ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

কবিতা ও কল্লোলিত জীবন

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ২৭ জুলাই ২০১৮

কবিতা ও কল্লোলিত জীবন

এমন সময় আসে যখন কবিতা ঐক্যবদ্ধ করে গোটা জাতিকে। ষাট দশকের কবি সারথীরা চল্লিশের দেশভাগ পরবর্তী বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্প্রীতি সঙ্কট ও পঞ্চাশের ভাষা, কল্লোলিত জীবন আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন অগ্রসর করে কবিতা চর্চায় ব্রতী হয়ে কবিতা শস্য-শ্যামল ও সুষমামন্ডিত করে তোলেন। এ সময় অগ্রযাত্রী মহাদেব সাহা সচেতনভাবে প্রেমিক ও দ্রোহী। কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক মানবিক সম্পর্ক তিনি প্রতিপাদ্য বিষয় করেছেন। কবিতা মহৎ শিল্প। এর মধ্যে উৎসারিত হয় জীবন বোধ, অভিজ্ঞতা ও হৃদস্পন্দন। বাংলা কবিতায় মহাদেব সাহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকে মহুমাত্রিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। মহাদেব সাহা সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিত্তি করে কবিতা রচনায় নিমগ্ন হয়ে ওঠেন। অস্তিত্ব চেতনা, শেকড় সংলগ্ন মমতা তার কবিতায় প্রযুক্ত হয়। প্রকৃতি, মানুষ ও মানবিকতার কথা দৃঢ় হয়ে ওঠা তার কবিতা পাঠককে আলোড়িত করে। প্রেম, রাজনীতি, মানুষ ঘিরে তার কবিতা আবর্তিত হয়েছে। নদী, মা, বৃক্ষ, পাখি, কল্লোলিত জীবন, জন্ম গ্রাম, মৃত্তিকা, মানুষ তার কবিতার বিষয় হয়ে উঠেছে। মেঘমল্লার দেশে যেখানে তার বেড়ে ওঠা, স্বপ্ন দেখা, জীবনের সুখ দুঃখকে আলিঙ্গন করা সেখানকার দৃশ্যমান সব বস্তুর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দ মহাদেব উপভোগ করেছেন। মহাদেব সাহার উল্লেখযোগ কাব্যগ্রন্থ: এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২), মানব এসেছি কাজে (১৯৭৩) চাই বিষ অমরতা (১৯৭৫) কী সুন্দর অন্ধ (১৯৭৮) মোতার পায়ের শব্দ (১৯৮২) ধুলোমাটির মানুষ (৯৮২) ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস (১৯৮৪) লাজুক লিরিক (১৯৮৪) আমি ছিন্নভিন্ন (১৯৮৬), মানুষ বড় ক্রন্দন জানে না (১৯৮৯) নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯) প্রথম পয়ার (১৯৯০), কোথা সে প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ (১৯৯০), প্রেমের কবিতা (১৯৯১), মহাদেব সাহার রাজনৈতিক বিতা (১৯৯১), অস্তমিত কালের গৌরব (১৯৯২), আমুল বদলে দাও আমার জীবন (১৯৯৩), কোথায় যাই কার কাছে যাই (১৯৯৪), কাব্য সমগ্র-৫। মহাদেবের কবিতায় প্রেম প্রধান বিষয়। এই গৃহ এই সন্ন্যাস, কাব্যগ্রন্থে তিনি গৃহের মধ্যে সন্ন্যাস জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। পরে প্রেম মুখরতায় মুগ্ধ তিনি বারবার দয়িতার কাছে ফিরে গিয়েছেন। প্রিয় স্বদেশ, প্রকৃতি, নারী, সংগ্রামী মানুষেরা তাকে প্রাণিত করেছে। যৌনতা কাতর তিনি নন, পবিত্র ভালোবাসা বিশুদ্ধতায় স্নাত তিনি রোমান্টিক ভাবনায় অবগাহিত হয়েছেন। বদলে যাওয়ার মন্ত্র যার আয়ত্ত তিনি ক্লেদকে ঝরে যেতে দেখেছেন। মিলন আকাক্সক্ষা ও বিরহ যাতনায় বিদ্ধ মহাদেব বারবার বলেছেন শাশ^ত প্রেমের কথা: তোমার বাড়ির ছাদে আমি কেন হইনি উদ্ভিদ হইনি ফুলের চারা, নেহাৎ মাটির কালো টব? দুই বেলা যত্নে তুমি জল দিতে কিংবা দিতে না, তবুও প্রসন্ন মেঘের ছায়া পাই হয়তো লাঞ্ছনা পাই, ভালো কেয়ারি পাই না, তবু সারাদিন তোমার বাতাস গায়ে লাগে গন্ধ লাগে, পাশে আছে ঝর্ণার আবেগ, মুদ্ধ সরোবর, দেহখানি বড়ো অধীর হয়েছে সন্ধ্যা হলে মাটির ভেতরে যাবে অনন্ত শিকড় এই শিশু গাছগুলিকে তোমার স্তন্য দিতে পারো হয়তো পারো দু’ফোঁটা চোখের জল আঁচলে মোছাতে পারো উদ্ভিদের মুখ; তুমিই মেঘের মতো দিতে পারো এই বৃষ্টি ধারা তোমার বাড়ির ছাদে চারাগাছ, শ্যামল উদ্ভিদ (তোমার বাড়ির ছাদে : প্রকৃত প্রেমের