ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রূপগঞ্জে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প

স্বাবলম্বী ১২শ’ পরিবার

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৮ জুলাই ২০১৮

স্বাবলম্বী ১২শ’ পরিবার

একটি বাড়ি একটি খামারÑ প্রকল্পে যুক্ত হয়ে সাবলম্বী হয়েছেন প্রায় ১২শ’ পরিবার। গ্রামের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে প্রতিদিনই এ প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। ৭৭টি সমিতির মাধ্যমে এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছেন ১১ হাজার ৭৩ জন ব্যক্তি। রূপগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়কারী মাঠপর্যায়ে সমিতির উপকারভোগী সংগঠনের দক্ষতা, সমিতি পর্যায়ে যোগাযোগ, উঠান বৈঠকে অংশগ্রহণে আগ্রহ, সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বিভিন্ন কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধকরণের পারদর্শিতা, দাফতরিক শৃঙ্খলা রক্ষা, আদেশ নির্দেশ পালনের তৎপরতা ও দক্ষতা রয়েছে। এ কারণে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প এখন রূপগঞ্জের ৬টি ইউনিয়নের একটি আলোচিত প্রকল্প। গত ৬টি অর্থবছরে এই সমিতি দিন দিন সদস্যদের সঞ্চয়ী আমানত ও ঋণদান কর্মসূচীতে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। গত ৬ বছর এই প্রকল্পে মাধ্যমে ১শ’ ব্যক্তিকে ১শ’ টি গরু প্রদান, ৪৪টি টিনের প্রকল্প, ৩০টি হাঁস মুরগির প্রকল্প, ৯০টি নিজস্ব জায়গায় গাছের চারা রোপণ ও সবজি চাষ প্রকল্পে ১২০টি পরিবারকে সহায়তা করা হয়েছে। আর এই উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা সহায়তা করছেন। পাশাপাশি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে সঞ্চয় আদায়, ঋণ ও কর্মসংস্থান গ্রহণে সস্যদের বিভিন্ন কর্মকা-ের অংশগ্রহণের সুবিধাসহ উপজেলা সমন্বয়কারী ও স্থানীয় লোকজন সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে চালাচ্ছেন এর কার্যক্রম। অপরদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) একটি বাড়ি একটি খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকলকে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করে আসছেন। উপজেলা সমন্বয়কারী মোঃ ইখতিয়ার উদ্দিন জানায়, ২০১৩, ১৪, ১৫ , ১৬, ১৭ ও ২০১৮ অর্থবছরে ইউনিয়ন পর্যায়ে সমিতি এবং এর সদস্যদের বিভিন্ন মতবিনিময় সভা, সমিতির ম্যানেজার ও সদস্যদের কাজের গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে ইউনিয়নভিত্তিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে পুরস্কার ঘোষণা করায় দিন দিন বাড়ছে এর গতি। ফলে উপজেলায় শত ভাগ সঞ্চয় আদায়সহ এ অর্থবছরে অন্যান্য কার্যক্রম গত বছরের মতো সফলভাবে সম্পন্ন করার দাবি করেছেন তিনি। এই কর্মকর্তা আরও জানায়, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মূল লক্ষ্য দেশের প্রতিটি পরিবারকে মানব ও অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যক্রমে সর্বোত্তম ব্যবহার। আর্থিক কার্যক্রম এককভাবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দরিদ্রসীমা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এ প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় এ সমিতির সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সরকার ও অন্যন্য প্রতিষ্ঠান যে সেবা প্রদান করে তা গ্রামবাসীর মধ্যে পৌঁছানোর যে বাধা থাকে তা দূরীকরণ করে সেই সেবা দ্রুত কাক্সিক্ষত সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সকলকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের সদস্যরা সরকারী দফতরের প্রদত্ত ভাতা, অনুদানসহ প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকল্পের সদস্যদের অগ্রাধিকার প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের কাছে কাক্সিক্ষত সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য গ্রাম সংগঠনের সদস্যবৃন্দদের মধ্যে থেকে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী নিয়োগ করে। যেমন পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কর্মী, স্বাস্থ ও পুষ্টি কর্মী, শিল্প উন্নয়ন কর্মী, এদের মাধ্যমে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচী রূপায়ণ, বাল্য বিবাহ রোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য সচেতনাসহ বৃক্ষ রোপণ ও যৌতুক প্রথাসহ সমিতির সদস্যসহ গ্রামের অন্যান্যদের মধ্যে সচেতনা গড়ে তোলার জন্য এখন বেশ আলোচিত। যাদের ঘর বাড়ি নেই তাদেরকে সরকারী খাস জমি প্রদান করে সুস্থ ও সুন্দরভাবে সমাজে বেঁচে থাকার জন্য এ প্রকল্প প্রথম থেকে ব্যবস্থা করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক বেষ্টনীর ও বিভিন্ন অসঙ্গতি ও অনাচার দূর করার জন্য সমিতির সদস্যদের মাধ্যমে জনগণকে করা হচ্ছে উদ্বুদ্ধ। এ সমিতির সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ড প্রতিরোধের কারণে দিন দিন একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প রূপগঞ্জে বিস্তৃত হচ্ছে। এ খামার থেকে ঋণ নিয়ে গত ৬ বছরে অনেকেই সাবলম্বী হয়ে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এদের মধ্যে একজন নাজমা বেগম। বাড়ৈইপাড়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির এ সদস্য জানায়, এ প্রকল্পের সদস্য হওয়ার আগে তাদের সংসারে অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী। পাশের গ্রামের লোকজনের মুখে শুনে গত ২০১৩ সাালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে তিনি এ প্রকল্পের গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য হয়ে ৪ হাজার ৮শ’ টাকা সঞ্চয় জমা দেন। তার জমা সঞ্চয়ের বিপরীতে উৎসব বোনাস বাবদ আরও ৪ হাজর ৮শ’ টাকা পান তিনি। নাজমা বেগম বাড়ৈইপাড়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতি থেকে প্রথম দফায় ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এবং নিজের থেকে আরও ১৫ হাজার টাকা নিয়ে একটি গরু কিনেন। ১ বছর পর গরুটি বাচ্চা দিলে প্রতিদিন দুধ বিক্রি সেই টাকা দিয়ে গরুর জন্য খাবার ও অন্যান্য মালামাল কিনে সব খরচ বাদে প্রতিমাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা আয় হয়। এভাবেই তার আয়ের পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলে সংসার খরচ মিটিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করে দ্বিতীয় দফা একই সমিতি থেকে আরও ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন, ৩য় দফায় ৩০ হাজার টাকা, ৪র্থ দফায় ৪০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। এখন তার গরুর সংখ্যা ১০ টি এবং প্রতিদিন ৭০-৮০ লিটার দুধ বিক্রি করে তার মাসে সব খরচ বাদে নাজমা বেগম জানায়, তার পরিবারের এখন সচ্ছলতা এসেছে। ছেলেমেয়েরা যাচ্ছেন স্কুলে, পরিবারের লোকজনের মুখেও ফুটেছে হাসি। