ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চৈতালী হালদার চৈতী

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৭ জুলাই ২০১৮

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গ। কোটা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আপত্তিও এসেছে। এই আপত্তির প্রথম কারণ, এখানে কোটার হার অসমানুপাতিক। মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সন্তানসহ মোট জনসংখ্যা যেখানে এক শতাংশের মতো বা এরও কম, সেখানে তাঁদের জন্য রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ কোটা। দুই. একমাত্র এটিই দুর্নীতিবান্ধব একটি কোটা। কারও পক্ষে ভুয়া নারী বা ভুয়া প্রতিবন্ধী হওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে এখানে ব্যাপক দুর্নীতি সম্ভব। তিন. ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা প্রদানের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’ পাঠক হয়ত ভাবছেন এই কথাগুলো আমার। কিংবা দৈনিক জনকণ্ঠের মতো একটি প্রগতিশীল জনপ্রিয় পত্রিকায় এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে হেয় করার মতো কথাই বা কিভাবে ছাপছে? কিন্তু না, এটা সম্প্রতি লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কলামের অংশ মাত্র। তার মতো অনেকেই এখন কথিত ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ আন্দোলনে সফল করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছেন। তারা তাদের সভা-সমবেশে অংশ নিচ্ছেন আর মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা মাধ্যমে উৎসাহ দিচ্ছেন সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে তথ্য ছড়িয়ে। আর ফেসবুক তো আছেই। একটি বিশেষ শ্রেণীর কোটা ইস্যুতে দেয়া ফেসবুক স্টাটাস এখন খুব পছন্দ জামায়াত-শিবিরের সকল নেতাকর্মীর। তাদের যত ফেসবুক পেজ আছে তার অন্যতম যোগানদাতা হয়ে উঠেছেন এ ধরনের ব্যক্তিরাই। অথচ এই শ্রেণীটি নিজেদের পরিচয় দেন তারা ‘নিরপেক্ষ’। ইদানীং কিছু ডানপন্থী ও উগ্রবাম আছেন যারা আবার নিজেদের চেহারা আড়াল করতে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা উল্লেখ করেন না। কৌশলে তারা বলেন, এই কোটা কমাতে হবে, ওই কোটা এত বেশি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেও এখন আর সুবিধা হচ্ছে না। তবে দেশের নারী সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের আদর্শ বিরোধী কয়েকজনের নেতৃত্বে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছিল তার আসল চেহারা এখন প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে। শত চেষ্টা করেও আর মূল নায়কদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখা যায়নি। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীর মতো গোপন আস্তানা থেকে উগ্রবাদী ও নাশকতার উস্কানিমূলক ভিডিও বার্তা দিয়ে রাশেদ খান যেমন নিজের চেহারার জানান দিয়ে ধরা খেয়েছেন তেমনি সত্যিকারের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও বুঝে গেছে ওরা আসলে কারা। এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা তো বটেই এক সময় যারা কোটা সংস্কারের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন স্রেফ সংস্কারের আশায় সরকারের উদ্যোগের পর তারা কথিত এ আন্দোলন বন্ধ করেছেন। ধীরে ধীরে সাধারণের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে বিশেষ ওই শ্রেণীর আসলে টার্গেট কি? ওরা যে ২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া জামায়াত-শিবিরের দাবি বাস্তবায়নেই মাঠে নেমেছে তা তাদের কর্মকা-েই বের হয়ে গেছে। তবে একটা বিষয় নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন এই কথিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে উদ্বেগজনক চেহারা আজ প্রকাশ হচ্ছে তা শুরু থেকে গণমাধ্যমে অনেকটা প্রায় একাই বলে গেছেন একজন। আর তিনি হচ্ছেন সাংবাদিক কলামিস্ট স্বদেশ রায়। গেল ১২ এপ্রিল তার লেখা উপ-সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘কোটা পদ্ধতি বঙ্গবন্ধুর চোখ দিয়ে দেখুন।’ আজ থেকে তিন মাস আগেই তিনি লিখেছিলেন, সোমবার সারাদিন কোটাবিরোধী আন্দোলনের খবর প্রকাশ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। সেখানে কোন একটা চ্যানেলে বার বার দেখেছি, গোলাপী রঙের পোশাক পরা একটি মেয়ে বার বার জোরের সঙ্গে বলছে, সব মিলিয়ে কোটা থাকবে মাত্র ১০%। নিজ কন্যাসম ওই মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে বার বারই মনে হচ্ছিল, ওর মতো বয়সে যখন রাজপথে ছিলাম তখন কি আমি এমনই উত্তেজনার তাড়নায় সিদ্ধান্ত নিতাম? তাকে আমি নিজের মেয়েই সম্বোধন করে বলছি, আমার ওই মেয়েটি যখন বলছে সব মিলিয়ে কোটা ১০% এর বেশি হবে না তখন কি সে ভেবে দেখেছে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে কি মেয়ে ও ছেলের অনুপাত সমান, না মেয়ে অনেক কম! ওর বয়স অনেক কম। সচিবালয়ের চত্বরে হয় তো ওর এখনও যাওয়ার সময় হয়নি। ও যদি সময় পেত, একবার সচিবালয়ে