ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সংরক্ষিত আসন ও নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ২৭ জুলাই ২০১৮

সংসদে সংরক্ষিত আসন ও নারীর ক্ষমতায়ন

এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (এএসবি) বিগত ৩০ জুন ২০১৮ তারিখে তাদের পঞ্চম মাসিক সভা উপলক্ষে গণতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমতা ও রাজনীতি বিষয়ক একটি বক্তৃতার আয়োজন করেছিল এবং এই আয়োজনে প্রবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতির বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা নাসরিন আখতার হোসেন। এই প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন বাদ দিলে ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচিত নারীর আসন সংখ্যা ২০ যা শতকরা হার ৬.৭ । এর সঙ্গে যদি সংরক্ষিত ৫০ নারী আসন যোগ হয় তা হলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭০ যা মোট ৩৫০টি আসনের মাত্র শতকরা হারে ২০ যা ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চৌদ্দতম জাতীয় নির্বাচনের আসন চিত্র। এই সংখ্যাটি নবম সংসদে ছিল ১৮.৬ শতাংশ এবং প্রথম জাতীয় সংসদে (১৯৭৩-৭৫) ছিল ৪.৮ শতাংশ। সময়ের আবর্তে সংরক্ষিত বনাম সরাসরি আসনে সংসদে নারীর প্রতিনিত্ব বেড়েছে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন নব্বইয়ের দশক থেকে নারী প্রধানমন্ত্রীরাই দেশ শাসন করে চলছে। তার পরও নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারী নেতৃত্ব দেশের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার গতি এত মন্থর কেন যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেত্রী, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, কৃষিমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পীকার মহিলা। এই বক্তৃতার আলোচনা পর্বে অনেকের মধ্যে একজন নারী নেতৃত্ব যিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সাবেক সভানেত্রী তথা এককালের ছাত্রনেত্রী প্রশ্ন তুলেন বাংলাদেশ যে গতিতে নারীর উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে চলছে তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। তার একটি মাত্র কারণ নেতৃত্ব তৈরির যে প্রক্রিয়া তা অনেকদিন যাবত ¯্রােত হীন নদীর মতো আবদ্ধ জলে মজে গেছে । তিন দশকের বেশি সময় ধরে ডাকসু নির্বাচন বন্ধ রয়েছে যাকে বলা হয় সুস্থ ধারার রাজনৈতীক নেতৃত্ব তৈরির করাখানা। বিষয়টি এখানেই শেষ নয় সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরগুলোর চিত্র একই রকম বিধায় নারী নেতৃত্ব তৈরির প্রশ্নই আসে না। এই আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে তুলনামূলক বিচারে এই জায়গাটিতে আমারা পিছিয়ে সত্যি কিন্তু সেটার উন্নতি কল্পে বাংলাদেশ সংসদে সূচনা লগ্নে থেকেই সংরক্ষিত নারী আসন প্রবর্তন হয় যা প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৭৩-৭৫) সময় ছিল ১৫ টি যা বর্তমানে দশম সংসদ নিবাচনে (২০১৪-২০১৮) রয়েছে ৫০টি। এই সংরক্ষিত আসন নিয়ে পক্ষের বিপক্ষের অনেক যুক্তি রয়েছে এবং বর্তমানে উদার অর্থনীতির যুগে কোন মানুষ সে নারী কিংবা পুরুষই হোক সংরক্ষিত হয়ে থাকতে চায় না আর নারীরা তো নয়ই। তারা নিজের যোগ্যতার বিচারে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হতে চায় সংরক্ষিত কোঠায় নয়। এটা মনে করা হয় একটি বৈষম্যমূলক আচরণ বিষেশত যারা সরাসরি নির্বাচিত জনগণের ভোট দ্বারা। আবার সংসদে আইন প্রণয়নের কথা বাদই দিলাম স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত মহিলারা যে জেলায় প্রতিনিধি সেখানে কোন উন্নয়ন কর্মকা- তাদের কোন প্রকার প্রাধান্য কিংবা ক্ষমতার প্রয়োগের সুযোগ খুবই সীমিত বিশেষত সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ছেয়ে। সংসদে বসে তারা কোন ফলদায়ক আলোচনা কিংবা মাসব্যাপী বাজেট সেসনের আলোচনা অংশ নেবে এমন তাদের অনেকেরই সক্ষমতা নেই। নারীর সংরক্ষিত আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক দলের আকারে ওপর অর্থ্যাৎ যে দলের প্রতিনিত্বি সংসদে যত বেশি তাদের সংরক্ষিত আস সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি এবং এই আসনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে আসে যেম পিতা, চাচা কিংবা মামা সংসদ সদস্য ছিল এমন একজনকে সেই পরিবার থেকে নির্বাচিত করা হয়। আবার যারা জেলা কিংবা মাঠ পর্যাযের জাতীয় রাজনৈতিক দলের মহিলা শাখার নেতৃত্বে থাকে তাদের মধ্যে থেকে সংরক্ষিত সে জেলার আসনে নির্বাচিত করে থাকে যাদের সংসদীয় কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে চলে। কেবল প্রতিনিধিত্ব করাই মূল বিষয় যা সমাজ, রাজনীতি ও সুশীল সাংবাদিকবৃন্দ অনেকটাই সমালোচনার চোখেই মূল্যায়ন করে যার ফলে অনেকই অস্বস্তি বোধ করে। আশির দশকের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসনামলে বাংলাদেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারীর আসন ছিল ৩০টি এবং এইটিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সাংবাদিক শফিক রেহমান তার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকার যায়যায়দিনে প্রকাশিত ফিচার সংসদের শোভা ত্রিশ সেট অলঙ্কার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল যা কেবল