ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুতের আলোয় আরও পৌনে ৪ কোটি

বিদায় কুপি হারিকেন

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৭ জুলাই ২০১৮

 বিদায় কুপি হারিকেন

আনোয়ার রোজেন ॥ এক দশক আগেও গ্রামাঞ্চলে কুপি ও হারিকেনই ছিল রাত্রিকালীন আলোর উৎস। টিমটিমে আলোর এসব কুপি-হারিকেনের রসদ ছিল কেরোসিন তেল। সারা দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য তখন প্রয়োজন হতো প্রচুর পরিমাণে কেরোসিন আমদানির। যার পেছনে ব্যয় হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিপুল অর্থ। বিদ্যুত নিয়ে বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে এই চিত্র পাল্টেছে। সোলার মডিউল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এসএমএমএবি) হিসাব অনুযায়ী, রাত্রিকালীন জ্বালানি হিসেবে কেরোসিনের বার্ষিক ব্যবহার কমেছে প্রায় দুই লাখ টন। এতে প্রতি বছর সংশ্লিষ্ট খাত থেকে সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। পরিসংখ্যানও দিচ্ছে কেরোসিনের ব্যবহার কমার তথ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য মতে কেরোসিনের আলোর ওপর দেশের মানুষের নির্ভরশীলতা দ্রুত হারে কমছে। বাড়ছে প্রচলিত বিদ্যুত ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার। বর্তমানে দেশের মাত্র ৮ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ কেরোসিন আলোর ওপর নির্ভরশীল, ২০১৩ সালে এই হার ছিল ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৫ বছরে কেরোসিন আলোর ব্যবহার কমেছে চার ভাগ। আর শতাংশের হিসেবে কমেছে ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ, যারা এতদিন কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, প্রথমবারের মতো তারা বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুত নিয়ে বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণেই অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি কেরোসিনের ব্যবহার কমছে। ’২১ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষকে নির্ভরযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনার যে টার্গেট সরকার নির্ধারণ করেছে, সেটি অর্জিত হলে কেরোসিন আলোর ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কেরোসিন আলোর ব্যবহার শিশু স্বাস্থ্যকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে ফেলে। কারণ কেরোসিন পোড়ানোর ফলে ঘরের বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বাড়ে, যা শিশুসহ সব বয়সী মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই কেরোসিনের ব্যবহার কমায় শুধু জ্বালানি আমদানি ব্যয় কমছে, তা নয়। স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমছে। চাহিদা পড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে কেরোসিনের আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সম্প্রতি বিবিএসের মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) শীর্ষক প্রকল্পের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের মানুষের ব্যবহৃত আলোর উৎস সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্যবহৃত আলোর উৎসের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মানের সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী আলোর উৎস হিসেবে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এ ধরনের আলোর উৎস ব্যবহার করছে। এর মধ্যে সরাসরি বিদ্যুত ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি, ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আলোর উৎস হিসেবে সৌর বিদ্যুত বা সোলার ব্যবহার করছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। আর কেরোসিন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যান্য অপ্রচলিত উৎস (মোমবাতি, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি) ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে খুবই নগণ্য, মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। জানতে চাইলে এমএসভিএসবি প্রকল্পের পরিচালক একেএম আশরাফুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবেদনটি ২০১৭ সালে মোট ২ হাজার ১২ নমুনা এলাকায় ২ লাখ ৯৫ হাজার ১৭৫ খানা বা পরিবার থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোয় সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে কেরোসিনের ব্যবহার কমছে। প্রচলিত বিদ্যুতের পাশাপাশি সোলার বিদ্যুতের ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। আগে যারা আলোর উৎস হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার করতেন, তারা বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যুত অথবা সোলার বিদ্যুত ব্যবহার করছেন। বিবিএসের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী কেরোসিন ব্যবহারের হার ২০১৩ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে কমে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ। এ হার সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০১৫ সালে। অর্ধেক কমে এ হার দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যেটি ২০১৬ সালে কমে হয়েছে ১৩ শতাংশ এবং বর্তমানে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। সবাইকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, তারা ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নতুন এক কোটি ৭৯ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুত সংযোগ দিয়েছে। ২০০৯ সালে সারাদেশে এক কোটি ৮ লাখ গ্রাহক বিদ্যুত পেত, যা ২০১৮ সালে এসে বেড়ে দুই কোটি ৮৭ লাখে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে বিবিএসের জরিপে। জরিপ অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিদ্যুত ব্যবহারের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে এ হার হয় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ, তবে ২০১৬ সালে বিদ্যুত ব্যবহারের হার বেড়ে হয় ৮১ দশমিক ২ শতাংশ এবং সবশেষ ২০১৭ সালে ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে।
×