ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ছোট দলের বড় নেতারা কী করবেন?

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৮ জুলাই ২০১৮

ছোট দলের বড় নেতারা  কী করবেন?

সেই ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেশের বামপন্থী দল ও নেতাদের সম্পর্কে একটি মুখরোচক গল্প বেশ শোনা যেত। ... কমিউনিস্ট মোর্চার পলিট ব্যুরোর মিটিং আহ্বান করা হয়েছে। কোথায় বসা যাবে? পুরনো ঢাকা সবচেয়ে সেফ এলাকা, ওখানে গোয়েন্দাদের নজর পড়বে না। মোর্চার একেক নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা-হুলিয়া রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের, কারও ষড়যন্ত্রের। অতএব সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। পুরনো ঢাকায় এক কর্মীর রিকশা মাপের রাস্তার পাশে বাড়ির একেবারে পেছনের কোণের একটি পরিত্যক্ত কক্ষে মিটিংয়ের ভেন্যু ঠিক করা হলো। কক্ষটির একটি মাত্র দরজা, কোন জানালা-ভেন্টিলেটার নেই। মিটিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তখন ‘পদ্মা মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা-ঢাকা ঢাকা’, ‘তুমি কে আমি কে- বাঙালী বাঙালী’-এসব স্লোগান তুলে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা রাতারাতি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। দেশব্যাপী মিছিল মিটিং চলছে। অপরদিকে মিলিটারি আইয়ুবের মিলিটারি সরকারের ধরপাকড়-নির্যাতন চলছে। অতএব, মিটিংটি দীর্ঘ হতে পারে এ জন্য, হুট করে যেমন শেখ মুজিবকে সমর্থনও দেয়া যাবে না আবার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধিতাও করা যাবে না। পুঙ্খানুপুঙ্ক রূপে বিশ্লেষণ করে তবেই মোর্চার Line of politics and action ঠিক করতে হবে। তাই অন্তত ৭ দিনের রসদ নিয়ে মিটিং ভেন্যুতে ঢুকতে হবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াও ৭ দিনের টিন-ভর্তি মুড়ি-বাতাসা-গুড় এবং পাতা-কেটলিসহ চা বানানোর সরঞ্জামাদি ভ্যান গাড়িতে করে নিয়ে জমা করা হলো। মিটিং শুরু হলো। একটি প্রশ্নে নেতারা একমত হলেন যে, এ মুহূর্তে চুপ থাকা যাবে না। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে হলেও পক্ষে হোক বিপক্ষে হোক ভূমিকা লাখতে হবে- এ ব্যাপারে সবাই একমত। গোল বাঁধল শেখ মুজিবের ৬ দফার স্বাধিকার আন্দোলন গ্রাম বাংলার কুঁড়ে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অথচ শেখ মুজিবও পাকিস্তানী মিলিটারি শাসক-শোষক গোষ্ঠীর মতোই প্রগতিশীল নয় (?) তাহলে কি দুইদিকেই গুলি চালাবে? এটা নিয়েই মূলত আলোচনা এগিয়ে চলল কিন্তু একমতে উপনীত হওয়া সম্ভব হলো না। এদিকে রসদও ফুরিয়ে গেছে। দেখা গেল ৭ দিন পর মোর্চার ৭ সদস্য একেকটি দল বানিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। এক অনুসন্ধানী রিপোর্টার তাদের প্রথম থেকে ফলো করে আসছিলেন। বৈঠক ভেঙ্গে যাবার পর এক নেতাকে ধরলেন, কিছু বলুন? কি সিদ্ধান্ত হলো? বাম নেতা জবাব দিলেন, বলা যাবে না কিছু। চারদিকে টিকটিকি (গোয়েন্দা)। গল্পটি সম্পূর্ণরূপে বানানো এবং প্রতীকী। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে বাম, মধ্যবাম রাজনীতি বিশ্লেষণে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বামদের বহুধা বিভক্তি আমাদের সমাজ, সমাজ বদল, অগ্রগতির যে ধারা চলছে তাকে স্লো করার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিন বদলের যে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে চলেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে বদলে দিয়েছেনও। বামরা এক থাকলে তা আরও আগেই আজকের অবস্থানে আসা যেত। কেননা, বামপন্থী নেতা-কর্মীদের দলীয় নীতি আদর্শের কারণেই সৎ থাকতে হয়- অন্তত সৎ থাকার