ঘুরে আসত, তাহলে দেখতে পেত এখনও কিন্তু সচিবালয়ে ১০% উর্ধতন কর্মকর্তা মেয়ে নয়। এ সময়ে যদি সব মিলিয়ে কোটা ১০% করা হয়, তাহলে মেয়েদের ভাগে তো ১% পড়বে না। তাহলে আমাদের যে আশা, আগামীতে মেয়ে ও ছেলে সমান সমান হোক। পার্লামেন্টে ৩০০ পার্লামেন্ট মেম্বারের ১৫০ মেয়ে নির্বাচিত হোক- সে সমাজ হবে কীভাবে? প্রতিযোগিতায় হয় ঠিকই। তবে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পৌঁছানোর জন্য একটি পর্যায়ে হাত ধরে টেনে তুলতে হয়। তাই আমাদের যেসব মেয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে তাদের একটু শান্ত মাথায় ভেবে দেখতে হবে যে, কোন অপরাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, কোন সংগঠনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়- আমি আসলে কী কাজটি করছি? সাহসী এ সংবাদিক আরও লিখেছিলেন,‘ এই নারী ও জেলা কোটার পরে সব থেকে বড় কোটা মুক্তিযোদ্ধা কোটা। একটি বড় অংশের ক্ষোভটা কেন যেন এই কোটার ওপরই দেখছি। এখানে কোটা ৩০%। এখনও সংবাদপত্র খুললে দেখা যায়, হয় কোন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছেন, না হয় রিক্সা চালাচ্ছেন। যারা আন্দোলন করছে তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করব, তোমরা একবার ভেবে দেখ ওই মুক্তিযোদ্ধারা না হলে আজ এদেশ পেতাম না। অথচ ওই ভিক্ষুকের, ওই রিক্সাওয়ালার ছেলেমেয়েরা কি তোমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসছে? বাংলাদেশে গত ৪৭ বছরে কারা ধনী হয়েছে? গোটা পিরোজপুর খুঁজে দেখতে বলি, রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যে ’৭১-এর আগে একজন ক্যানভাসার, একজন বাজারের রাস্তায় বসা ফেরিওয়ালা ছিল, তার সন্তানদের এখন কত সম্পদ? তার দশ ভাগের একভাগ সম্পদ কি গোটা পিরোজপুর খুঁজলে, একজন মুক্তিযোদ্ধার আছে? মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে পানি ঘোলা কারা করে? জামায়াত-শিবির-বিএনপিÑ এরাই তো মুক্তিযোদ্ধার কোটা নিয়ে পানি ঘোলা করে। তাই এই ঘোলা পানিতে কি সাধারণ ছাত্রছাত্রীর নামা উচিত? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ঠিক রেখে কোটা সংস্কারের পক্ষে আওয়ামী লীগ। কোটা সংস্কার আমরা চাই। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজাকারের সন্তান ও স্বার্থান্বেষী মহল ইন্ধন জুগিয়েছে। রাজাকারের সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা চান না। মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন নারী ও জেলা সংগঠন কোটার আন্দোলনের বিরুদ্ধে কথা না বলায় রাজাকারের সন্তান ও স্বার্থান্বেষী মহল কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে উস্কে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, আমরা কোটা সংস্কার চাই। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করছে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে, কোটা বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেটি আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দেয়া যাবে না। এ কোটা বহাল রেখে দরকার হলে অন্যসব কোটা বাতিল করা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা ইতোমধ্যেই যেনে গেছে পুরো দেশ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বলেছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আদালতের আদেশ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্যপ্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটা থেকে পূরণ করার সুযোগ রয়েছে। তবু ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোটা নিয়ে সরকারের গঠিত কমিটি এ ব্যাপারে সচেতনতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা করি। এ বিষয়ে আদালতের রায়ের কপি কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্য কোটা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন জটিলতা নেই। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ঠিক রেখে অন্য কোটার বিষয়ে কমিটি সুপারিশ করতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আশা পূরণ না হওয়ায় হতাশ এখন মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের প্রতিপক্ষরা। কারণ, কোটা সংস্কার নিয়ে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর বিভ্রান্ত করা যাবে না। ওদের যে টার্গেট মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাতে যে কোন আঘাত আনা ছাড়াই সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে চলে যাচ্ছে। আবার কয়েক নেতার সরকারবিরোধী আসল চেহারা বেরিয়ে আসার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরাও উস্কানিতে মাঠে নামছে না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চেয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে আপত্তিকর কথা বলছে, কটূক্তি করছে তাদের বায়োডাটা আমাদের কাছে আছে। তারা কারা আমরা জানি। চলবে... লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×