ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিস্তি -মনির বেলাল

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ২৭ জুলাই ২০১৮

কিস্তি  -মনির বেলাল

মোড় ঘুরতেই বিশাল একটা বিলবোর্ড। বিলবোর্ডের শুভ ছায়াটুকু অবশ্য তাঁবুর মতো কালো-সবুজ পলিথিনে ঘেরা এই ঘরটির ওপর পড়েনি। ছায়াটি ঐ ছোট্ট ঘরটির পশ্চিম সীমান্তের শেষপ্রান্ত থেকে শুরু করে সাইকেল গ্যারেজের সীমানাও ছাড়িয়ে বড় তেঁতুলগাছটি ছুঁই ছুঁই করছে। ছোট্ট ঐ ঘরটির দরজার বাম পাশে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে সমানে গালিগালাজ করছে। তার পাশ দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুতের খুঁটির ছায়া। আরও দু’জন কম বয়সী মেয়ে সে ছায়ার আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তাকে সমর্থন করছে এমন মনে হচ্ছে না। তবে ঐ মেয়ে দুটোর পেছনে বসা মাঝ বয়সী একজন মহিলা সজনের শরীরকে ভাগ ভাগ করে তার সামনের বাটিতে রাখছে। আবার সে সঙ্গে দাঁড়ানো ঐ মেয়েটির দু’একটা কথায় সমর্থন দিচ্ছে। দাঁড়ানো মেয়েটি তার যে কথায় পেছন থেকে সমর্থন পাচ্ছে- সেটি আরও জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে। ঘরটির ভেতর থেকে তেমন কোন আওয়াজ বাইরে আসছে না। হয়তো মেয়েটির দু’একটা কথার উত্তর ভেতরে বসা ছেলেটিও দিচ্ছে- কিন্তু তা এতটাই দুর্বল কণ্ঠে- যা ঐ মেয়েটি অথবা তার ঠিক পেছনে বসা মেয়েটি ছাড়া আর কেউ শোনার যোগ্যতা রাখে না। ভেতরের মানুষটিকে ভাল মতো দেখাও যাচ্ছে না- শুধু বোঝা যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষ ভেতরে আছে। শহর জেগে উঠেছে। ছোট্ট এ ঘরটির পাশের চায়ের দোকানেও ঐ আকাশে জমা মেঘের মতো মানুষ জমছে; চা-পান-সিগারেট নিতে যতক্ষণ দেরি ওরা আবারও সরে যাচ্ছে। চলমান রিকশা থেকে ঐ দোতলা বাস পর্যন্ত সবার চোখ এখন হাতঘড়ি অথবা মোবাইল ফোনের দিকে। মাছ-মাংস হাঁটায় চিৎকার-চেচামেচি সবচেয়ে বেশি। আবার পাশের ফলের দোকানে একজন মানুষও দেখা যাচ্ছে না। এ সমস্ত ব্যস্ততার বাইরে দৃষ্টি সরিয়ে, নদী পাড়ের ঐ বালুঘাটের দিকে গেলেও মুক্ত বাতাসের সন্ধান পাওয়া যাবে না। ওখানেও বালুভর্তি ট্রাক আর মাথায় বালুর ডালি নিয়ে একদল মানুষের দৌড়াদৌড়ির দৃশ্যে চোখজোড়া আবারও অস্থির হয়ে উঠবে। এদের থেকে বেশ দূরে এদেরই দিকে তাকিয়ে বসে আছে মাজুল। সে বেশ আগ্রহের সঙ্গে মেয়েটির গালিগালাজ শুনছে। পাশের দোকানটির পরের দোকানটি থেকে ভেসে আসা বিকট শব্দের গানগুলো মাজুলের কান আর গালিগালাজের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে লম্বা কণ্ঠের মেয়েটির কথাগুলো সে বারবার শুনতে পাচ্ছে, যা জারি ঘর থাকি বালুঘাটের দিক যা। বাঘা, নন্দনগাছি, আড়ানি- আরও কত দ্যাশ থাকি মানুষ আসি, বালু বোয়া কাম করি ম্যাইগ-ছেলিক ভাত দিছে। আর তোর কাম জুটছে না। আমি মানুষের বাসাত কাম