ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুষ্ঠু নীতিমালা ও দক্ষ জনবলের অভাব ॥ ত্রুটিপূর্র্ণ চুক্তি ॥ নেপথ্য কাহিনী ॥ কয়লা কেলেঙ্কারি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৬ জুলাই ২০১৮

সুষ্ঠু নীতিমালা ও দক্ষ জনবলের অভাব ॥ ত্রুটিপূর্র্ণ চুক্তি ॥ নেপথ্য কাহিনী ॥ কয়লা কেলেঙ্কারি

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর ॥ দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া খনির ইয়ার্ড থেকে কয়লা ‘গায়েব’-এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে এসেছে। জানা যায়, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এবং ২৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে একটি ক্রুটিপূর্ণ চুক্তি করে। প্রকৃতপক্ষে যা ছিল, চীনকে দেয়া বিএনপি সরকারের ‘উপহার’। ওই চুক্তিতে খনি ও তাপবিদ্যুত কেন্দ্র পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টি এবং প্রতিষ্ঠান দুটি পরিচালনার কোন দিক নির্দেশনা ছিল না। ফলে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে কোন রকমে প্রতিষ্ঠান দুটির কাজ শেষ করে গছিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশ সরকারের কাছে। যার কারণে, পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নামে একটি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি বর্তমানে চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষ জনবলের অভাব ও সুষ্ঠু কোন নীতিমালা না থাকার কারণে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা ‘গায়েব’-এর মতো ঘটনা ঘটে। এদিকে হিসাব অনুযায়ী বড়পুকুরিয়া খনির ইয়ার্ডে কয়লা কম থাকার কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোঃ আনিছুর রহমান বাদী হয়ে দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ও ৪০৯ ধারায় মঙ্গলবার রাতে পার্বতীপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, খনি উন্নয়নের সময় (২০০১) থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন কয়লা উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদিত কয়লা থেকে পার্শ্ববর্তী তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ মে. টন কয়লা সরবরাহ, বেসরকারী ক্রেতাদের কাছে ডিও’র মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ মে. টন কয়লা বিক্রি এবং কয়লা খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ মে. টন কয়লা ব্যবহার করা হয়। কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুদ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মে. টন। কিন্তু বাস্তবে মজুদ ছিল প্রায় ৩ হাজার মে. টন কয়লা। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ মে. টন কয়লা ঘাটতি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা বলে জানানো হয়। অভিযোগে বলা হয়, এ ঘটনায় চারজনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাকি ১৫ আসামি অনেক আগে থেকেই তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে সংঘটিত কয়লা চুরির ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে অনুমিত হয়। বুধবার সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, কম কয়লা তুলে ঠিকাদার কোম্পানি বেশি দেখিয়েছে অথবা খনি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশি বিক্রি করে কাগজে-কলমে কম দেখানোয় বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার হিসেব মিলছে না বলে মনে করছেন অনেকে। খনি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সরাসরি এই কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও অনেকে মনে করছেন। বড়পুকুরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর সব মহলে প্রশ্ন ওঠে, এত কয়লা গেল কোথায়? বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিপুল পরিমাণ এই কয়লার মধ্য থেকে