির বাহক। মরমী শিল্পী আব্দুল আলিমের মধুর কণ্ঠের সেই গান ‘নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা কোন্ দেশে যাও চইলা ...’ আজও মন ভরিয়ে দেয়। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠের গান ‘মাঝি নাও ছাইড়া দেরে মাঝি পাল উড়াইয়া দে গা রে মাঝি গা...’ সুরের কি দোলাই না দিয়ে যায় হৃদয়ের মানসপটে। এই বাইচের নাও আমাদের সংস্কৃতিকে অনেক উপরে তুলে ধরেছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×