ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মঈন মুনতাসীর

ক্রন্দনে ভরা জীবন...

প্রকাশিত: ০৮:২২, ২৭ জুলাই ২০১৮

ক্রন্দনে ভরা জীবন...

মহাজাগতিক পরিক্রমায় ঘূর্ণায়মান চক্রে মহাকালের নিমজ্জনে ঈশ্বরের চোখ হতে যে সকল শিল্প-স্রষ্টার জন্ম, শহীদ কাদরী তাঁদের মধ্যে প্রথমসারির কাব্য-নির্মাতা। প্রবল কাব্য-শক্তি তাঁকে প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক (প্রকৃতপক্ষে-নিয়মবর্জিত) সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্রনীতিতে অবিশ্বাস জন্মাতে শিখেয়েছে। যেখানে গণতন্ত্র (বিশুদ্ধ স্বৈরতন্ত্র), রাজতন্ত্র (দানবের রাজত্ব), আদর্শবাদ (অনাদর্শের চূড়া), স্বৈরতন্ত্র (লালারিত জিহ্বার পিপাসা) মানুষকে বানিয়েছে শুয়োরের মতো কাদা-জলের প্রত্যাশী, রাষ্ট্রকে বানিয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাক্ষেত্র। সেখানে শহীদ কাদরীর নিদিষ্ট কোনো ধর্ম-দর্শনে আস্থা নেই; যথারীতি আদর্শবাদ বলতে কোনো মতবাদ দ্বারা তিনি তাড়িত নন। কালের যন্ত্রণা, দহন, জবরদস্তি তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই শহীদ কাদরীর কবিতায় সার্থকভাবে প্রয়োগ হয়েছে ‘ঘবমধঃরারংস’ বা (নেতিবাদ নয়), ‘নষ্টবাদ’ আর ‘ওমহড়ৎরংস’ বা ‘অগ্রাহ্যবাদ’। ‘নষ্টবাদ’ হলো সেই মতবাদ, যেখানে ব্যক্তি- সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিশ্বাসের নষ্ট ঠেকাতে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন বা ব্যর্থ হন। ধীরে ধীরে নষ্ট প্রাধান্য বিস্তার করে ব্যক্তির মূল্যবোধ ও আদর্শ খেয়ে ফেলে। নষ্টের দায় ব্যক্তি এড়াতে পারেন না, ফলে ব্যক্তি নিজেই নষ্ট হতে আপত্তি করেন না। যেখানে ব্যক্তির স্বপ্ন একগুঁয়ে, দৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন, পথচলা আদর্শহীন। নরকেই খোঁজেন চিরন্তন সুখ। ‘ওমহড়ৎরংস’ বা ‘অগ্রাহ্যবাদ’ হলো- যেখানে ব্যক্তি সচেতনভাবে সুন্দরকে আগ্রহ্য করেন। যেমন- যার শরীরে সব চামড়া পুড়ে গেছে সে বিশ্বাস করতে পারে না চামড়ার ভেতরে বিরাট শরীরটা এখনো অক্ষত। কিংবা যার ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে সে বিশ্বাস করতে পারে না যে- ব্রেন ছাড়া শরীরের আর সব সুস্থ। তাই অগ্রাহ্যবাদিরা আত্মহননে মনোযোগ দেয় অনন্দচিত্তে। এটা বলা যেতে পারে যে, ডানাওয়ালা পিঁপড়া কিংবা উঁইপোকা আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটি ডানা পুড়ে যাওয়ার পর আবার আলোতে লাফিয়ে পড়ে আনন্দ পায়, মৃত্যু হয়। সত্যি হয়তো এই আলোর (মিথ্যা কিংবা কুহক) প্রভাব এতোটাই যে, তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই তারা অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করে। ‘নরক তো পিতার শিশ্ন, মায়ের জরায়ু নরকেই পেতে চাই দীর্ঘ পরমায়ু।’ -(চাই দীর্ঘ পরমায়ু) শীতার্ত রাতের প্রহরী, গুমোট ভ্যাপসা নিশীথের সহচর, ইলশেগুড়ি কিংবা বর্ষণমুখর রজনীর ফেরারী কবি, রাত্রিকে করেছেন বেদনা সংরক্ষণের হিমাগার। বিনিদ্র নিশি কেটেছে তাঁর ফুটপাথে, চায়ের দোকানে, বিউটি বোর্ডিং, রেক্স কিংবা ইন্টারকন্টিন্যান্টালে। বিদগ্ধ নগরীর ধমনীতে ধমনীতে ঘুরে ঘুরে লিখেছেন সংঘাতময় আত্মহননশীল সময়ের প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদন মুখরোচক নয়, পরম সত্য বয়ান। তাঁর হাতে সত্য ও ন্যায়ের তুলাদ- নেই অথচ কাব্য সুষমার সম্মোহনী প্রলয়ে উবে যায় কপট-মিথ্যার পলাতক শেকড়। আঁধারেই গেয়ে চলেছেন আঁধার-বিনাশী গান, এই বিনাশের সাধনা গোপন, নিভৃতে বয়ে চলা ফল্গু নদীর ধারার মতো অন্তঃসলীলা। শহীদ কাদরী এসে দাঁড়ালেন ধ্বংসের দোর-গোড়ায়, সামনে দিগন্ত প্রসারী ধ্বংস-সম্ভার। যেখানে বিশ্বাসে অবিচল থাকা অসম্ভব, মৃতে জীবন দান করার প্রচেষ্টা বৃথা! তবে তিনি জঙ্গল ঠেলে, ধ্বংসলীলার বিশালাক্ষীর ক্রোধ ঠেলে দাঁড়াতে চেয়েছেন অতি সাধারণ মানুষের বহমান নান্দনিক জীবনশৈলীতে। অবগাহন করতে চেয়েছেন নিসর্গের অবারিত স্বপ্নের মোহনার। রূপালি জোছনা-¯œানে যেনো ধুয়ে যায় শহুরে গ্লানি! কবি অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে পূর্ণ সুদূরের পিয়াসী। পরোক্ষে কবির প্রয়াস সেই মানুষের অনুসন্ধান, যে পাখিদের জন্য নীড় বেঁধে দেবে, নদীর প্রবহমান জীবন ফিরিয়ে দেবে, ফুলের বাগানে দৈত্যের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করবে। যার পদধ্বনিতে ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে শহর হবে চিরহরিৎ। গভীরচিত্তের এ কবি ধূলিসাৎ জীবনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন, যেনো ফেরত আনতে পারি কাল্পনিক দেবতার পায়ে জলাঞ্জলি দেয়া মহার্ঘ্য আমাদের! তিনি মানুষের জন্য গড়তে চান একই ছাউনির নিচে সম্পৃতির বিরাট বসতি। কিন্তু দুঃসময় এ, লাশের বহর এই জনপদের প্রান্তরে-প্রান্তরে, শোকের মাতম লেগেছে নৌকোর পালে। অসংখ্য মৃত্যু কবিকে টলাতে পারেনি, মোহগ্রস্থ করতে পারেনি অবিনশ্বর কোনো জগতের টানে। কিন্তু, এ কি জীবন? কবি তো অনুল্লিখিত মনলৌকিক জগৎ ও জীবনের স্রষ্টা, অবশেষে একটি মরা শালিক সারাদিন তাঁর পিছু ছাড়েনি। কেনো এই বিষাদময় মুগ্ধ ক্রন্দন! অগণিত মৃত্যুর ফোয়ারা কি আমাদের দেশে এলো মরা শালিকের ছদ্মবেশে? ‘একটা মরা শালিক/আমার ওপর এমন দারুণ আধিপত্য/বিস্তার করবে কেন?’ - (একটা মরা শালিক) বাগ-বৈদগ্ধ্য শব্দের যথার্থ সম্মিলন ঘটে শহীদ কাদরীর কবিতায়। অর্থের অব্যর্থ লক্ষ্যমাত্রা অধিক মর্মভেদী। তাঁর কবিতার গাঁথুনি সেই সুন্দরী নর্তকীর মতো, যে জলসাঘরে ঢুকেই অলংকার খুলেছে, যার নিরাভরন অঙ্গের ঘ্রাণে মাদকাসক্ত হয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে সুদেহী সম্রাট। উপমা প্রয়োগে সাবলীল অথচ ব্যতিক্রমী কল্পলোক। প্রতিটি পঙ্ক্তি একটি শীতের তীর্যক সূর্য-রশ্মির ন্যায় কোমল অথচ ধারালো। ‘তুমি অপরাধী-/মানুষ মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে।’ - (আজ সারাদিন) অশরীরী আতঙ্কের শরীর নির্মাণ করেছেন যেনো মধ্যযুগীয় কোনো এক পাল মৃত্তিকা শিল্পীর হাতে গড়া কারুকার্যময় মাটির বৌদ্ধ মূর্তির মতো ধ্যানরত গৌতমের আবক্ষ। নিরপরাধ কবি ঘাতকের আস্তানায় কখনো যাননি, রাজপথে টেনে ধরেননি কোনো সুডৌল স্কন্ধবিশিষ্ট রূপসী যুবতীর গোলাপি রঙের ওড়না। অথচ, কীসের আতঙ্ক বিরাজ করছে চেতনা-প্রবাহে। প্রকৃতি কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে এই অনভিপ্রেত ঘটমান বর্তমান থেকে? কেনো একজোড়া শালিক গোয়েন্দার মতো সারাদিন কবির পিছে ঘুরছে? ‘যেন এভিনিউ পার হয়ে নির্জন সড়কে/পা রাখলেই আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে ঠিক।’ - (আজ সারাদিন) ষাটের দশক, সে তো অস্থির সময়ের দিনলিপি। আইয়ুব খানের শাসনামল, বিশ শতকের শেষার্ধে এ যেনো আশাহত পৃথিবীর নাভির্শ¦াস! যেখানে ব্যক্তি মানুষ উদ্বাস্তুর মতো জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে হতাশায়! মুক্তির পথ এখানে রুদ্ধ, সীমাহীন স্বপ্নের কথা বলা বাহুল্য-দোষ! চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে দেখলাম সেখানে কৃত্রিমতা। যেখানে- ‘বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো/আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত’ - (আজ সারাদিন) শহীদ কাদরী বিহীন ঢাকা অভিশাপ্ত ব্যাবেলিয়ন, গোটা পৃথিবী দোজখের দোনলা কম্পাস। চা-বিহীন সকাল, রসহীন মধাহ্ন, স্যাঁতসেঁতে অপরাহ্ণ, ম্লান সায়াহ্ন! প্রেম ও উপলব্ধিহীন ফুটপাথ! শুধু ব্যস্ততা বেড়েছে আমাদের, সময়ের অভাবে কবির মতো গুণবান স্বজন হচ্ছে বিমুখ! যেখানে ‘নির্গুণ স্বজন শ্রেয়/ পরঃ পরঃ সদা’ (‘মেঘনাদবধ কাব্য’ - মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। কবিতা আমাদের দিকেই আসতে চায়। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতা আমাদের বানিয়েছে সেলাই মেশিনের চাকার মতো ঘড়ঘড়। আমরা বেশি ব্যস্ত। কিন্তু- ‘দীর্ঘ অপেক্ষার প্রেমিকের হাত ব্রেসিয়ারের ভেতর এ্যাতো ব্যস্ত নয়,’ - (কেন যেতে চাই) ষাটের দশকের অস্থির রাজনীতির প্রলয়ংকরী ঘূর্ণি এসে লাগে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। জনতার স্তব্ধতা আর চাঁপা কান্নার উৎরোল বের হতে লাগলো কণ্ঠনালী ছিঁড়ে। ‘প্রলয়ে যেমতি বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!’ - (‘মেঘনাদবধ কাব্য’ -মাইকেল মধুসূদন দত্ত) বাংলার প্রতিটি জনপদ গুমরে কাঁদে। ক্লান্তি, অসহযোগিতা, আত্মহনন আর মৃত্যুকে ভালোবাসা ছাড়া নিরূপায় মানুষ। সেই কালিক বিমর্ষ স্রোতে শহীদ কাদরীর কবিতা সালভাদর দালির চিত্রকর্মের মতো বিগলিত, প্রাচীন গুহাচিত্রের মতো সদা জীবন্ত। যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় সংশয়বাদ, নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্বহীন জীবন-প্রণালী, হতাশা, অনাস্থা, ক্লেদ, পাথুরে বেদনা, গ্লানি, নৈরাশ্য, যন্ত্রণার মতো অবসাদের ঢেউ লাগে ষাটের দশকের কবিদের হৃদয়ে। যেখানে ‘স্যাড জেনারেশন’ বলছে- `But we are helpless, simply undone. We have no other alternative except SELF DESTRUCTION. Death is our darling, but no those bloody ladies who are loitering before our eyes. We are for no time, interested in polities and newspapers. Then, what do we want? NOTHING, NOTHING, we want nothing from our bloody society, We are exhausted, annoyed, tired and sad.` যুদ্ধ হয়তো থেমে যাবে, হয়তো কাক্সিক্ষত শিকার মিলবে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে শান্তির বার্তা বয়ে যাবে (আপাত), হয়তো এক পসরা মেয়েলি গান ভিজিয়ে দেবে অন্তঃকরণ! দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রেমিক মিলতে পারে প্রেমিকার সঙ্গে আদিম কিংবা আদর্শবাদী প্রশান্তির জন্য। কিন্তু কীসের অবসাদ, কীসের অপ্রাপ্তি জন্মেছে আকাক্সিক্ষত প্রিয়ার সঙ্গ পেয়েও! নাকি প্রেমিকা শুধু শরীর সর্বস্ব, হৃদয়ের ব্যাপ্তি এতোটাই সংকীর্ণ যে শান্তি সেখানে গলা বাড়াতে পারে না। নাকি মিলনে দংশন শুধু, বিষম পিরিতি জ্বালা! নাকি প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনে কবির আস্থা নেই, আছে অভিশাপ! ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সঙ্গে ঠিক-ই কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...’ -(সঙ্গতি) কাল্পনিক কিংবা অলৌকিক সত্তার প্রতি প্রবল অনীহা কবির। প্রত্যক্ষ বা বাস্তব তাঁকে জ্ঞান দিয়েছে অনুদান। চৈতন্য তাই শিরা-ওঠা বৃদ্ধের হাতের মতো ছুঁয়ে দেখেছে সব। ‘শিশুর কোমল ত্বক, নধর ছাগল ছানা, নিস্তল নারী ও গোলাপের চারা, অকালে নিঃস্পন্দ সব বন্ধুদের চোখ।’ নটরাজের মতো স্বাধীন সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন শহীদ কাদরী। সম্পূর্ণ রাজাধিরাজের মতো স্বায়ত্তশাসিত হৃদয় তাঁর। গোলাপ কিংবা রাঙা মেঘের স্বাস্থ্যের কাছে কখনো হননি নতজানু। কিন্তু স্থবির, নিঃস্পন্দ হৃদয় নিয়ে বসেছিলেন- ‘নর্তকীদের মোহন ঊরুর পরপারে।’ দূরপাল্লার কামান থেকে ছুটে যাওয়া গোলা দেখে ক্লান্ত দু’চোখ। তারপর কিছু মোহন দৃশ্য (আপাত) চোখ জুড়ায়। আগুন-রঙা-ফুল, ছয় ফুট উঁচু ঘাস, কয়েক দঙ্গল রাত-চরা পাখি আনন্দ দেয় (আপাত)। