ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবারও রাজধানীর ৩৪ দোকানকে ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা পাঁচটি দোকান সিলগালা দশজনকে কারাদন্ড

ভেজাল ওষুধ ॥ সাবধান - জেল-জরিমানায়ও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৭ জুলাই ২০১৮

ভেজাল ওষুধ ॥ সাবধান - জেল-জরিমানায়ও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না

নিখিল মানখিন ॥ ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধের হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের ওষুধ জব্দ করছেন র‌্যাব ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অভিযানকারী দলের সদস্যরা। বৃহস্পতিবারও রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে নকল ও বিদেশী ওষুধ রাখার দায়ে ৩৪ ওষুধের দোকানকে ৫৮ লাখ টাকা অর্থদন্ড দিয়েছে র‌্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। দশজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদানসহ পাঁচটি দোকান সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। দেশের নামী-দামী হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ফার্মেসিও এমন ওষুধ রাখার দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দন্ড থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল নকল ওষুধ কারখানার সন্ধান পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবৈধ পথেও বিদেশ থেকে আসছে জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ। এ ধরনের ওষুধের কয়েকটি চালান ধরাও পড়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিটফোর্ডে জননী মার্কেট ও রহিম/মেট্রো মেডিসিন মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। র‌্যাব হেড কোয়ার্টারের ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম এ আদালত পরিচালনা করেন। ওই সময় ওই মার্কেটের দুটি দোকানে বিক্রিযোগ্য নয় এমন নমুনা, রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিদেশী ওষুধ এবং দেশীয় প্রথম শ্রেণীর বহুল প্রচলিত ওষুধের নকল বিক্রি-সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। আর ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই চলত এসব দোকান। দোকানগুলোতে ছিল না কোন ফার্মাসিস্ট। অভিযানে উপস্থিত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক মাহমুদ হোসেন জানান, ভেজাল, মানহীন ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনভাবেই তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভেজাল ওষুধ সেবন করলে রোগ না সেরে উল্টো বেড়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এসব ওষুধ সেবনে ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোক হতে পারে। এমনকি হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটার আশঙ্কাও থাকে। ৯০ দশকজুড়ে ভেজাল, বিষাক্ত প্যারাসিটামল সেবন করে কয়েক হাজার শিশুর কিডনি বিকল হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ওষুধ প্রশাসনের নমনীয়তার কারণেই মূলত ভেজাল, নকল ও মানহীন ওষুধ তৈরি হচ্ছে এবং অবৈধ পথে আমদানি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে দায়সারা গোছের শাস্তির ব্যবস্থা করেই দায়িত্ব শেষ করে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া দুর্বল ওষুধ নীতির কারণে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সরকার সংশ্লিষ্টদের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বিঘ্নে এ অবৈধ কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ১৯৮২ সালে প্রণীত নীতিমালা দিয়েই চলছে ওষুধ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। এটি যুগোপযোগী করতে প্রায় চার বছর আগে একটি খসড়া তৈরি হলেও সেটি আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। খসড়া নীতিমালায় ভেজাল, নকল ও মানহীন ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও অবৈধ পথে আমদানি বন্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। দক্ষ ফার্মাসিস্টের অভাব ॥ দেশের শতকরা ৯৯ শতাংশ ফার্মেসি চলছে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট এবং প্রশিক্ষণহীন লোকজন (ভুয়া ফার্মাসিস্ট) দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফার্মেসির অনুমোদন দেয়ার শর্তাবলীতেই বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে। ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দিয়েও ফার্মেসি চলতে পারে বলে অনুমোদনের শর্তাবলীতে উল্লেখ রয়েছে। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা মাত্র তিন মাসের কোর্সধারী, যাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাও মাধ্যমিক পাস। ওষুধের গুণাগুণ, ব্যবহার, প্রয়োগবিধি, কার্যকারিতা বা ক্ষতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে না তাদের। ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দিয়ে ফার্মেসি চালানোর অনুমতি দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করছেন ভুয়া ফার্মাসিস্টরা। ফার্মেসি বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ পর্যন্ত নেই। তারা যত্রতত্র গড়ে তুলছে অবৈধ ফার্মেসি। এমন ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট দিয়ে নিরাপদ ওষুধ সংরক্ষণ, বিক্রি এবং ক্রেতাদের কাছে সঠিক মানের ওষুধ তুলে দেয়া সম্ভব নয়। তাদের কারণে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হয়ে উঠতে পারে প্রাণনাশের বিষ। এমন ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টরা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সম্প্রতি ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধের দোকান পরিচালনা করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বেড়েই চলেছে লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসির সংখ্যা ॥ সরকারী তালিকাভুক্ত ৯৫ হাজার ফার্মেসির মধ্যে ৬০ হাজারের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে লাইসেন্সবিহীন ওষুধের দোকান বন্ধে জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকান সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন অভিযান টিমের সদস্যরা। ওই সব ফার্মেসির মালিক দুই থেকে ৫ বছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন না করে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে মাত্র ৩৫ হাজার ফার্মেসি বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর অননুমোদিত ফার্মেসির সংখ্যা সোয়া লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ দোকানগুলো সামাল দেয়ার পর অননুমোদিত, অবৈধ দোকানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। এতে অভিযানের সফলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দোকানগুলোর ঠিকানা, বৈধতা ও অবৈধতা যাচাই করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে । যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে ওষুধের দোকান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের চা, পান, বিড়ি, মুদির দোকানেও দেদার বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ। রাজধানীতেও এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। অবৈধ ওষুধের দোকান জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
×