রুচি বিবর্জিতই নয় মানহানিকরও বটে। বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে এ রকম হাস্যরস উপহাসমূলক সংবাদ যে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা একেরাইে উড়িয়ে দেয়া যায় না। নারীবাদী সংগঠনগুলো এই সব সংরক্ষিত আসনের বিলুপ্তি চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যদের প্রনিধিত্ব চায়। এই ধরনের যখন একটি সেন্টিমেন্ট রাজনীতির অঙ্গনে বিরাজমান তখনই গত ৮ জুলাই সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদের সপ্তদশ সংশোধনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আর ২৫ বছর বাড়ানো হয়েছে সত্যি কিন্তু অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে দেশের রাজনীতির কিংবা সমাজনীতিতে নারী সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করছে বা করবে তা জোড় দিয়ে যেমন বলাত্ত যায় না একি ভাবে বিষয়টিকে উপেক্ষা ও করা যায না। তবে যে পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় তাতে নারীর ক্ষমাতায়ন কতটুকু সংগঠিত হচ্ছে সে প্রশ্ন রয়েই যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় সাধারণ সদস্যদের প্রতিনিধত্বের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলো সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে অথচ পূর্বের ব্যবস্থা ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এককভাবে সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের বেছে নিত। কিন্তু সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদের প্রধান সম্যসাগুলো হলো তাদের জেলা ওয়ারী দায়িত্ব দেয়া হয় কোন নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নয়। ফলে সংসদীয় আসনের বিপরীতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা তাদের কোনরূপ গুরুত্ব দেয়া না বিশেষত উন্নয়ন বাজেট বিতরণে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যা অনেকটা গলগ্রহের শামিল বলে প্রতীয়মান। আবার স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধীরাও তাদের মানতে চায় না। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ কথা বলা হয়েছিল যা পরবর্তিতে অর্ধেক পূরণ হয়েছে মাত্র। কিন্তু জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে কতজন প্রতিনিধি রয়েছে তা ছেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত পুরুষ সদস্যদের সমান অধিকার কিংবা সুযোগ ভোগ করছে কি না। রাজনৈতিক দল বিধি অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সবস্তরের কমিটিতে এক- তৃতীয়াংশ পদে নারীদের জন্য সংরক্ষণ বাধ্যতামূূলক রয়েছে। কিন্তু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী কিংবা সংসদের বাইরে থাকা কোন দলই সেই সকল শর্তের কাছাকাছিও আসতে পারেনি। এখানে একটি বাস্তব সমস্যা হলো নারী যোগ্য হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন দিতে চান না এই কারণে যে পারিবারিক পর্যায়ের একািট বাধা থাকে কিংবা তাদের নির্বাচনী ব্যয় মিটানোর জন্য তেমন কোন অর্থ সম্পদ থাকে না ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে আসন সংরক্ষিত হচ্ছে কিংবা আদো হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নটি বার বার আসছে সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে। এক সময় বিশেষত বা সত্তরের দশকে এর প্রযোজন থাকলেও বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখন অনায়শেই নারীদের জন্য নির্ধারিত আসন সংরক্ষিত রেখে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন হলে ক্ষতি কি? বর্তমান প্রথা বাংলাদেশ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কারণ এখানে নির্দলীয় প্রার্থীদের সংরক্ষিত আসনে আসার কোন সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে যেহেতু দেশ রয়েছে সেহেতু এই বিষয়টির আধুনিকায়ন যে সকল ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেয়া জরুরী তা হলো এক. একটি দেশের উন্নয়নে অনেকগুলো মানদ-ের মধ্যে একটি হলো সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি। সেই ক্ষেত্র পূর্বের তুলনায় অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত শিক্ষার কিংবা উচ্চ শিক্ষার হারে সরকারী; দ্বিতীয়ত চাকরিতে, সংসদীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে কিন্তু আশঙ্কার কারণে হলো যে গতিতে ও যে পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা খুবই মন্থর বা নির্ভর নয়। এখন রাতারাতি নারী উন্নয়ন সম্ভব নয় তার সঙ্গে সমাজ কাঠামো তথা পরিবার কাঠামো জড়িত যা বৈধ ধরে অপেক্ষা করতে হবে সংসদে নারীর প্রতিনিধত্ব বাড়ানোর জন্য সংরক্ষিত আসনকে বেছে নেয়া হয়েছে যা বিশ্বের কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোতে বলবত রয়েছে বিশেষত সমাজের পশ্চত পদে শ্রেণীর জন্য যেমন হরিজন, দলীত শ্রেণী, সাঁওতাল ইত্যাদি। উপজাতি শ্রেণীর জন্য বাংলাদেশ নৃতাত্ত্বি¡ক শ্রেণী গোষ্ঠী তেমন নেই। আবার থাকলেও তারা এত বেশি পশ্চাৎপদ যে জাতীয় উন্নয়নে কিংবা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো অবস্থায় নয় তবে সরকার এই ক্ষেত্রে বিশেষত শিক্ষায় ও চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রেখেছে যার সুফল দেশ ধীরগতিতে পাচ্ছে।
×