না করলে তোর কি হইতো রে জারি। রোদের ঝাঁঝালো আক্রমণ ফলের দোকানের গন্ধকে এদিকে তাড়িয়ে আনছে। মাজুলের নাকে তা ধাক্কা লাগলেও তার ভেতরে প্রবেশের অধিকার পাচ্ছে না। বেলা অনেক হয়েছে, এখন আর কাজ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবুও মাজুল বসে আছে, রোজ রোজ কাজে এসে যেখানে বসে থাকে ঠিক সেখানেই। তার বসার জায়গাটুকুতে রোদের পূর্ণ শক্তির আক্রমণ মাজুল বুঝতে পারছে। এর মধ্যে সামনে রাখা তার সাইকেলের চাকাটি আক্রান্ত। রোদের পরের টার্গেট হয়তো তার কোঁদালের হাতলটি। ফজরের আযানের পরপরই যখন সে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে আসে তখনও মাহাতাব রোডের পাথর বসানো কালো শরীর অল্পই দেখা যায়। মাজুলেরা দশ-বারোজন রোজ এক সঙ্গে আসে। কোনদিন একটু দেরি হলে বিনোদপুর বাজারে পৌঁছতেই ওদের পেছনে সূর্য ওঠে। আর যদি ঠিক সময়ে পৌঁছায় তাহলে নিয়মিতই তালাইমাড়িতে সূর্য ওঠে। মাজুলদের তুলনায় দূরের গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলো আরও দূরে যায়- ওরা কেউ বিন্দুর মোড় আবার কেউ কেউ লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত যায়। মাজুলেরা সহজে ওদিকে যায় না। ওরা তালাইমাড়িতেই বসে থাকে। সীমিত চোখ মেলে তাকায় এদিক ওদিক। কে কখন ডাক দেয়। একজন কেউ এলে নিজেদের সবজির দোকানের আলু-পটোলের মতো করে উঠে দাঁড়ায় দশ-বারোজন, যাকে যাকে দামে হয় ওরা নিয়ে যায়। হঠাৎ মাথার ওপর শাঁ শাঁ শব্দ শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাজুল দেখলো পূব আকাশে কালো কাকের দল কেবল আসছে। সে মনে মনে ভাবে ওদের হয়তো ক্ষুধা কম! আজ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন কাজ পেয়ে ওদের গন্তব্যে চলে গেছে আর কয়েকজন ফিরে গেছে বাড়ি। তারও ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। তবুও মধ্যে ছেড়া গামছাটা তার মাথার ওপর দিয়ে বন্ধ দোকানটির সামনে কেন সে বসে আছে, এখনও কোন কাজ পাবে এমন ভেবে নাকি বাড়ি ফেরার কোন রাস্তা নেই এ কারণে; তা উদ্ধার করা কঠিন। বেলঘরিয়া, কাটাখালী, কাপাশিয়া অথবা বেলপুকুর যেই পথ দিয়েই সে বাড়ি ফিরতে চাক- তার কোন উপায় নেই। ওসব মোড়ে মোড়ে দোকানদারেরাও তার ঘরের ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েগুলোর মতোই হা-করে বসে আছে। আসার সময় বেলঘরিয়ার মোড়ে একজন দোকানদার ধরেছিল। তাকে বিকেলে দেবে বলে এতদূর আসতে পেরেছে। কিন্তু সে বাড়ি যাবে কিভাবে? রাস্তায় দোকানদারেরা ধরবে তারপরও কোন মতে তাদের ফাঁকি ফুকি দিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পারলেও রক্ষা নেই, ঘরে একমুঠো চাল নেই। ছোট ছেলেটার গায়ে অল্প অল্প জ্বর। কাজে আসার সময় আয়েশার বলা ঐ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ডালি, কোঁদাল, বেড়ি সবকিছু গুছিয়ে সাইকেলে বেঁধে