এক-দেড় লাখ টন কয়লা বিক্রি করে দেয়া হলে কোন সমস্যা হবে না মনে করেই, দীর্ঘদিন থেকে এটা করা হতে পারে। এক বা দুই দিনে এই কাজ করা হয়নি। এটা করতে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ধরা যাক কোন ক্রেতা ১০০ টন কয়লা নিল, তাকে ১০০ টনের স্থলে ১২০ টন কয়লা দেয়া হলো। এখানে ২০ টনের টাকা গ্রাহক এবং বিক্রয় প্রতিনিধির মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে থাকতে পারে। এতে উভয়পক্ষই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। কয়লা পরিমাপই করা হয়নি তাই এমন সুযোগ অতীতে কারও নেয়া অসম্ভব নয় বলে খনির সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। তিনি বলেন, এমন দুর্নীতি সব সময় হয় না। কোন কোন সময় কারও কারও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে হয়ে থাকতে পারে। তিনি একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ঠিকাদার কোম্পানির সখ্যতার কথাও জানান। কয়লা খনির কেউ কেউ মনে করছেন, ঠিকাদার কোম্পানি নির্দিষ্ট কোন সময়ে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতে পারে। এতে কয়লা না তুলেই তারা অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। প্রতি টন কয়লা তোলার বিপরীতে ঠিকাদার কোম্পানিকে শুরুতে ৫২ ডলার করে পরিশোধ করতে হতো। এখন প্রতি টনের বিপরীতে ৮২ ডলার করে পরিশোধ করতে হয়। ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এমন কোন ব্যবস্থাপকের সময় এই দুর্নীতি ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানায়, প্রধানত তিনটি কারণে বড়পুকুরিয়া খনির ইয়ার্ড থেকে হিসাব অনুযায়ী কয়লা কম থাকার ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো হলোÑ সিস্টেম লস্, টেকনিক্যাল লস্ ও খোলা বাজারে বিপণন ক্রুটি। চীন, ইন্দোনেশিয়া, ক্রোয়েশিয়ার কয়লা খনিগুলোতে সিস্টেম লস্ ও টেকনিক্যাল লসের পরিমাণ ধরা হয় শতকরা ১ দশমিক ৬ ভাগ। উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া খনি থেকে এক কোটি ২২ হাজার ৯৩৩ মেট্রিক টন কয়লা তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক হিসাব মতে সিস্টেম লস্ ও টেকনিক্যাল লস ধরা হলে বড়পুকুরিয়া খনিতে উত্তোলিত কয়লা থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৬ দশমিক ৯৩ মে. টন কয়লা কম থাকার কথা। প্রকৃতপক্ষে এর থেকে অনেক কম পরিমাণ কয়লা ইয়ার্ডে কম পাওয়া গেছে। সূত্রটি জানায়, খনির অভ্যন্তর থেকে কনভেয়ার বেল্টের সাহায্যে কয়লা উপরে তোলার সময়, সেখানেই ওজন রেকর্ড করা হয়। সে সময় কয়লা পানিতে ভেজা অবস্থায় থাকে। এরপর তা ইয়ার্ডে খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়। সেখানে রোদ ও বৃষ্টির পানিতে থেকে থেকে কয়লার ওজন কমতে থাকে। ইয়ার্ডের পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো দিয়েও অনেক কয়লা বাইরে চলে যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ড্রেন দিয়ে বের হয়ে আসা কয়লা স্থানীয় লোকজন সংগ্রহ করে তা বাইরে খুচরো বিক্রি করে থাকেন। সূত্রটি জানায়, বড়পুকুরিয়া খনির প্রজেক্ট প্রোফাইলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার শতকরা ৩৩ ভাগ খোলা বাজারে বিক্রি হবে। অবশিষ্ট কয়লা ব্যবহার হবে পার্শ্ববর্তী তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে। সূত্রটি জানায়, উত্তোলিত কয়লার ৩৩ ভাগ খোলা বাজারে বিক্রর সময় দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিকেল ৫টার মধ্যে খনি এলাকার কার্যক্রম শেষ করার কথা। এরপর শ্রমিক ও বহিরাগতদের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। অথচ কয়লা খনির ইয়ার্ডে বিকেল ৫টার পরও ট্রাক প্রবেশ ছিল নিয়মিত ঘটনা। প্রতিদিন ১৫০-২০০০ ট্রাক এখান থেকে কয়লা নিয়ে যেত। প্রতিটি ট্রাকে কয়লা থাকত ১০-১২ টন। কখনও কখনও ১৫ টনও। যদিও দাফতরিকভাবে কয়লার হিসাব রাখা হতো প্রতি ট্রাকে পাঁচ-ছয় টনের। অবশিষ্ট কয়লা বিক্রির