ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানকে যে কারণে বেছে নিয়েছিল জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৫ জুলাই ২০১৮

হলি আর্টিজানকে যে কারণে বেছে নিয়েছিল জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ যে কারণে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিকে জঙ্গীরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল তার নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে এসেছে চার্জশীটে। গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার যে হোটেল রেস্টুরেন্টে বেশি বিদেশী নাগরিকের অবস্থান থাকতো সেই ধরনের একটিকেই বেছে নিতে চেয়েছেন নব্য জেএমবির প্রধান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। একসঙ্গে একাধিক বিদেশী নাগরিককে হত্যা করে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে অস্ত্র ও অর্থ পাওয়ার আশা করেছিল জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি। জঙ্গী সংগঠনটি পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীতে হোটেল-রেস্তরাঁ রেকি করে অবশেষে বেছে নেয় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিটি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সোমবার আদালতে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার দেয়া চার্জশীটে বলেছে হামলা করার দুই-তিনদিন আগে বেছে নেয়া হয় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিটি। গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়ক ধরে সোজা পূর্বদিকে গেলে শেষ মাথায় গুলশান লেকের পাড়ে ৫ নম্বর প্লট। এখানে ২০১৪ সালের জুন মাসে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ এবং ‘ও কিচেন রেস্তরাঁ’। ভবনটির ওপরের তলায় ছিল বেকারির রান্নাঘর এবং মালামাল রাখার ঘর। আর নিচতলায় বেকারির বিক্রয় কেন্দ্র, রেস্তরাঁর রান্নাঘর এবং রেস্তরাঁর অতিথিদের বসার জায়গা। সামনে সবুজ লন। অতিথিদের সংখ্যা বেশি হলে দোতলায়ও বসার ব্যবস্থা করা হতো। সারাদিন দেশী-বিদেশী ক্রেতার যাতায়াত ছিল বেকারিতে। সামনের সবুজ লনে অনেকেই মেতে উঠেছিলেন আড্ডায়। লেকপাড়ের সবুজ লনযুক্ত এই বেকারি ছিল বিদেশীদের কাছে খুবই প্রিয়। খোলা থাকত সপ্তাহের সাতদিনই। শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টায় খুলত আর বন্ধ হতো রাত ১০টায়। ওই দুইদিন এখানে সকালের নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বাকি পাঁচদিন খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। হলি আর্টিজানে যারা খেতে আসতেন তাদের ৮০ শতাংশই বিদেশী। বেকারিতে ইতালিয়ান বিভিন্ন ধরনের কেক ও রুটি জাতীয় খাবার আর রেস্তরাঁয় মূলত স্প্যানিশ খাবার বানানো হতো। অন্তত ৫০-৬০ জন অতিথি থাকতেন নিয়মিত। তবে ওইদিন রোজার শেষদিকে ছিল বলে অতিথির সংখ্যা কমে এসেছিল। বুকিং ছিল ২৪-২৫ জনের। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল দ্বিগুণের বেশি। অতিথিদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল স্যামন মাছ, কোরাল মাছ, স্প্যানিশ খাবার পায়লা, কালামার ও গামবাস। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিৎজাও খেতেন অনেকে। ১০-১৫ ধরনের সালাদ ছিল যা খেতেন খুব আগ্রহভরে অতিথিরা। কারণ হলি আর্টিজানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন ছিল না। এছাড়া এই হামলার পর পালানো সহজ হবে মনে করে জঙ্গীরা। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার চার্জশীটে বলা হয়েছে, বসুন্ধরার বাসায় বসে হামলার দিন দুপুরে হামলাকারীদের সর্বশেষ বয়ান দিয়েছিল সারোয়ার জাহান মানিক। তিনি হামলকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা হতাশ হবে না। একজনের গুলি শেষ হলে অন্যজন ব্যাকআপ দেবে। মনে রাখবে, আমাদের হারানোর কিছু নেই। অপারেশনের সময় তাড়াহুড়ার দরকার নেই। খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবে। আর মুশরেকদের দয়া দেখাবে না। এমনকি সে যদি সাংবাদিকও হয়। সর্বদা জিকিরের মধ্যে থাকবে। যদি কেউ বন্দী হয়ে যাও তাহলে নিজে নিজেকে শেষ করে দেবে। আর একটা জিনিস মনে রাখবে, হলি আর্টিজানের গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই আমরা সফল। কারণ বিশ্ব জেনে যাবে যে, বাংলাদেশেও হামলা হয়েছে। তাই শুধু হামলা হলেই আমরা সফল হব’। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার্জশীটে হামলার পরিকল্পনা ও কারণ তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। হলি আর্টিজানে হামলা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে অস্ত্র, অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়া যাবে, জঙ্গীদের এমন ধারণা ছিল বলে দাবি করেছেন সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম। গুলশান-বনানীতে কোন হোটেল-রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলা করলে বেশি বিদেশী নাগরিককে জিম্মি করে হত্যা করা যাবে সেইটা বিবেচনায় নেয় জঙ্গীগোষ্ঠী। হামলার ২-৩ দিন আগে নির্বাচন করা হয় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিকে। হামলার আগে তামিম চৌধুরী নিজে, নূরুল ইসলাম মারজান ও আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও বাশারুজ্জামান চকোলেটকে নিয়ে এসব জায়গা রেকি করেছে। এ সময় নূরুল ইসলাম মারজান প্রথম জানায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করলে বেশি বিদেশী মারা যাবে। পরে হলি আর্টিজান রেকি করার পর সেখানেই হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তামিম।
×