ফেলার পর সে পেটে বেশ ক্ষুধা অনুভব করলো। জিন্সের প্যান্ট কেটে বানানো ব্যাগে দুটো ভুট্টার আটার রুটি আর মসৃণ করে বাটা কাঁচা মরিচ বাধা আছে। মরিচের সঙ্গে মাখানো তেলগুলো মিনি পলিথিনে থাকার কারণে না শুকিয়ে গেলেও রুটি দুটো হয়তো এতোক্ষণে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। কয়েকদিন আগেও গম-ভুট্টা মেশানো আটার রুটি খেতো ওরা। অথচ দিন গেলেই কাজ-কামের অবস্থাও যেমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আবার গম-ভুট্টা মেশানো ঐ আটার দামকেও মাজুলেরা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। এখন ওরা শুধু ভুট্টার আটার রুটি খায়। তার পেটের ভেতরে আবারও চিন চিন করে উঠলো। কিন্তু কেন জানি কি ভেবে ওগুলোতে আর হাত দিলো না। কাটাখালি পার হয়ে পালপাড়ার ঢালানের কাছে এসে তার সাইকেলের চেইন পড়ে গেলো। তখন তার প্রচ- রাগ হলো। সাইকেলের সিটের ওপর থেকে নেমে তার রাগের মাত্রা চারপাশের রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। চেইন পড়েছে পেছনের চাকার তারপরও আবার ফ্রি-হুইলের পাশ দিয়ে অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। সাইকেল ঠেলে সামান্য সামনে নিয়ে একটা মাঝবয়সি পিঠালীগাছের নিচে বসে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর চেইনটি তুলতে পারলেও দু’হাতে কালো কালির কলঙ্ক লেগে গেলো। আবার সে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেছে। পেছনে থেকে একজন ডাক দিলো- মাজুল! মাজুলের ভেতরে ভয় হলো। এটা কোন মোড় নয়, তাহলে এখানে আবার কে তাকে ডাকছে? ভয়ে ভয়ে পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো ভয় নেই। নুরু, এই লোকটিও একজন দোকানদার, তবে এর কাছে মাজুলের কোন বাকি-বকেয়া নেই। কারণ নুরুর দোকানে চাল-ডাল, তেল অথবা আটা এসব কোন কিছু থাকে না। বিদ্যুতের তার, বাল্ব এসবের দোকান। হয়তো সে কারণেই মাজুলের এর দোকানে কোন বাকি নেই। মাজুলের বাড়িতে আবার ওসবের কোন ঝামেলা নেই। সন্ধ্যার পর যতক্ষণ তারা জেগে থাকে অথবা ফজরের আযানের আগে যখন আয়েশা রুটি বানাতে ওঠে, এ কাজগুলো কেরোসিনের তেলেই চলে। নুরু জিজ্ঞাসা করলো- কাম হলো না? মাজুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলো- না! গ্রামের দিক? আবারও প্রশ্ন করলো নুরু। গ্রামে যেই একটু আধটু কাম আছে তা ঐ শেখের গুষ্ঠির ওরে লোকেরেই হ’না। সব দিকই এরমই- এই ফকরুদ্দি কি আমারেও কিছু থু নাকি! দুকান-টুকানগিন ভাংগি এখিবারে ন্যাংটা করি ফ্যালাছ রে ভাই। এ যে এহুন গেছুন সার আনতে- আইউবের আমলের চাল-আটার লাইনের মুতোন সার লিয়ার লাগিও লাইন লিত হছে। লাভ খালি বিস্মিল্লাহ্ ডাল মেল আলার আর খবির হাজির-পঁচিশ ট্যাকার চিনি এহুন ষাট-বাষট্টি- চাল-ত্যালেরই কি অবস্থা! এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিলো নুরু। মাজুলও মাথা