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের গুতিয়াবো গ্রামের সদস্য রহিমা বেগম। তিনিও একইভাবে এ প্রকল্পের সমিতি থেকে প্রথম দফা ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাজার থেকে বাঁশ ক্রয় করে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে আজ সাবলম্বী। প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কুঠির শিল্পের কাজ শিখে তার পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। তিনি জানান, বাড়ি বাড়ি না ঘুরে, বিভিন্ন মিল কারখানায় চাকরি না করে নিজের ঘরে বসে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে ও তাদের কাছে থেকে প্রশিক্ষণসহ অন্যন্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে নিজেরাই গড়তে পারেন কারখানা। প্রতি মাসে বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে তিনি ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের ব্যয় মিটিয়ে আজ সাবলম্বী। নাজমা বেগমের এ কর্মকা- দেখে আশপাশের অনেক সদস্যই একটি বাড়ি একটি খামারের সদস্য হয়ে প্রকল্পের নিয়মকানুন মেনে করছেন ব্যবসা, সংসারে আনছেন সচ্ছলতা। জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার এই প্রকল্পের মোট সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৬শ’। যার মধ্যে পুরুষ ১ হাজার ২৯২, মহিলা ৩ হাজার ৩০৮ জন। মহিলা সদস্যের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে বর্তমানে রূপগঞ্জে সঞ্চয় জমার পরিমাণ দুই কোটি ১৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সরকার উৎসব বোনাস দিয়েছে দুই কোটি তিন লাখ টাকা। আবর্তক তহবিল প্রদান করেছে দুই কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ঋণ প্রদান করা হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ঋণ আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৭৬ পারসেন্ট। আর এসব প্রতিটি কর্মকা-ের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছেন রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম। ইউএনও জানায়, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি রূপগঞ্জের মডেল। তিনি দাবি করেন, এ প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং এর যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক। পাশাপাশি লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পসহ হাঁস মুরগির খামার বনায়ন কর্মসূচী ও মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রকল্পই সাড়া ফেলতে পেড়েছে মানুষের মাঝে। পাশাপাশি এলাকার লোকজনকে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে ও আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে রূপগঞ্জে এ প্রকল্পটি একটি মডেল। দিন দিন বাড়েছ এর পরিধি। ভবিষ্যতে এ প্রকল্প জনগণের মাঝে আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কাজ করছে প্রকল্পের কর্মকর্তারা। বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু হওয়ার পর এলাকার সুদী মহাজন, সুদের ব্যবসাসহ রক্ত চোষাদের অনৈতিক ব্যবসা এখন প্রায় বন্ধের পথে। পাশাপাশি বিভিন্ন সমিতির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের সুদে ঋণ নিয়ে অসহায় সম্বল হারানো থেকে নিস্তার পাচ্ছে জনগণ। তাই দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পটি। এ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক নামে আত্মপ্রকাশ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ২২ জুন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শুভ উদ্বোধন করেন। গত ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট অর্থমন্ত্রী অনলাইন রিয়েল টাইম কোর ব্যাংকিং রূপগঞ্জ শাখার উদ্বোধন করেন। বর্তমানে সারাদেশে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ৪৮৪টি শাখার কার্যক্রম চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজের হাতে গড়া পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যেটা শুধুমাত্র গরিব মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত। গরিব, অসহায়, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ, হতদরিদ্র, ভিক্ষুক, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্ত মহিলা, সহায় সম্বলহীন ব্যক্তি যাদের সহযোগিতা করার জন্য মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাদের কেউ ঋণ দেয় না তাদের এই ব্যাংক মাত্র ৫% ইন্টারেস্টে ৫ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে। এই ব্যাংক সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়াই মূলত এই ব্যাংকের কাজ। মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহাম্মেদ আলমাছ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গড়ে সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে প্রথমে অল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়। এখন এর উপকারিতা পেয়ে সদস্য সংখ্যা ১২’শতে দাঁড়িয়েছে। সামনে সদস্য সংখ্যা আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সকলের সহযোগিতা নিয়ে এ প্রকল্পকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। -মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ থেকে
×