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে কি মুক্তি মিলবে আমাদের? কী দেবে এই দৃশ্য? ক্ষণকালীন মুগ্ধতা? তবু, টিকে থাক আদিমতা, টিকে থাক নিঃসঙ্গ চরাচর! ‘তবু থাক, দীর্ঘ আয়ু পাক হরিণের সঙ্গমখানি, রাজহাঁসটির একাকী ভ্রমণ।’ চারদিকে শান্তির গান বেঁজে চলেছে। অথচ, অশান্তির বজ্রপাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে মরছে হারু দত্তরা। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কালো টাকা ছাড়া এখন আর গোলাপও কেনা যায় না, যুদ্ধবিরতির সীমারেখা পার হলো সবাই, সংঘাতে ছড়িয়ে পড়ছে আপন পর। ‘তুমি গান গাইলে, আমাদের উঠোনের প্রাচীন গাছ ছুঁয়ে বিস্ফোরক ভরা তিনটি বিমান উড়ে গেল’ - (তুমি গান গাইলে) বিভীষিকাময় দিন এলো! এলো যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা! প্রতিদিন, প্রতিটি শহর-বন্দর পাড়াগাঁয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি। অথচ এই বিব্রত হাতের তালুতে এলো একটি গোলাপ। কে তার নিরাপত্তা দেবে? জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ? শত্রু আমার গর্দানের কাছে, শান দেয়া খাপ-খোলা তরবারী উঁচিয়ে রেখেছে। তাহলে কি জীবন রণাঙ্গন নয়? কোন গোপন ছাউনিতে রাখলে এই গোলাপ (স্বাধীনতা) নিরাপত্তা পাবে? ‘অনেক রক্ত আগুন পার হয়ে এসেছে এ গোলাপ আমার বিব্রত, প্রত্যহের কালো রণাঙ্গনে।’ তিরিশোত্তর, চল্লিশ ও পঞ্চাশের কবিদের কবিতার বিস্তীর্ণ ও সমৃদ্ধ দিগন্তে ষাটের কবিরা আনলো নতুন কাব্য ভাবনার অবিনাশী স্রোত। ষাটের কবিরা উপেক্ষা নয়, বরং অগ্রাহ্য করলো ধর্মবোধ ও নীতিবোধ। প্রথাগত প্রেম ও সংস্কারে তাঁদের ছিল উন্নাসিকতা। শেকড়ে গ্রন্থিত মাটি ও মানুষের সত্তার কাছে তাঁরা হলো অবনত। ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ভাব-ভাষার ‘নিঃসঙ্গ চেতনার নবরূপের কবি’ তকমা যাকে দেয়া যায় তিনি হলেন শহীদ কাদরী। ছিঁড়ে পড়া বন্ধন, ভেঙে পড়া সমাজ যেন সোজা হয়ে দাঁড়ায়, খুনির উদ্ধত সঙ্গীন যেনো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কাঁধে তিন তারা’র ক্যাপ্টেন যেনো চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন- ‘হ্যান্ডস আপ’ টলে পড়া গোলাপ দাঁড়িয়ে পড়ুক তার ঝাড়ে, হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাক ছুরি,’ - (কেন যেন বলছে) উদ্দেশ্যহীন, অবলম্বনহীন, বিষণ্ণতায় পর্যবসিত শহীদ কাদরীর ছিলেন অভিভাবকহীন (স্বাধীন)। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কবি। কারো হাতের খেলার পুতুল হতে রাজি ছিলেন না তিনি। কবি কারো নিতম্বশোভা নন, যা দেখে সাময়িক মুগ্ধতার স্বপ্নালোক থেকে অন্তত একবার ঘুরে আসবে ফুটপাথের দর্শক। নরক যাঁদের প্রত্যাশা তিনি তো নিজেকে ভালো মানুষের (তথাকথিত) আদলে বিবেচনা করতে নারাজ। তাই কবির অভিব্যক্তি- আমি নই কারো- “করতলগত পাথরখ- ছুঁড়ে দিলে কানা পুকুরে উবু হয়ে পড়ে থাকবোই আমি ভালো মানুষের মতো? - (আমি নই) পঞ্চাশ ষাটের দশকের আমেরিকান কবি Anne Sexton Silvia Plath - এর কবিতায় যেমন বিবৃতিময় আত্মস্বীকারোক্তিপ্রবণ কবিতা লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশে ষাটের দশকের কবিদের কবিতায় সমধর্মের পাশাপাশি প্রবল আত্মগ্লানিবোধ স্পষ্ট। নারীর দেহ বর্ণনায় নিঃসংকোচ ও অকৃত্রিম। তেমনি রাষ্ট্রনৈতিক অবক্ষয়ের ইশতেহার বর্ণনায় অনবদ্য বিষয় উপস্থাপন। কবি নিজের নাম স্বাক্ষর করেছেন অসংখ্য স্থানে, অগণিত বার। কোনারকে গেলে- ‘মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ কিন্নরীদের স্তন কিংবা বাহু পড়তো না বাদ কোনমতে’ - (অটোগ্রাফ দেয়ার আগে) কবি’র অটোগ্রাফে কোনো লাভ নেই- ‘এই নাম দেওলিয়া! তোমরা কি জানো না ব্যাঙ্কগুলো ভীষণ বিব্রত : নিয়মিত ফেরৎ পাঠাচ্ছে বারবার জলহীন নদীর রেখার মতো বিষণ্ণ স্বাক্ষরবাহী চেকগুলো আমার!’ -(অটোগ্রাফ দেয়ার আগে) ব্যাংকগুলো বিব্রত হচ্ছে কোনো। কবির স্বাক্ষর কি কবি নিজেই নকল করছেন নিজের অজান্তেই? স্বাক্ষরে বিষণ্ণতার ছাপ দেখে পুঁজিবাদী সভ্যতা কি তাঁকে বোঝা ভাবছে? নাকি কবি শুধু চেক পাঠাচ্ছেন- ব্যাংকে কবির অর্জন (সঞ্চিত) কিছুই নেই! ফরাসি প্রতীকবাদী কবি বোদলেয়ারের কবিতায় প্রতীক নির্মাণের সাফল্যের মতো প্রতীক নির্মাণে শহীদ কাদরী অনন্য সাধারণ! আবেগহীন কবিতা ও নির্মেদ নাগরিক বাস্তবতার রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। পাথর তোমার ভেতরেও উদ্ধৃত্ত রয়েছে আর এক নৃত্য’ -(নর্তক) মৃত্যুপুরী এ শহর! যে শহরের চাঁদ-জ্বলা বিহ্বল রাতের পিচে কবির পায়ের ছাপ এখনো উজ্জ্বল। সেখানে ‘একটি মাছের অবসান ঘটে চিকন বটিতে’। সে জনপদের ‘একটি নরম শিশু খরগোশের মাংস দেখে আহ্লাদে লাফায়’। যে প্রকৃতি মৃতে ডুবিয়েছে ঠোঁট, সেই রুগ্ন সময়ের চিত্র ফটোগ্রাফের মতোই বাঁধাই করে রেখেছেন তাঁর কবিতায়। ‘মৃতের চোখের কোটরের মধ্যে লাল ঠোঁট নিঃশব্দে, ডুবিয়ে বেসে আছে একটা সবুজ টিয়ে।’ -(কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না) এই দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে কবি পড়ে যান, আবার উঠে দাঁড়ান, আবার পড়ে যান। এই চড়াই-উৎরাই যেনো আমোঘ প্রত্যাশা হয়ে ধরা দেয়। তাঁর বাল্যের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলা টেনিস বলের মতো তরুণ খরগোশটা নিয়ে লোফালুফি করছে যারা- ‘তারা সব সারি সারি বল্লমের ধারালো ফলার মতো’ -(উত্থান) যান্ত্রিক সভ্যতার যাঁতাকালে পিষ্ট কবি এবার ছুটে যেতে চান নয়নাভিরাম গ্রাম-বাংলার