কবিতা) মানব এসেছি কাছে কাব্যগন্থ থেকে তার সৌন্দর্য অন্বেষণ আত্মিক হয়ে ওঠে। তিনিও প্রেমিকাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। সর্বগ্রাসী প্রেম তাকে স্মৃতি ভারাতুর করে তুলেছে। নারীর প্রতি পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণে তিনি সমর্পিত হয়েছেন। অভিমান, ব্যাকুলতা, সান্নিধ্য পিপাসা তাকে গ্রাস করেছে। মহাদেব প্রেমিক। দীর্ঘশ্বাস, ব্যাকুলতা, নিভৃতে অশ্রুপাত, স্মৃতি তার প্রেমিক সত্তার অনিঃশেষ অংশ। আবেগ কবিতার শক্তি। এই আবেগের ভেলায় ভেসে তিনি বাতাসে সুগন্ধী রুসাল উড়িয়ে দিয়েছেন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে তার লেখা চিঠি প্রেমিকাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। বাংলার এক প্রেমিক অবুঝ বালকের মতো আবেগাক্রান্ত হয়ে হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা আকুতি যেন প্রকাশ করেছেন। আঙুলের মিহিন সেলাইয়ে ভুল বানানে লেখা প্রিয়কে শাড়ির মতো অক্ষরের পাড় বোনা চিঠি কবি পাঠাতে বলেছেন। ‘কিছুদিন শোকে ছিলাম, মোহে ছিলাম।’ সংসার, মমতা, আকর্ষণ ঘিরেই মাহদেবের প্রদক্ষিণ। তিনি নারী আশ্রয়ে শান্তি আর স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। তার মানস প্রতীমা সব প্রেমিকের আরাধ্য হয়ে যায় : করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও আঙুলের মিহিন সেলাই ভুলবানানে লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো অক্ষরের পাড় বোনা একখানি চিঠি চুলের মতন কোন চিহ্ন দিও বিষ্ময় বোঝাতে যদি চাও সমুদ্র বোঝাতে চাও মেঘ চাও, ফুল পাখি, সবুজ পাহাড়, বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দাও। আজও তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি আসবেন অচেনা রাজার লোক তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ............................................. কিছু লেখার নেই, তবু লিখো একটি পাখির শিস একটি ফুলের ছোট নাম, টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে হয়তো পাওনি খুঁজে সেই সব চুপচাপ কোন দুপুর বেলার গল্প খুব মেঘ করে এলে কখনো বড়ো একা লাগে তাই লিখো করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি (চিঠি দিও) তার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। কবিতার নির্মিতি, বিষয় বৈচিত্র্য, রূপকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে তিনি অন্য কবিদের থেকে ভিন্ন মেজাজের। কবিতায় লাবণ্য, প্রণয়, প্রেম, দেশ-সমকাল, আনন্দ-বেদনার প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয়। তার কবিতা পঠককে কবিতা অনুরাগী করে তোলে। তার কবিতা যেমন সমকালীনতা, রাজনীতি, প্রেম, বিরহ বেদনায় আকীর্ণ তেমনি এক মানবীর খুঁজে ফেরায় মগ্ন। মহাদেব সাহার কবিতার মধ্যে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, ফুলের সৌরভ, মাটির স্পর্শ লেগে থাকে। স্বাভাবিকভাবে তিনি উচ্চারণ করেন : আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন শুদ্ধ হয় জীবন/ তখন ভাঙাঘর আবার জোড়া লাগে/ শিশুদের কচি মুখের ঘ্রাণে বাতাস ভরে যায়। আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন শান্তি আন্দোলন শুরু করে/ ....... আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন পৃথিবীতে সব যুদ্ধ থেমে যায় ....... বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্যে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেয় সব দম্পতি/ মা শিশুর গালে চুমু খায়/ ব্যর্থ প্রেমিক প্রেমিকারা আবার ঘর বাঁধে/ নবজাতকের কান্নায় ভরে ওঠে পৃথিবী/ আমি যখন বলি ভালোবাসি। নারী ও নিসর্গ মহাদেব সাহার কবিতায় একীভূত হয়ে যায়। নারী ও নিসর্গ প্রেমিক শুধুমাত্র সান্নিধ্য ব্যাকুলতা