ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

জার্মানির জার্সি আর পছন্দ নয় ওজিলের

প্রকাশিত: ০৮:১০, ২৫ জুলাই ২০১৮

জার্মানির জার্সি আর পছন্দ নয় ওজিলের

এমন খেতাব বোধহয় পেলে-ম্যারাডোনার ভাগ্যেও জোটেনি। ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপেই পেয়েছেন বাহারি সব টাইটেল। শুরু জার্মান ক্লাব ওয়েরডার ব্রেমেন থেকে। অখ্যাত এই ক্লাবে ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত খেলেই সর্বপ্রথম নজর কাড়েন ফুটবল বোদ্ধাদের। মাঝমাঠে দুরদর্শী ফুটবলশৈলী দেখিয়ে নাম কামিয়ে নেন ‘জার্মানির মেসি’। এই ক্লাবে উদ্ভসিত নৈপুণ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থান পান জার্মানির বিশ্বকাপগামী দলে। সেখানেও দু’পায়ের ফুটবল কারিশমা দেখিয়ে সকলের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। ফলস্বরূপ বিশ্বকাপ শেষে দলবদলের ডামাডোলে তাকে নিয়ে বেধড়ক টানাটানি! শেষমেশ জার্মান থেকে স্পেনে পাড়ি জমিয়ে নাম কামান ‘রিয়াল মাদ্রিদের মেসি’। এরপর তাঁকে নিয়ে মেতে উঠে স্পেনিশ মিডিয়া নাম দেয় ‘জার্মান জিদান’। পরবর্তীতে নাম লেখানে আর্সেনালে। ২০১৪ সালে জিতেছেন স্বপ্নের বিশ্বকাপ। হ্যাঁ আপনাদের ধারণাই ঠিক। আলোচনা করা হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম আলোচিত উঠতি তারকা মেসুত ওজিলকে নিয়ে। তারকা এই ফুটবলার রবিবার রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে জার্মানি জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়েছেন। গত প্রায় এক যুগ ধরেই জার্মানির ফুটবলে চলছে তারুণ্যের জয়জয়কার। এ সময়ে ফুটবলের পাওয়ার হাউসরা উঠিয়ে এনেছে একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলার। মেসুত ওজিল সেই ঝাঁক থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য এক নক্ষত্র। মাইকেল বালাকহীন জার্মানি যখন ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলার জন্য পাড়ি জমায় তখন অনেকেই বলেছিলেন, এবার ইউরোপ পরাশক্তিদের দৌড় খূব বেশিদূর হবে না। কিন্তু একঝাঁক অদম্য তরুণ নিয়ে একপ্রকার অসাধ্যই সাধন করেছিলেন কোচ জোয়াকিম লো। এরমধ্যে অন্যতম ছিলেন তখনকার ২২ বছর বয়সী তারকা ওজিল। পুরো বিশ্বকাপে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সারাবিশ্বের দৃষ্টি তার ওপর রাখতে বাধ্য করেন। ঘানার বিরুদ্ধে ১৮ গজ দূর থেকে দূরপাল্লার শর্টে গোলসহ ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোলে সহায়তা করেন। মোটকথা পুরো বিশ্বকাপ আসরেই জ্বলজ্বলে ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল তারকাটি। নিজের অভিষেক বিশ্বকাপে যে অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখান তাতে মুগ্ধ হয় পুরো দুনিয়া। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপে আরো বেশি আলো কাড়েন। জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে ভাল করতে না পারায় তাকেই দোষারোপ করা হচ্ছে। তাই তো অভিমানে বিদায়। অথচ বসয়টা খুব বেশি নয়। মাত্র ২৯ বছর। এই সময়েই জার্মান জাতীয় দল ও ক্লাব ফুটবলে মর্যাদার সব ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। অনায়াসেই খেলতে পারতেন আগামী বিশ্বকাপ, চাইলে ২০২৬ বিশ্বকাপও। কিন্তু বড্ড অসময়েই জার্মান জাতীয় দলের জার্সিটা খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওজিল। সুদর্শন এই ফুটবলার জানিয়েছেন, এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে জার্মানি গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয়ার কারণে তাকে অব্যাহতভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে নিয়মিত। এসবকে তিনি বর্ণবাদী ও অশ্রদ্ধামূলক আচরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মূলত এ কারণেই ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী তারকা জার্মান জাতীয় দলকে ‘না’ বলে দিলেন। অসময়ে অবসর হলেও ওজিলের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মারকেল। গত মে মাসে লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সঙ্গে ছবি তুলে সমালোচিত