ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষণ আরও তিনদিন

অব্যাহত বৃষ্টিতে চরম আতঙ্কে রোহিঙ্গারা, চট্টগ্রামে লাল পতাকা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ জুলাই ২০১৮

 অব্যাহত বৃষ্টিতে চরম আতঙ্কে রোহিঙ্গারা, চট্টগ্রামে লাল পতাকা

চট্টগ্রাম অফিস/স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় চরম আতঙ্কে রোহিঙ্গারা। বুধবার কক্সবাজার শহর ও রামুতে পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনার পর জেলার পাহাড় ও পাদদেশে বসবাসকারীদের নির্ঘুম রাত কাটছে। অনেকে নারী শিশুদের অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে। টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে দুই রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে চারটি আশ্রয় কক্ষ। টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ী এলাকা থেকে স্থানীয়দের সাইক্লোন শেল্টার ও নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। স্কুল কলেজগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে মাইকিংয়ে জানানো হচ্ছে। চট্টগ্রামে পাহাড়ের ৩০ পয়েন্টে লালপতাকা উড়ানো হয়েছে। এদিকে, গত বুধবার দিনের বেলায় বৃষ্টিপাত না হলেও রাত থেকে বৃহস্পতিবার পুরোদিন চট্টগ্রামে বৃষ্টি হয়েছে। আবারও ডুবে যায় নগরী ও জেলার নিচু এলাকা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আরও দু’তিনদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। কক্সবাজারে গত চারদিনে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানি একাকার হয়ে পড়েছে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার বহু গ্রাম। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অন্তত তিন শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই লাখ পরিবার। বিশেষ করে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার সদর, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী ও উখিয়া এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল। ভারি বর্ষণে বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ৪টি আশ্রয় কক্ষ বিধ্বস্ত এবং আহত হয়েছে ১ কিশোরসহ দুই রোহিঙ্গা। বৃহস্পতিবার ভোরে নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসের এ ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত ৪ পরিবারসহ ২০টি রোহিঙ্গা পরিবারকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আহত আবুল কাশেম নামে এক রোহিঙ্গা কিশোরকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকিতে নারী-শিশুদের রাত জেগে পাহারা দিয়ে চলেছে। টানা ভারি বর্ষণের ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অধিকাংশ পাহাড়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে রয়েছে। তবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে তারা এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালাম জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির আশঙ্কা করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে বাকিদের সরিয়ে নেয়া হবে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে শতাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে। অন্তত ৫ হাজার একর বনভূমি কেটে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী ওসব রোহিঙ্গারা। তাদের সেবা প্রদানকারী কয়েকটি এনজিও নিজেদের স্থাপনা নির্মাণ কল্পে নির্বিচারে কেটে ফেলেছে বহু পাহাড়-টিলা। যার ফলে পাহাড়ের স্থায়ীত্ব নরম হয়ে পড়ে এখন ধসে পড়ছে। জানা যায়, শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পই নয়, টেকনাফের অন্য পাহাড়ী এলাকায় কয়েক হাজার বসতি গড়ে উঠেছে। যা বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছেÑ টেকনাফ পুরাতন পল্লানপাড়া, ফকিরামুরা, কাদিরঘোনা, নাইট্যংপাড়া, শিয়াইল্যাঘোনা, চাইল্যাতলী, বরইতলী উঠনি, বরইতলী, কেরুনতলী, নতুন পল্লানপাড়া, মাঠপাড়া, জাহালিয়াপাড়া, চন্দরকিল্লা, রাজারছড়া, হাবিরছড়া, মিটাপানিরছড়া, হ্নীলা দমদমিয়া, জাদিমুরা, রঙ্গিখালী, মুরাপাড়া, পশ্চিম সিকদারপাড়া, মইন্যার ঝুম, লেচুয়াপ্রাং, ঘোনাপাড়া, পশ্চিম পানখালী, হোয়াইক্যং নয়াপাড়া, কম্বনিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, পশ্চিম কুতুবদিয়াপাড়া, আমতলী, বালুখালী, দৈংগাকাটা, জুয়ারীখোলা ও মিনাবাজার ইত্যাদি। এদিকে টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে রাখাইন রাজ্যের জিরো লাইনে তুমব্রু কোনারপাড়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গা বস্তি পানিতে ডুবে থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়ে প্রায় পাঁচ মাসেও ওই রোহিঙ্গাদের দেশটির আরও ভেতরে সরিয়ে নিয়ে যায়নি। গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা সরেজমিন ঘুরে দেখেছেন জিরো লাইনে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা। দুই মাস আগে এনজিও কর্মকর্তারা ওসব রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে মাচাংঘর তৈরি করে দিয়েছে। পানির স্রোতের কারণে ওই ঘর থেকে তারা নিচে নামতে পারছে না বলে জানা গেছে। সেখানে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, দেশের পরিস্থিতি শান্ত হলে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশে তারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জিরো লাইনে অবস্থান নিয়েছিলেন। বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা এখানে মানবেতর দিনযাপন করছে। আরও বৃষ্টির পূর্বাভাস ॥ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৩৭ দশমিক ৪ মিলিমিটার। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় রয়েছে। সে কারণে বৃষ্টির প্রকোপ কমে আসতে সময় নেবে। আরও অন্তত দু’তিনদিন চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সারাদেশে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সাগরে এই মুহূর্তে কোন লঘুচাপ বা নিম্নচাপ নেই। সে কারণে সমুদ্র বন্দরসমূহের জন্য কোন সতর্কবার্তাও নেই। চট্টগ্রামে পাহাড়ের ৩০ পয়েন্টে লাল পতাকা ॥ চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়গুলোর ৩০টি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে লাল পতাকা স্থাপন করেছে জেলা প্রশাসন। এই পাহাড়গুলোর পাদদেশে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িতে বসবাসকারী লোকজনকে সরে যেতে গত দুদিন ধরে মাইকিং চলছে। জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যেই বেশকিছু ঘর উচ্ছেদ করেছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বিদ্যুত সংযোগ। এরপরেও যে ঘরগুলো রয়ে গেছে সেখানে যাতে কেউ বসবাস করতে না পারে সে জন্য কঠোর নজরদারি রয়েছে। সিটি কর্পোরেন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। এদিকে বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে আবারও দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। নিচু সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। উঁচু সড়কের ওপর চাপ পড়ায় তীব্র যানজটে ভোগান্তির মধ্যে পড়ে সপ্তাহের শেষদিনে বাড়িমুখী যাত্রীরা।
×