নামে চুরি হয়ে গেছে। কয়লার এ অবৈধ কারবার সেখানে চলেছে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত। বড়পুকুরিয়ার কয়লা পরিবহনে নিয়মিত ট্রাক ভাড়া দেন মোঃ মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, বরাদ্দের চেয়ে বেশি কয়লা চুরি করে বিক্রি করা হয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে এ কারবার। তার অভিযোগ, বিভিন্ন ঠিকাদারের নামে বরাদ্দকৃত কয়লার চেয়ে বেশি পরিমাণে বিক্রি করেছেন খনির কর্মকর্তারা। বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা রাখার পর অতিরিক্ত কয়লা বাইরে বিক্রির অনুমতি ছিল বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির। সে সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরা। বিভিন্ন টেন্ডারের বিপরীতে যে পরিমাণ কয়লা বরাদ্দ দেয়া ছিল, তার কয়েকগুণ তারা বিক্রি করেছেন। বুধবার সরেজমিন বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং এলাকা ঘুরে ও শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এর কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে। বর্ষা মৌসুমে ইটভাঁটির কয়লার চাহিদা কমে যায়। তখন খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা ইয়ার্ডে জমিয়ে রাখে কর্তৃপক্ষ। পরে চাহিদা বাড়লে, বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা রেখে, বাকিটা দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি। প্রতিটি দরপত্রের বিপরীতে ১০০ টন করে কয়লা দেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক জানান, বাস্তবে একেকজন ঠিকাদারের কাছে হাজার হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে তা বিক্রি করা হয়। বিক্রির অর্থ সরকারী কোষাগারে না গিয়ে জমা পড়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পকেটে। মঞ্জুরুল ইসলাম নামে একজন লোড-আনলোড শ্রমিক বলেন, প্রতিদিন কাগজে-কলমে যে পরিমাণ কয়লা বিক্রি হতো, বাস্তবে তার পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিটি ট্রাক তার সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতায় কয়লা বোঝাই করে বের হতো। ফলে দরপত্রের মাধ্যমে কোন ঠিকাদার যতটুকু কয়লা পেয়েছেন, নিয়ে গেছেন তার দ্বিগুণ। বাড়তি কয়লার দাম বিলি-বণ্টন হয়েছে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে। অনুসন্ধানে জানা যায়, খনিতে উৎপাদন বন্ধের পরও বেসরকারী খাতে কয়লা বিক্রি করেছে খনি কর্তৃপক্ষ। ঈদ-উল-ফিতরের আগে ১৭ জুন পর্যন্ত নিয়মিত কয়লা বিক্রি হয়েছে। ঈদের পর গত মাসের শেষ পর্যন্ত এ বিক্রি চলেছে। তবে চলতি বছরের মার্চের পর বাইরে কোন কয়লা বিক্রি হয়নি বলে দাবি বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির সদ্য অপসারিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের। তিনি বলেন, আমাদের মজুদ যখন চার লাখ টন হলো, তখন বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) জন্য মজুদ রেখে আমরা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রত্যেককে ১০০ টন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গত ছয় বছরে বিপিডিবি যে পরিমাণ কয়লা ব্যবহার করেছে, ২৭৫ মেগাওয়ার্ড ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিট চালু হওয়ার পর, গত ছয় মাসে বিপিডিবি নিয়েছে তার দ্বিগুণ। এছাড়া কয়লা উৎপাদনে যে সিস্টেম লস, সেটি কখনই আমরা হিসাব করিনি। বিপিডিবির বেশি ব্যবহার ও সিস্টেম লসের কারণেই কয়লার এ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বুধবার সরেজমিন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ইয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, কয়েক টন কয়লার মাত্র দু-তিনটি স্তূপ রয়েছে সেখানে। বসিয়ে রাখা হয়েছে অন্যান্য যন্ত্রপাতিও। ১৭ একর জায়গাজুড়ে পুরো ইয়ার্ডটি শূন্য পড়ে আছে। অথচ দুই মাস আগেও খনির পাশ দিয়ে যাওয়া চৌহাটি রাস্তা