নিয়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রকৃতি তাঁর দুঃখ ভোলায়, নারীও তার স্পর্শে উজ্জীবিত করে। বেঁচে থাকার অর্থময়তা খ্ুঁজে ফিরে মহাদেব সময়কে দ্রুত চলে যেতে দেখেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় টিনের চালের বৃষ্টির নৃত্য, ঘুঘুর ডাক, কল্লোলিত জীবন, দিনরাত্রি, দুঃখ-ভালোবাসা, বিরহ এবং প্রিয় মুখ। ভেতরে থাকে আর্তি: তুমি কোথাও আর খুঁজে পাবে না টিনের চালে বৃষ্টির নৃত্য মন উদাস করার ঘুঘুর ডাক খুঁজে পাবে না তোমায় সেই কল্লোলিত জীবন, নেই আলুলায়িত দিনরাত্রি তুমি কোথাও আজ খুঁজে পাবে না তোমার সেই সুখ সেই দুঃখ, সেই ভালোবাসা, বিরহ (কোথাও আর খুঁজে পাবে না) মহাদেব সাহার কবিতাসমূহ আলোচনা করলে দেখা যায় প্রতিটি কবিতা নতুন স্বর, বক্তব্য ও উপমার ওপর ভিত্তি করে রচিত। পরম্পরার মধ্যে থেকে পৃথক উপলব্ধি ধারণ করে এক অভিন্ন সেতু রচনা করে তিনি পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। মনে হয় তিনি নিজেকে উজাড় ও নিঃশেষ করে উন্মোচিত করেছেন কবিতার অবয়ব। একজন প্রতœতত্ত্ববিদ যেমন খুঁজে ফেরেন মাটির গভীরে সম্পদ তেমনি মহাদেব হৃদয়ের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন আলো-অন্ধকার, তুষ্ণা, বিপন্নতা, দুঃসহ একাকীত্ব ও অসহায় জীবনের বহু অধ্যায়। পতন ও পরাজয় ভেঙে আশা ও স্বপ্নকে ধারণ করেছেন বলেই তার কবিতা আধাত্মিক ও জাগতিক : সুন্দরীরা একটি বেশি কোলাহল করে প্রায়শঃ ভুলে যায় মাঝে মাঝে মৌন থাকা ভালো হাঁটার চেয়ে ক্যাট ওয়াক তাদের অধিক পছন্দ মোটেও ভাবে না তারা কথার আগেই এত হাসা দরকার নেই তারা যে সুন্দর একটি মুহূর্ত সুন্দরীরা ভুলতে পারে না। এতো বেশি প্রগলভ হওয়ার চেয়ে কখনো কখনো স্তব্ধতা যে ভালো তারা তা বোঝে না। .................................................. কিন্তু সুন্দরীরা কেউ কেউ বিজ্ঞাপনই বেশি ভালোবাসে। (সুন্দরীরা একটি বেশি কোলাহল করে) পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পরিবর্তন মহাদেব সাহাকে আলোড়িত করেছে। সামরিক বাহিনীর পথভ্রষ্ট কিছু সদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। মহাদেব সাহা রচনা করেন কবিতা ‘কফিন কাহিনী’ ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’, ‘তোমার হত্যকারী’ শীর্ষক কবিতা। এইসব কবিতায় পিতাকে হারানো সন্তানের মর্ম যাতনা, প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও অক্ষমতার কথা উঠে এসেছে। তাইতো আমরা শুনিঃ আমার অক্ষমতাই রাসেলের হত্যাকারী, সুলতানার ঘাতক/ আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার কোমলতা/ আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি/ আমার কাপুরুষতাই তোমার হত্যাকারী। (তোমার হত্যাকারী) মহাদেব সাহার ‘আমার মুজিব’ গ্রন্থে গদ্যপদ্যে বিধৃত হয়েছে এক মহানায়কের জীবন ইতিহাস, বাংলার জীবনচিত্র, মুজিবের আত্মত্যাগ ও কবির শোকগাঁথা। দেশপ্রেম, ভোরের প্রসঙ্গ, কফিন কাহিনী, অন্ধ, আলস্যপ্রহর, আরো একজন, আমি কি বলতে পেরেছিলাম, মুজিব হত্যার বিচার চাই, আমার সোনার বাংলা, তোমার বাড়ি, আবার আসিব ফিরে, তোমার হত্যাকারী প্রভৃতি কবিতা স্মৃতি ভারাতুর ও অশ্রুময়। মহাদেব সাহার কবিতায় আনন্দধ্বনি, আর্তি ও স্বপ্ন জাগরুক হয়ে আছে। তিনি সমকালীন বাংলা কবিতায় সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন। মানবিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের বহুমাত্রিক দিক বিশ্লেষণ করে তিনি যে সব কবিতা রচনা করেছেন তা পাঠকপ্রিয় ও গ্রহণীয়। কবি মহাদেব সাহা বক্তব্য ও উপমা উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে কবিতাকে আধুনিক ও শিল্পোত্তীর্ণ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর কবিতার বহুল পাঠ ও গবেষণার দাবি রাখে। তিনি আধুনিক যুগযন্ত্রণাকেও ধারণ করে কবিতাকে শিল্পসমৃদ্ধ করে তুলেছেন।
×