ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

ওয়ানডে ম্যান ফখর জামান!

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ২৫ জুলাই ২০১৮

ওয়ানডে ম্যান ফখর জামান!

রেকর্ডের সৃষ্টিই হয় ভাঙ্গার জন্য। ক্রিকেট তবু মাঝে মাঝে এমন সব ঘটনার জন্ম দেয় তাৎক্ষণিক যেটিকে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর যখন ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন পুরো বিশ্বই অবাক হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি তো এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা! প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে সে তালিকায় নাম লেখানো ফখর জামান গড়েছেন নতুন এক বিশ্বরেকর্ড। রবিবার বুলাওয়েতে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত ৮৫ রানের পথে ওয়ানডেতে দ্রুত ১০০০ রানের মাইলফলকে পা রেখেছেন ২৮ বছর বয়সী বাঁ-হাতি ওপেনার। এর মধ্য দিয়ে পাঁচ ম্যাচের কোন সিরিজে সর্বোচ্চ (৫১৫) রানের নতুন ইতিহাসও গড়েছেন ‘আনপ্রেডিক্টেবেল’ দেশটির সেনসেশনাল এই উইলোবাজ। এলোমেলো করে দিয়েছেন আরও অনেক পরিসংখ্যান...! ৯৮০ রান নিয়ে বুলাওয়েতে কাল জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে খেলতে নামেন। চাতারাকে চার হাঁকিয়ে পূর্ণ করেন হাজার রান। ফখর হাজার রানের মাইলফলক ছুঁলেন মাত্র ১৮ ইনিংসে। আগের রেকর্ড ছিল ২১ ইনিংসে। রেকর্ডটা যৌথভাবে ছিল পাঁচজনের- ভিভ রিচার্ডস, কেভিন পিটারসেন, জোনাথন ট্রট, কুইন্টন ডি কক ও স্বদেশী বাবর আজম। তিন ইনিংস কম খেলেই ফখর গড়লেন নতুন বিশ্বরেকর্ড। সিরিজটা দুর্দান্ত কাটছে। দ্বিতীয় ম্যাচে করেছিলেন সেঞ্চুরি। চতুর্থ ম্যাচে প্রথম পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি । সেদিন ইমাম-উল-হককে সঙ্গে নিয়ে গড়েন ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উদ্বোধনী জুটির বিশ্ব রেকর্ড। রবিবার আরেকও একটি বিশ্বরেকর্ড, এককভাবে। ঠিক এক বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ওয়ানডে অভিষেক ফখরের। অভিষেকের পর থেকেই দুর্দান্ত খেলছেন। জিম্বাবুইয়ে সফরে এই সিরিজে আগের চার ম্যাচে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল - ৬০, ১১৭*, ৪৩* ও ২১০! পাঁচ ম্যাচের দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের কীর্তিও এখন ফখরের দখলে। চলতি সিরিজে তার ব্যাট থেকে এসেছে মোট ৫১৫ রান। আগের এই রেকর্ডটি ছিল হ্যামিল্টন মাসাকাদজার। ২০০৯-১০ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচে জিম্বাবুইয়ে ব্যাটসম্যান করেছিলেন ৪৬৭ রান। আর সর্বোপরি দ্বিপক্ষীয় কোন সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড বিরাট কোহলির। ২০১৭-১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছয় ম্যাচে ভারতীয় অধিনায়ক করেছিলেন ৫৫৮ রান। ফখর এক ম্যাচ কম খেলেই কোহলির পরের জায়গাটি দখল করে নিয়েছেন। আরও কয়েকটি রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন তিনি। ওয়ানডেতে দুই আউটের মাঝে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এখন ফখরের। সিরিজে প্রথম ম্যাচে আউট হয়েছিলেন ৬০ রানে। পরের তিন ম্যাচে করেন অপরাজিত ১১৭, অপরাজিত ৪৩, অপরাজিত ২১০, ও কাল ৮৫। দুই আউটের মাঝে তার রান ৪৫৫। ৪০৫ রানে আগের রেকর্ডটা ছিল আরেক পাকিস্তানী মোহাম্মদ ইউসুফের। এছাড়া ওয়ানডেতে অপরাজিত থেকে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডও এখন ফখরের দখলে। তিনি ছাড়িয়ে গেছেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অপরাজিত থেকে ৩৯৮ রান করা দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনারকে। আগের ম্যাচে ইমামকে নিয়ে ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় উদ্বোধনী জুটির বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন। দু-জন মিলে শেষ ম্যাচে ১৬৮ রানের পথে গড়েছেন আরেকটি রেকর্ড। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে কোন উদ্বোধনী জুটিতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড এখন তাদেরই (৭০৪)। আগের রেকর্ডও ছিল আরেক পাকিস্তানী জুটি ইমরান ফরহাদ ও ইয়াসির হামিদের। ২০০৩-০৪ সালে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ইমরান-ইয়াসির জুটির রান ছিল ৫৯০। সত্যি রঙিন পোশাকে বিস্ময়কর পারফর্মেন্সই উপহার দিয়ে চলেছেন পাক নৌসেনা থেকে ক্রিকেটার বনে যাওয়া ফখর জামান! সিরিজে আগের ম্যাচেই প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরির অনন্য কীর্তি গড়লেন ফখর জামান। বুলাওয়েতে সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে অপরাজিত ২১০ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস উপহার দেন ২৮ বছর বয়সি বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। নির্ধারিত ৫০ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে ৩৯৯ রানের বিশাল স্কোর গড়ে পাকিস্তান। ওয়ানডেতে এটাই দলটির রেকর্ড সর্বোচ্চ দলীয় রান। ব্যক্তিগত ১১৩ রানে আউট হন ইমাম উল হক। ফখর-ইমাম মিলে যোগ করেন ৩০৪ রানÑ ওপেনিং জুটিতে যা নতুন বিশ্বরেকর্ড। টানা তিন জয়ে আগেই সিরিজ নিশ্চিত করা তিন পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান এদিন জিম্বাবুইয়ে বোলারদের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলাই করেছেন। ২২ বলে ঠিক ৫০ রান করে অপরাজিত আসিফ আলি। পরে জিম্বাবুইয়েকে ১৫৫ রানে গুড়িয়ে দিয়ে সরফরাজ আহমেদের দল ম্যাচটা জিতেছে ২৪৪ রানে! বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে ৪২ ওভারে ৩০৪ রান যোগ করেন ফখর ও ইমাম। ওয়ানডে ইতিহাসে এটাই প্রথম তিনশ রানের উদ্বোধনী জুটি। সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে এর চেয়ে বড় জুটি আছে কেবল তিনটি। ওয়ানডেতে আগের সেরা উদ্বোধনী জুটি ছিল ২৮৬ রানের। ২০০৬ সালে লিডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই জুটি গড়েছিলেন শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া ও উপুল থারাঙ্গা। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আগের সেরা উদ্বোধনী জুটির রেকর্ডও ছিল এই দুই জনেরই। ২০১১ সালে পাল্লেকেলেতে তুলেছিলেন ২৮২ রান। উদ্বোধনী জুটি তো বটেই যে কোন উইকেটেই এই প্রথম তিন শ’ ছোঁয়া জুটি পেল পাকিস্তান। আগের সেরা জুটি ছিল ২৬৩ রানের। শারজায় ১৯৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় উইকেটে আমির সোহেলর সঙ্গে সেই জুটি গড়েছিলেন ইমামের চাচা ইনজামাম-উল-হক। আর উদ্বোধনী জুটিতে পাকিস্তানের আগের সেরা ছিল ২২৮ রান। হারারেতে ২০১১ সালে জিম্বাবুইয়ের অবিচ্ছিন্ন সেই জুটি গড়েছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ ও ইমরান ফারহাত। ১২২ বলে ৮ চারে ১১৩ রান করে ইমাম ফিরলে ভাঙে ৪২ ওভার স্থায়ী উদ্বোধনী জুটি। যেখানে ফখর প্রথম পাকিস্তনী হিসেবে তুলে নেন ডাবল সেঞ্চুরি। ৩৯৯/১Ñওয়ানডেতে এটাই তাদের দলীয় সর্বোচ্চ। ১৫৫ বলে ২৪ চার ও ৫ ছক্কায় ২১০ রানে অপরাজিত থাকেন ফখর। সর্বোপরি ওয়ানডে ইতিহাসে এটি পঞ্চম ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এ নিয়ে সাত ম্যাচে ইনিংস উদ্বোধন করলেন ফখর ও ইমাম। তার তিনটিতেই পেলেন তিন অঙ্কের দেখা। পাকিস্তানের হয়ে উদ্বোধনী জুটিতে তাদের চেয়ে বেশি- চারটি করে সেঞ্চুরি আছে কেবল ফারহাত ও ইয়াসির হামিদ এবং হাফিজ ও নাসির জামশেদের। সাত ইনিংসে ১০১.৪২ গড়ে ফখর-ইমাম জুটির রান ৭১০। তিনটি সেঞ্চুরির সঙ্গে আছে তাদের দুটি পঞ্চাশ ছোঁয়া জুটি! কুইন্স পার্কে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা পাকিস্তানের হয়ে শুরুতে অতটা মারমুখী ছিলেন না ফখর। স্ট্রোকের পেখম খুলেছেন ধীরে ধীরে। ফিফটি তুলে নিয়েছেন ৫১ বলে। আর সেঞ্চুরি পেতে লেগেছে ৯২ বল। ওয়ানডেতে পাকিস্তানের হয়ে আগের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটা ছিল সাঈদ আনোয়ারের। ১৯৯৭ সালে চেন্নাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ১৯৪ রান করেছিলেন সাবেক তারকা ওপেনার। বুলাওয়েতে ম্যারাথান ডাবল সেঞ্চুরির পথে ২১ বছরের সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন এক ইতিহাস গড়লেন আরেক বা-হাতি ওপেনার ফখর জামান।
×