ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লা কলঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৭ জুলাই ২০১৮

 কয়লা কলঙ্ক

বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’ ময়লা তার অঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে যে, ধুয়ে মুছেও সাফ করা যায় না। সেই কয়লা নিয়ে যখন কেলেঙ্কারি ঘটে যায় তখন ধোঁয়া বের হতে থাকে। এমনিতেই কয়লা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। খনি থেকে কয়লা উৎপাদনের পর কয়লাতে জলীয়বাষ্প থাকার কারণে পরবর্তীকালে এক হতে দুই শতাংশ কয়লা এমনিতেই ওজন কমে যায়। প্রচার হচ্ছে যে, উত্তোলনের পর মজুদ রাখা স্থান হতে কয়লা ‘উধাও’ হয়ে গেছে। তাই তদন্ত চলছে উধাও নাকি অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি হতে উত্তোলিত এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার হিসাব মিলছে না। আর কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত কেন্দ্র। পেট্রোবাংলার তদন্ত প্রতিবেদনে যা এসেছে তা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতোই। ১৯৯৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার যে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে তারই মাসুল গুনতে হচ্ছে। বড়পুকুরিয়ার উত্তোলিত কয়লা মজুদ নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়ার পর পরিলক্ষিত হয় যে, কাগজে কলমে মজুদ থাকলেও বাস্তবে ঘাটতি রয়েছে কয়েক শ’ কোটি টাকা মূল্যের কয়লা। ঘটনায় চার কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এমনকি এদের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এই কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে জ্বালানি খাতের সব থেকে বড় কেলেঙ্কারি বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে কয়লার ঘাটতি পেয়েছে দুদক। এই গায়েব হওয়ার কাজটি শুরু হয়েছে ১৯৯৫ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে। এমনটাও ধারণা করা হচ্ছে। ‘হাওয়া ভবন’ যুগের চালু হওয়া এই অপকর্ম অব্যাহত ছিল। বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র চুরি করে খোলা বাজারে এসব কয়লা বিক্রি করে দিয়েছে। এই খনি হতে গত এগারো বছরে এক কোটি দশ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। সদ্য অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, কাগজে কলমে মজুদ কয়লার যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, তা সঠিক নয়। উৎপাদিত কয়লা থেকে সিস্টেম লস বা উৎপাদন ঘাটতিকে বাদ দেয়া হয়নি। জলীয়বাষ্প থাকার কারণে এক হতে দুই শতাংশ কয়লা এমনিতেই ওজনে কমে যায়। এ জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দুই শতাংশ সিস্টেম লস ধরা হয়, দেড় শতাংশ সিস্টেম লসও যদি ধরা হয় তা হলে এই ঘাটতি সঠিক রয়েছে। এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সিস্টেম লসের কারণে উত্তোলিত কয়লা নষ্ট হলে কয়লা রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? গত এগারো বছর ধরে কয়লা উধাও হয়ে গেল, আর কারও নজরে তা এলো না, বিস্ময়কর বৈকি। দেশে বর্তমান জ্বালানি চাহিদার মাত্র দুই ভাগ মিটিয়ে থাকে কয়লা শক্তি হতে। এখন এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, বড়পুকুরিয়ার মাটির নিচে যে কয়লার মজুদ রয়েছে, তার দশ ভাগও উত্তোলন করা যায়নি। দেশে যখন একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তখন খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার ঘাটতি হওয়ার ঘটনাটি উদ্বেগজনক বৈকি। কয়লা শক্তির ব্যবহারে একটি সমন্বিত, ভারসাম্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। বড়পুকুরিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তা উচ্চ পর্যায়ের তদন্তে স্পষ্ট হবে। দীর্ঘদিন ধরে ঘটা এই ঘটনাগুলো নিবৃত্ত করার কাজটি কেন এতদিন করা হলো না তা-ও পরিষ্কার হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট আমল থেকে চলে আসা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর করার পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
×