ভান করতে হয়। sacrificing attitude আছে এমন ধারণা আমজনতার মধ্যে দিতে হয়। আজ যে একটি স্লোগান খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে- ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় সরকারেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি, বিরোধী দলেও থাকবে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি’ এ অবস্থায়ও খুব দ্রুত পৌঁছানো যেত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বড় দলের ছোট নেতা ছোট দলের বড় নেতা’ এমনি একটি প্রবচন প্রচলিত আছে। বক্তব্যের প্রথম অংশটি অর্থাৎ বড় দলের ছোট নেতাও একদিন বড় নেতা হবার সুযোগ রয়েছে কিন্তু ছোট দলের বড় নেতাদের বরাত খারাপ যে, বড় বড় নেতাই হোন না কেন দলহীন নেতৃত্ব গাছহীন পরগাছার মতো। ওপরে ওঠার যত চেষ্টাই করুক ততই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে। পড়তে বাধ্য। অবলম্বন ছাড়া কোন কিছুই টিকতে পারে না। রাজনৈতিক দলের অবলম্বন হলো জনগণ আর নেতার অবলম্বন হলো জনগণই তো অবশ্যই সেই সঙ্গে দল এবং সাংগঠনিক শক্তি। আমাদের দেশে ছোট দলের বড় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশের বিকল্প ধারার ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর খালেক্জুামান (তার নামের সঙ্গে পারিবারিক পদবী ছিল ‘ভূঞা’ তিনি এই ভূঞা পদবীটি ব্যবহার করেন না। ভালই করেছেন, ঐ পদবীধারী এক লোক ফরিদগঞ্জের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করে যা যা করে বেড়াচ্ছেন তাতে ফরিদগঞ্জের পরিচয় দিতেও আজকাল আত্মসম্মানে বাধে) নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর মান্না, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আবদুল কাদের সিদ্দিকী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী। এদের সঙ্গে আরেকটি দল আছে নাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি যার বর্তমান নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। এই দলটি মাঝারি, নেতাও তাই, এ দলের দেশব্যাপী কমবেশী অবস্থান রয়েছে। তবে সিদ্ধান্তহীনতা বা ভুল সিদ্ধান্ত দলটিকে ছোট দলের বড় নেতার কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে এ সত্য অনস্বীকার্য যে, এদের এক দু’জন ছাড়া আর সবার গৌরবময় অতীত রয়েছে, রয়েছে জাতির প্রতি অবদান। পথ ভুলরথ এবং ব্যক্তিত্বের অহমিকা তাদের রাজনীতি নিচের সিঁড়িতে এনে দাঁড় করিয়েছে। তারপরও তারা চাতক পাখির মতো আশাহীন নয়। আজ হোক কাল হোক এই প্রজন্মে না হোক পরবর্তী প্রজন্মে- একদিন সিঁকা ছিঁড়বেই। অনেক দিন জাতি এদের সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। জাতি সেবা চায়। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। কিন্তু কেন জানি সেবা দিতে চেয়েও দিতে পারছে না। আমরা যদি ড. কামাল হোসেনের দিকে তাকাই দেখব এই মানুষটি কক্ষচ্যুত। অথচ একদিন ছিল যখন এই মানুষটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের খুব কাছে উঠে আসেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ঐ বছরই ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন তৎকালীন মিলিটারি স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে এবং দল ও জাতির হাল ধরেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের মতো মানুষদের ধারণা ছিল শেখ হাসিনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করবেন। সুযোগও পেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে মিলিটারি জিয়া নিহত হবার পর ভাইস-প্রেসিডেন্ট জাস্টিস আবদুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট হন। তবে ভদ্রলোক বেশি দেরি না করে শিগগিরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন এবং শেখ হাসিনা দলীয় প্রার্থী হিসেবে ড. কামাল হোসেনকে মনোনয়ন দেন। দল শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তে খুব খুশি হয়। শেখ হাসিনা একটি মিনিবাস ভাড়া করে ড. কামাল হোসেন ও কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে দেশব্যাপী সফর করেন। ভোটে ড. কামাল হেরে যান। আমার মনে হয় ড. কামাল হোসেনের মনে তখন থেকে একটা সুপ্ত আকাক্সক্ষা জাগে যে, তিনি দলের প্রধান হবার যোগ্য এবং সভাপতির পদটি তারই প্রাপ্ত। তারপর পুরো একটানা ৯ বছর মিলিটারি এরশাদ ক্ষমতায় থাকেন। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক হয় এবং মিলিটারি শাসন হটিয়ে সিভিল গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। ড. কামাল প্রথমদিকে সক্রিয় থাকেন, গ্রেফতারও হন, তারপর দীর্ঘদিন মৌসুমী পাখির মতোই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার ওঠাবসা। ১৯৯০ সালে মিলিটারি এরশাদের পতনের পর ৯১-র জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে ড. কামাল শেখ হাসিনার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দল থেকে চলে যান এবং সেই থেকে বড় দলের ছোট নেতা হিসেবে রাজনীতিতে আছেন। সবচেয়ে ইন্টাররেস্টিং ব্যাপার হলো ড. কামাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিচিত কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী নেতা। তিনি কি করে যে তাদের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে রাজনীতিতে অবস্থান করছেন বা পাশাপাশি হাঁটছেন? আমি একে মনে করি কমিউনিস্ট মোর্চাও নয়, ডান মোর্চাও নয়। তবে কি? বাংলা ভাষায় এর যে প্রতিশব্দ তা উচ্চারণ করা ঠিক হবে না। তবে এটা ঠিক গণফোরামের মতো ডান এবং বাসদ-সিপিবি’র মতো বাম যখন হাতে হাত ধরে হাঁটতে পারে তখন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তি এক মঞ্চে ওঠা বা একই মিছিলে হাঁটাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হচ্ছে না। একইভাবে উল্লিখিত নেতাদেরও ভুলত্রুটি বাদ দিলে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলা যবে না। আসম আবদুর রব, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কাদের সিদ্দিকী, খালেকুজ্জামান- এরা রীতিমতো ষাটের দশকের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের পক্ষে জামায়াত-শিবিরসহ যুদ্ধাপরাধী বেষ্টিত বিএনপিকে সমর্থন করা বা এলায়েন্স করা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস করবেও না। অন্য যাদের নাম উল্লেখ করেছি তারা অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং কিছুটা অগ্রগামী। প্রগতিশীল বলা যাচ্ছে না কারণ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা সামাজিক শক্তির নির্বাচন বা শ্রমজীবী-কর্মজীবী শক্তির নির্বাচন হয়। ঐ সব নির্বাচনের সবটাতে বামপন্থীরা প্রার্থী দেন না। তাদের কেউ কোন প্রার্থীকে সমর্থন করেন কেউবা চুপ থাকেন। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা বইছে- একটি জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা অপরটি দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে খিছড়ি ধারা, যাতে রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধী যেমন আছে তেমনি দু’চারজন মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছে। তবে মূলধারার মতো প্রগতিশীল কেউ নেই। বাম মোর্চার জন্যে তথা প্রগতিশীলতার দাবিদারদের জন্য আজ অগ্নিপরীক্ষা। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে তারা কি করবেন? ঢাকা ॥ ২৬ জুলাই ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং সিনেট সদস্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×