নেড়ে তার সমস্ত কথাগুলো স্বীকার করে নিলো এবং সে সঙ্গে মাজুল বলেই ফেললো- ঠিক আছ নুরু ভাই। এহুন বাড়িত যাই, রোদ তাতি যাছে। এবার নুরুও তাকে সমর্থন করে, ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বড় রাস্তাটির একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে গ্রামের মধ্যে নেমে গেলো। মাজুল আবারও চলতে শুরু করলো- কত রকমের কত কথা এই মুহূর্তে তার মনে আসছে, কার সঙ্গেই বা দেখা হয়, আর কিই বা সে বলে! এ সমস্ত ভাবনার ভেতরে খাবি খেতে খেতে সে বেলপুকুর পার হয়ে এলো। অথচ কেউ তার পথ আটকালো না। মোড় পার হওয়ার পর থেকে এ কথাটিই এখন তার মাথায় বেশি কাজ করছে। বাড়িতে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে তার মনে পড়লো আজ শুক্রবার। যে সময় সে মোড়টি পার হচ্ছিলো তখন হয়তো তার পথ আটকাতে পারে এমন দোকানদারেরা সবাই জুমআর নামাজে ছিল । তাই আজকের দিনটিও সে বেঁচে গেলো। সামনের এ আমবাগানটি পার হয়ে দুটো বাড়ির পরেই তার বাড়ি। আম বাগানের ভেতর থেকে দৌড়ে আসছে একটি ছোট্ট ছেলে। তার বয়স আট থেকে দশ। ছেলেটির চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ ¯পষ্ট। অথচ তার কথায় উপচে পড়ছে আনন্দের ঢেউ। সে বললো- আব্বা দেহেন, একজন হুন্ডা আলা লোক আপনেক কি সুন্দর সুন্দর ফুল আলা এই কাগজডা দি গেছে। মাজুল এক হাতে কার্ডটি, অন্য হাতে তার ছেলেকে তুলে নিয়ে সাইকেলের সিটের ওপর বসালো। কার্ড ওলটে-পালটে সে দেখতে লাগলো- প্রথমে কার্ড হাতে নিয়েই সে বুঝতে পেরেছে। এটা বুলেট ডাক্তারের দোকানের হালখাতার কার্ড। এ রকম কার্ড এর আগেও সে পেয়েছে। বুলেট ডাক্তার ভালো মানুষ বলেই আজও তার বাড়িতে তেড়ে আসে নি। চার বছর কেউ এতোগুলো টাকা ফেলে রাখে? পাড়ার একেবারে শেষ বাড়িটি মাজুলের। বাড়িটি ছোট হলেও চারপাশে বেড়ায় ঘেরা। তার গলির কাছে কখন চলে এসেছিলো মাজুল এতো সব ভাবনার মাঝে বুঝতে পারেনি। তার ছেলেই বললো, আব্বা নামায় দেন। সাইকেলের সিট থেকে ওকে নামিয়ে, একবারে চুপচাপ অনেকটা চোরের মতো আজও সে বাড়িতে ঢুকছে। এমন সময়ে আব্দুল খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ির ভেতরে থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। চাচা আসলে-? শুধু এ কথাটুকু সে উচ্চারণ করলো, কিন্তু তা খুব সহজে নয়। তার বড় মেয়েটিকেও বাড়ির ভেতরে দেখলো না; আয়েশাও অস্বাভাবিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, তার মুখে কোন কথা আসছে না, তবুও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, কাল কিস্তির দিন, তাই আব্দুলেক একটু ডাকিছুন। মাজুল যেন এতোক্ষণে জ্ঞান ফিরে পেলো। আগামীকাল কিস্তি দেয়ার দিন ছিল তাও তার মনে ছিল না। সে আয়েশার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে থাকলো নিজের হাতের মুঠোয়। তার চোখের কণায় জল জমা হচ্ছে।
×