নিসর্গে। তবে এটা চিরন্তন মুক্তি নয়। কারণ, তাঁকে নিশ্চিত আবার ফিরতে হবে এই যন্ত্রের ঘূর্ণির শহরে। চিরন্তন মুক্তি বলে কিছু নেই কবির বিশ্বাসে। কবির সালামগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে একজন সমরবিদ; প্রেমের মূল্য ধরে টান মারছে অন্তরঙ্গ বিজ্ঞানী; প্রাণ লোফালুফি করছে কয়েকজন সার্জেন্ট-মেজর। সুতরাং এই লোহা, তামা, পিতল ও পাথরের মধ্যে আর কতদিন? যদি এবার গ্রামে গিয়ে ট্রেন ভর্তি শিউলি ফুল নিয়ে আবার ফিরে আসেন ক্লান্তি ও অবসাদের শহরে- ‘হে লোহা, তামা, পিতল এবং পাথর তোমরা আমায় চিনতে পারবে তো হে!’ -(এবার আমি) শহীদ কাদরীর কবিতায় ‘যুদ্ধ, হত্যা, মারী, মড়ক, টুথব্রাশ, মাজন-এরা সব জীবনের জটিল কল্লোল হয়ে ওঠে,’। ‘নিজের মনুষ্য জন্মের জন্যে আর মনস্তাপ থাকে না’। তিনি পালাবদলের কবি। চতুমুর্খী যুদ্ধের দামামায় কবিতায় এনেছেন পালাবদল। ‘যুদ্ধতো বারবার কবিতায় পালাবদল ঘটায়’। এই সভ্যতা (বর্বরতা) সকল ধীমান (জ্ঞানী, অথচ নির্বোধ) প্রতিনিধিদের দখলে। ওরা যদি মরে যায় কারো কোনো ক্ষতি হবে না। তবে, ‘গোলাপ, টিয়ে এবং তাদের আত্মীয়স্বজন ঢের বেশি উপকার পাবে! -(এক চমৎকার রাত্রে) অস্তিত্বের সংকট, নগর-যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, টি এস এলিয়টের মতো দগ্ধ পোড়া জীবনের স্বরূপ আর নষ্টালজিয়া কবির কবিতায় প্রবল। ছদ্মবেশী কবি অবক্ষয় আর ক্ষত ভাষায় জুড়ে দিয়েছেন সমাসোক্তি ও অন্যাসক্ত অলংকার। যেনো কালো মেয়ের কালো চুলে লাল রঙের জরি-ফিতা। ‘হে আমার মোরগের চোখের মতন খুব ছেলেবেলা।’ চামেলীর ছদ্মবেশে কবি নগর যন্ত্রণা ছেড়ে যেতে চান সেই পল্লীগ্রামে। অরণ্য ফিরিয়ে নিতে চান কিন্তু নগরও ফিরিয়ে দিতে চান না! এখানে মাৎস্যন্যায়, এলো ফিরে মানুষের জয়গান (অভিশাপ), কবিও গাইতে চান সেই মানুষের জয়গান, যাদের ‘সব বিবাদ শেষে দো-নলা বন্দুক!’ ডাঙার অধিপত্য মানুষের, জলের অধিপত্য মাছের। ‘তবু বলি, মাছের মতন কোনদিন প্রেমিক হবে না এই আঁশহীন মানুষ’ -(মৎস্য বিষয়ক) কবি উপকূলবাসী নন, তাই চোখে আশ্চর্য নিরাপত্তা (নিরাপত্তাহীনতা)! আজীবন লোকালয় থেকে পালিয়ে নিসর্গে ধরা পড়তে চেয়েছেন। সেখানে নিসর্গ জেলের মতো গৌধূলি হাওয়া কিংবা জোছনার ফাঁদ পেতে রাখে। নিসর্গে পৌঁছানো কঠিন, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মৃত্যু উপত্যকা। সেখানে জীবিত মানুষের মুখগুলো মৃতের আদলে গড়া! প্রিয়তম রেস্তরাঁটি চূর্ণ-বিচূর্ণ’! ‘স্বজনের চেনা মুখগুলো ভাসছে লাশ হয়ে’! কবি কোথায় পালাবেন? নিসর্গে আশ্রয় আশাতীত! কবিতো ‘ফোবিয়া’ আক্রান্ত, চারপাশের সবকিছু তাঁর কাছে মনে হয় লাশ-মৃত্যু-চূর্ণ-ভাঙ্গুর। ‘হাতের মুঠোর মধ্যে ন্যাপথলিন লাশের চোখের মতো শাদা’ -(একটি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের জার্নাল) শহীদ কাদরীর চেতনার রং এতোটাই সবুজ যে তার রঙে পান্না সবুজ হয়েছে। শহীদ কাদরীর চেতনা ব্যতিক্রমী, দামী, একাকী, অটুট। ‘অথচ আমার চেতনার রঙে পান্না হয়ে ওঠে দারুণ সবুজ’ -(মানুষ, মানুষ) শহীদ কাদরীর ‘বোধ’ মধ্যযুগের কবিদের কবিতায় বেদনা বিহ্বল শূন্য মন্দির (হৃদয়) যেমন, ঠিক তেমন। আশ্বিন মাস এলো। ‘পুকুর পাড়ে ঝোঁপের ওপর আলোর হেলাফেলা; ছাদে-ছাদে বাতাসে ভাঙে রাঙা বৌ-এর খোঁপা’, ‘তরুণ হাতে বিলি করা নিষিদ্ধ সব ইশতেহারের মতো/ ব্যতিব্যস্ত মস্ত শহর জুড়ে’ আর- ‘আমার শূন্য হলো দিন কেন শূন্য হলো দিন? -(বোধ) কবি মাঝ নদীতেই পড়ে আছেন। কারণ, দুই তীরেই তাঁর প্রবল-টান। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য সারাজীবনে- ‘এমনি করেই ডাঙার ধার ঘেঁষে-ঘেঁষে আমার বসবাস কোনোদিনও হলো-না,’ -(দাঁড়াও আমি আসছি) ‘একটি উত্থান-পতনের গল্প’ কবিতায়- শহীদ কাদরী পিতার সঙ্গে নিজের তুলনামূলক অবস্থান নির্ণয়ের মধ্যে দিয়ে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। সেই পরিচয়ের ভাষা এবং উপস্থাপন ভঙ্গি অনেকটাই ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের ‘ওফবহঃরঃু ঈধৎফ’ বা ‘পরিচয়পত্র’ -এর মতো। একজন শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক পরবর্তীতে জাঁদরেল অফিসার পিতার নাম দীর্ঘ- খালেদ-ইবনে-আহমাদ কাদরী। ‘যেন দামেস্কে তৈরি কারুকাজ করা একটি বিশাল ভারী তরবারি’; অথবা ব্রিটিশ আমলের ‘ঝনঝন করে-ওঠা ধাতব ওভারব্রীজ’, উচ্চতা ছয় ফুট দুই ইঞ্চি, উন্নত নাসা, বর্ণ উজ্জ্বল, তুখোড় ইংরেজী জানা, স্বপ্নের ভেতর টাকা নিয়ে লাফালাফি খেলা মানুষ তিনি। আর কবির নাম হ্রস্ব : শহীদ কাদরী, ছোটো, বেঁটে, বেল্লিক, বেকুব, ৫ ফুট ৯ ইঞ্জি, নাক বোচা, অল্প-স্বল্প বাংলা জানা, রোদে-পোড়া, কালো, একে-ওকে চুম্বন ছুঁড়ে মারতে পারে, এখন কবিতা লেখে, স্বপ্নের ভেতর নক্ষত্র নিয়ে লোফালুফি করে। অগ্রাহ্যবাদী এই কবির কাছে সুন্দর উপেক্ষিত। যার নিজের পারঙ্গমতা দিয়ে সমাজের-রাষ্ট্রে কিংবা নিকট আত্মীয়ের কোনো উপকার নেই! ‘আমি বলি : এই স্বাস্থ্য আমার এবং এর ধার, ঠিক সেই ডাক্তারের মতো নিজের ব্যাধিগ্রস্ত আত্মীয়ের সুচিকিৎসা জানা নেই যার।’ নষ্টবাদী ও অগ্রাহ্যবাদী কবি শহীদ কাদরীর ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ কাব্যের পরতে পরতে পাথরের মতো জমাট বাঁধা ক্রন্দন। অভিশপ্ত হৃদয়, সমাজ-সংসার-ধর্ম, অভিশপ্ত মানবজমিন! স্বজনের লাশের স্তূপ হলো গলার হার। বিচার ব্যবস্থা বলে এখানে কিছু নেই, শাসন ব্যবস্থা হলো ক্ষমতাপিপাসুদের স্বার্থ চরিতার্থ করার ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’। ওরা টিকিয়ে রাখতে চায় আমার স্বজনের রোনাজারি! (সমাপ্ত)
×