ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেকর্ড বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে ধস, আহত ৩ ;###;আরও দু’তিনদিন বিভিন্ন স্থানে ভারি বর্ষণ, নদনদীর পানি বাড়ছে

কক্সবাজারে পাহাড়ধস ॥ এক পরিবারের চারজনসহ ৫ শিশুর মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৬ জুলাই ২০১৮

কক্সবাজারে পাহাড়ধস ॥ এক পরিবারের চারজনসহ ৫ শিশুর মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রেকর্ড বৃষ্টিপাতে মাটি নরম হয়ে কক্সবাজার শহর ও রামু এলাকায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৪ জনসহ ৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। নিহত সবাই শিশু। আহত হয়েছে ৩ জন। বুধবার ভোরে দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া বাঁচামিয়ারঘোনা এবং রামু দক্ষিণ মিঠাছড়ি পেঁচারঘোনায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আগামী দুই থেকে তিনদিন দেশের বিভিন্নস্থানে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের বিভিন্ন নদী-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে বুধবারও সকাল থেকে সারাদেশে বর্ষণ অব্যাহত। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৪৬৩ মিলিমিটার। আবহাওয়ার পূর্বাভাবে বলা হয়েছে, সারাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে বুধবার বিকেল চারটা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি (৪৪-৮৮ মি.মি.) থেকে অতিভারি (৮৯ মি.মি.) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারি বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। তারা জানায়, মৌসুমিবায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমিবায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দম্কা হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তারা জানায়, নি¤œচাপের প্রভাব কেটে যাওয়ার পর পরই দেশের ভেতরে মৌসুমিবায়ু সক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবেই কয়েকদিন ধরে টানা বর্ষণ শুরু হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টি আরও তিন দিন চলবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বাংলাদেশের বর্ষাকালে বৃষ্টির প্রধান কারণ মৌসুমিবায়ু। এই মৌসুম বাংলাদেশসহ ভারতের বেশিরভাগ এলাকার ওপর বেশ সক্রিয় রয়েছে। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্পসহ মেঘ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টি ঝড়ছে প্রচুর পরিমাণে। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সপ্তাহজুড়েই বৃষ্টিপাত হবে। ২৯ জুলাইয়ের পর বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। তবে এই সময়ের পর মাত্রা কমলেও থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হবে। এদিকে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী, মুহুরী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতলে স্থিতিশীল রয়েছে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু ও খোয়াই নদীর পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। বুধবার সকাল নয়টার তথ্য অনুযায়ী, ৫২টি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পেয়েছে ৩৭টির। অপরিবর্তিত আছে পাঁচটি নদীর পানি। বিপদসীমার ওপরে রয়েছে একটি নদীর পানি। চট্টগ্রাম অফিস ও স্টাফ রিপোর্টার কক্সবাজার থেকে জানায়, বুধবার কক্সবাজারের ভারি বর্ষণ অব্যাহত ছিল। এ পরিস্থিতিতে উখিয়া- টেকনাফের লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে গড়ে ওঠা বস্তিগুলো রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার শহরে নিহতরা হলো মালয়েশিয়া প্রবাসী জামাল হোসেনের মেয়ে মর্জিনা আক্তার (১৪), কাফিয়া আক্তার (১০), মোঃ আবদুল খায়ের (৮) ও খায়রুন্নেছা (৬)। এই চার ভাইবোনের মা ছেনুয়ারা বেগমকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়িতে মাটিচাপায় নিহত মোঃ মোরশেদ আলম (৬) এলাকার জাকের হোসেনের পুত্র। কক্সবাজার শহরে নিহত চার সহোদরের মামা খোরশেদুল আলম জনকণ্ঠকে জানান, বুধবার ভোর ৬টার দিকে মা ছেনুয়ারা ঘুম থেকে উঠে বাইরে কাজ করছিলেন। এমতাবস্থায় বিকট শব্দ হয়। তিনি দেখতে পান, পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে মাটি ধসে ঘরের ওপর পড়েছে। তখন তিনি চিৎকার দিলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে। মসজিদের মাইকেও প্রচার করা হয়। লোকজন এসে দেখতে পায় পাহাড় ধসে চার শিশু-কিশোরী মাটিচাপা পড়েছে। স্থানীয়রা উদ্ধার তৎপরতা চালায়। ততক্ষণে ঘুমন্ত চার কিশোরী ও শিশু অকুস্থলেই মারা যায়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি পেঁচারঘোনায় পাহাড় ধসের ঘটনাটি ঘটে ভোর ৪টার দিকে। মাটিচাপায় নিহত শিশু পানিরছড়ায় দুই পাহাড়ের মাঝে জাকির হোসেনের বাড়ি। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ভোরের দিকে আংশিক ধসে পড়ে। এতে শিশু মোরশেদ ভেতরে আটকা পড়ে। তাকে উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন পিতা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন অকুস্থলে ছুটে গিয়ে মাটি সরিয়ে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পুলিশ বক্সের ইনচার্জ আপন হোসেন মানিক নিহতের পরিবারের বরাত দিয়ে জানান, পাহাড় ধসে পড়ে বাড়ির ওপর। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে বাড়িটি। এতে বাড়ির শিশুসহ ৩ জন চাপা পড়ে। তাদের উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে এবং আহত দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বাঁকখালী নদী হতে পানির স্রোতে ভেসে আসা অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে বাঁকখালী নদীর ঘাটঘরে পাওয়া যায় ওই ব্যক্তির মরদেহ। পাহাড় ধসের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ লুৎফুর রহমান নিহত পরিবারের কাছে ২০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। রামু উপজেলা প্রশাসন হতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ী বসতঘর হতে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার সকলকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কক্সবাজারে বার বার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউস সংলগ্ন কবরস্থানপাড়ায় পাহাড় ধসে নিহত হয়েছিল ৭ গ্রামবাসী। এ ট্র্যাজেডির ৩ বছর পর বুধবার ভোরে শহরতলির বাঁচামিয়ার-ঘোনায় এবং রামুর মিঠাছড়িতে আবারও পাহাড় ধসে পাঁচ জনের মৃত্যু হলো। পাহাড়ের ওসব ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিলেও প্রশাসনের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখতে দেয়া হয় স্মারকলিপি। শত শত নারী-পুরুষকে জমায়েত করা হয় জেলা প্রশাসন চত্বরে। এতে প্রশাসনের অভিযান শিথিল হয়ে পড়ে। চরম ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা বসতি ॥ এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। টানা ভারি বর্ষণের ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন স্থানীয়রা।
×