থেকে উঁচু দেয়ালের ওপাশে কয়লার বিশাল স্তূপ দেখা যেত। খনি এলাকা শূন্য হলেও কয়লার মজুদ দেখা যায় আশপাশের ব্যবসায়ীদের গুদামে। ইয়ার্ডের কয়েক গুণ কয়লা রয়েছে এসব গুদামে। নানা নামে কয়লা নিয়ে মজুদ করে রেখেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে শ্যামলী আবাসিক হোটেল ও শ্যামলী হ্যাচারির নামে বিপুল পরিমাণ কয়লা নিয়ে মজুদ করেছেন একজন। পাশেই রয়েছে সুমাইয়া ট্রেডার্স নামে অন্য এক ব্যবসায়ীর দুটি বিশালাকৃতির গুদাম। এর বাইরে বাউন্ডারি ঘেরা কয়লার ছোট ছোট স্তূপ রয়েছে অনেক। উল্লেখ্য, বিপিডিবির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি হিসেবে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুতের জন্য তিন মাসের কয়লা মজুদ রাখার দায়িত্ব খনি কর্তৃপক্ষের। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার দায় খনি কর্তৃপক্ষের। ২৯ মে থেকে খনিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কূপ খনন ও উত্তোলন শুরু হতে সাধারণত তিন মাস সময় লাগে। সে হিসাবে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত কয়লা মজুদ রাখার কথা ছিল। কিন্তু ইয়ার্ড থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা উধাও হওয়ার পর দেড় মাসের মধ্যেই মজুদ সঙ্কট দেখা দেয়। কয়লার অভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে দেশের কয়লাভিত্তিক একমাত্র বিদ্যুতকেন্দ্রটি। তবে বড়পুকুরিয়া ইয়ার্ডে কয়লা শেষ হয়ে যাওয়ার মাত্র দুই দিনের মাথায় তাপবিদ্যুত কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, এর দায়ও এড়াতে পারে না তাপবিদ্যুত কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী, তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের নিজস্ব ইয়ার্ডে কমপক্ষে ১৫ দিন চলার মতো আপদকালীন কয়লা মজুদ থাকার কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এই নিয়মও মানা হয়নি। খনির পাশাপাশি সেখানেও ছিল না, এক টনও কয়লা। বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ জানায়, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই ও ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি দুটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়লা বিক্রি করা হয়। গত ১৮ মার্চ থেকেই বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে অন্য গ্রাহকদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ করা হয়। কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৫-০৬ সালে বর্তমান স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। গত ১৩ বছরে একবারও কয়লা বিক্রি করার পর ইয়ার্ডে কি পরিমাণ কয়লা আছে, রহস্যজনকভাবে তার হিসেব রাখা হয়নি। শুধু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এক কোটি ২২ হাজার ৯৩৩ মেট্রিক টন কয়লা তোলা হয়েছে তার হিসেব আছে। তবে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা প্রথম বছরে তিন লাখ তিন হাজার ১৫ টন কয়লা উত্তোলন করে। পরবর্তী বছর থেকে কয়লা তোলার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৭ মেট্রিকটন কয়লা তোলা হয়। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২১ হাজার ৬৩৮ মেট্রিক টন। এভাবে প্রতিবছরই সাত থেকে নয় লাখ মেট্রিকটন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের গত মার্চ পর্যন্ত ৭ লাখ ৮২ হাজার ২১৪ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। জানা যায়, প্রথমদিকে ২০০১ সালের ২৯ মে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় কর ছাড়া ৬১ দশমিক ৫০ ডলার। এরপর ২০০৮ সালের জুলাই মাসে এই দাম বাড়িয়ে ৭১ দশমিক ৫০ ডলার করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১০৬ ডলার, ২০১৫ সালের ১ মে ১৩১ দশমিক ৫০ ডলার এবং ২০১৭ সালের ১ জুলাই ১৩০ ডলার (কর ছাড়া) কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়।
×