ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লা চুরির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পেট্রোবাংলার কমিটি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ জুলাই ২০১৮

কয়লা চুরির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পেট্রোবাংলার কমিটি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চুরি করে ২৩০ কোটি টাকার কয়লা বিক্রি করে দিয়েছে বড়পুকুরিয়া খনির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এক দিনে এই চুরির ঘটনা ঘটেনি, পর্যায়ক্রমে বছরের পর বছর ধরে খোলাবাজারে বিক্রির সময় এই কয়লা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অবৈধভাবে বিক্রির মাধ্যমে ঠিকাদার এবং খনি কর্মকর্তারা লাভবান হয়েছেন। বুধবার বিকেলে পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটি বিদ্যুত জ¦ালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। সাবেক সকল ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফেঁঁসে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা খোয়া গেছে। প্রতিবেদনে কয়লা খোয়া যাওয়ার জন্য কাদের দায়ী করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু কেউ কোন হিসাব রাখেনি সঙ্গত কারণে সকলেই দায়ী। দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একটি সূত্র জানিয়েছে, খনি কর্তৃপক্ষের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ হাবিব উদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামারুজ্জামান, এসএম নূরুল আওরঙ্গজেব এবং আমিনুজ্জামানকে তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে। মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন আওরঙ্গজেব এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি আরপিজিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামারুজ্জামান। হাবিব উদ্দিনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আমিনুজ্জামানের বিরুদ্ধে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন বিদ্যুত জ¦ালানি বিভাগের শীর্ষ কর্তারা। বুধবার বিকেলে খনি দুর্নীতির প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বিদ্যুত এবং জ¦ালানি বিভাগের প্রতিমন্ত্রীসহ অন্যরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই বৈঠকে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর জ¦ালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম ছাড়াও বৈঠকে বিদ্যুত জ¦ালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুত সচিব আহমেদ কায়কাউস, জ¦ালানি সচিব আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম, পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ এবং পেট্রোবালা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফায়জুল্লাহ এনডিসি উপস্থিত ছিলেন। এদিকে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ যে মামলা করেছে তাতে বলা হয়, খনি উন্নয়নের সময় ২০০১ থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট এক কোটি এক লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। উৎপাদিত কয়লা থেকে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ, বেসরকারী ক্রেতাদের কাছে ডিওর মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ মেট্রিক টন কয়লা বিক্রি এবং কয়লা খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ মেট্রিক টন কয়লা ব্যবহার করা হয়। কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুত দাঁড়ায় এক লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন। কিন্তু বাস্তবে মজুদ ছিল প্রায় তিন হাজার মেট্রিক টন কয়লা। অর্থাৎ এক লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মেট্রিক টন কয়লা ঘাটতি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা টাকা। অভিযোগে বলা হয়, এ ঘটনায় চার জনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাকি ১৫ জন আসামি অনেক আগে থেকেই তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সংঘটিত কয়লা চুরির ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অনুমিত হয়। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, মামলাটি পেট্রোবাংলার তদন্তে উঠে আসা তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এজন্য প্রতিমন্ত্রী নির্দেশ দেয়ার পরও মামলা করতে সময় নেয়া হয়েছে। রবি থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সময়ে পেট্রোবাংলার তদন্ত দল যেসব তথ্য প্রমাণ পেয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে মামলা করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, কয়লা চুরির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর খনি কর্তৃপক্ষ সিস্টেম লসের কথা বলে আসছে। কিন্তু এই বিষয়টি পেট্রোবাংলা থেকে গ্রহণ করা হয়নি। তারা আগে কেন সিস্টেম লসের কথা বলেনি বলে প্রশ্ন তোলেন তিনি। কয়লা খনিটি পরিচালনা করে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ। খনিটি একটি কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হয়। অধিকাংশ কর্মকর্তা শুরু থেকে দীর্ঘদিন এখানে চাকরি করেন। কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে ওপরের দিকের কিছু পদে পেট্রোবাংলা থেকে লোকবল পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন চাকরিতে নিয়োজিত থাকার কারণে খনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়লার ডিলারদের একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক ধরেই চুরি হয়ে থাকে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখান থেকে কয়লা নেয়ার সময় পরিমাপে বেশি দিয়ে বাড়তি অর্থ নেয়া হতো। এভাবে দিনের পর দিন বেশি বেশি কয়লা বিক্রি করা হয়েছে। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রে সঙ্কট দেখা দিলে কয়লা কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা,পার্বতীপুর থেকে জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে আনুমানিক ২৩০ কোটি মূল্যমানের ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ মে টন কয়লা চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে খনির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দিন আহমেদসহ ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে পার্বতীপুর মডেল থানায় দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং ৪০৯ ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপক- প্রশাসন মোহাম্মদ আনিছুর রহমান রাষ্ট্রের পক্ষে বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার অন্য অভিযুক্তরা হলেন আবু তাহের মোঃ নূর-উজ-জামান, মহাব্যবস্থাপক, মাইন অপারেশন (সাময়িক বরখাস্ত), এ কে এম খালেদুল ইসলাম, উপ-মহাব্যবস্থাপক (স্টোর ডিপার্টমেন্ট), আবুল কাশেম প্রধানীয়া, প্রাক্তন কোম্পানি সচিব/ মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন), গোপালচন্দ্র সাহা, মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব), আ. মান্নান পাটোয়ারী, প্রাক্তন মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব), মোশাররফ হোসেন সরকার, ব্যবস্থাপক (এক্সপ্লোরেশন), মাসুদুর রহমান হাওলাদার, ব্যবস্থাপক (জেনারেল সার্ভিসেস), অশোক কুমার হালদার, ব্যবস্থাপক (প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট), মোঃ আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপক (মেইন্টেনেন্স এ্যান্ড অপারেশন), জাহিদুল ইসলাম, ব্যবস্থাপক (ডিজাইন, কন্সট্রাকশন এ্যান্ড মেইন্টেনেন্স), মোঃ একরামূল হক, উপ-ব্যবস্থাপক (সেইফটি ম্যানেজমেন্ট), মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং ম্যানেজমেন্ট), মোঃ মোর্শেদুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপক (মেইন্টেনেন্স এ্যান্ড অপারেশন), মোঃ হাবিবুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (প্রডাকশন ম্যানেজমেন্ট), মোঃ জাহেদুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (মাইন ডেভেলপমেন্ট), সতেন্দ্রনাথ বর্মণ, সহকারী ব্যবস্থাপক (ভেন্টিলেশন ম্যানেজমেন্ট), সৈয়দ ইমাম হাসান, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা), মোঃ জোবায়ের আলী, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মাইন প্ল্যানিং ডেভেলপমেন্ট)। বুধবার বেলা ১১টায় এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পার্বতীপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ ফকরুল ইসলাম মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন এ মামলার তদন্তভার পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন। এ কারনে মামলা দায়েরের পর পরই সকল নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে ।
×