হন ওজিল। ওজিলের দাবি করেন, যখন আমরা জিতি তখন আমি জার্মান, কিন্তু যখন আমরা হারি তখন আমি অভিবাসী। ওজিল জার্মানির ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয়ে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। জার্মানির হয়ে ৯২ ম্যাচে ২৩ গোল করা এই মিডফিল্ডার সমর্থকদের ভোটে ২০১১ সাল থেকে পাঁচবার জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানদের আচরণের কারণে জাতীয় দলের হয়ে আর খেলতে না চাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া লম্বা বিবৃতিতে ওজিল লিখেছেন, তার মনে হচ্ছে কর ও ভাল কাজে অনুদান দিলেও এবং বিশ্বকাপ জিতলেও তাকে জার্মানরা ‘মেনে নিতে পারেনি’। এরদোগানের সঙ্গে ছবি তোলার পর জার্মান ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন (ডিএফবি) কড়া সমালোচনা করেছিল ওজিলকে। চারপাশের আচরণে ক্ষুব্ধ আর্সেনালের এই খেলোয়াড়। ওজিল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার কারণে অনেক কষ্ট নিয়ে অনেক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমি আর জার্মানির হয়ে খেলব না। কারণ বর্ণবাদী এবং অশ্রদ্ধামূলক আচরণের শিকার হয়েছি বলে আমার মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দারুণ গর্ব এবং শিহরণ নিয়ে আমি জার্মানির জার্সি পরতাম, কিন্তু এখন আর না। নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে; আমি ২০০৯ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের পর যা অর্জন করেছি তা ভুলে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। লন্ডনে একটি ইভেন্টে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সঙ্গে দেখা হয় ওজিল ও ইকাই গুন্ডোগানের। ওজিলের মতো গুন্ডোগানও তুর্কি বংশোদ্ভূত। এরদোগানের সঙ্গে দুজনের ছবি প্রকাশ পেলে জার্মানির রাজনীতিবিদরা সমালোচনায় মুখর হন। সমালোচনার মিছিলে ছিলেন জার্মান ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও। ওই ছবির ভেতরে রাজনীতি ছিল না বলে জানান ওজিল। বলেন, এটা রাজনীতি বা নির্বাচন ছিল না; এটা ছিল আমার পরিবারের দেশের সবচেয়ে বড় পদটাকে শ্রদ্ধা জানানো। মূলত বিশ্বকাপের আগে থেকেই ঝামেলার মধ্যে ছিলেন ওজিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে আর্সেনালের জার্সি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন তিনি। তখন থেকেই কড়া সমালোচনা শুনতে হচ্ছিল। বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে জার্মানি বিদায় নেয়ার পর ব্যাপারটি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। ইউরোপের পাওয়ার হাউসদের এমন বাজে পারফর্মেন্সের জন্য ওজিলকেই দায়ী করতে থাকেন সমর্থকরা। তুর্কী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার ঘটনায় গুন্ডোগান প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেও ওজিল এত দিন এটি নিয়ে মুখ খোলেননি। অবশেষে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করেচেন। বলেছেন, এটা কোন রাজনৈতিক সাক্ষাত ছিল না। নিতান্তই সৌজন্যতাবশত সেই সাক্ষাত নিয়ে যে এত কিছু হবে, সেটি কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া ভুলে গেলে চলবে না। আমার দুটি হৃদয়। একটি তুর্কী, অন্যটি জার্মান। তুরস্ক আমার জন্মস্থান। আমি ছোটবেলা থেকে শিখেছি, কখনও নিজের উৎসকে ভুলে গেলে চলে না। তুরস্ক আমার উৎসভূমি। আমার মা আমাকে সেটিই শিখিয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে জার্মানির জার্সিতে খেলছেন ওজিল। ৯২ ম্যাচের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই তারকা ফুটবলার তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। ২০১০ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দিয়ে নিজেকে চিনিয়েছিলেন। এরপরই পাড়ি জমান বিশ্বের সবচেয়ে দামী ও সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। সেখানেও ছিলেন সফল। এরপর ২০১৩ সালে নাম লিখিয়েছেন ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালে। ২০১৪ সালে জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ে রাখেন অসামান্য অবদান।
×