ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রেডিট কার্ডে লাগামহীন চার্জ

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৫ জুলাই ২০১৮

ক্রেডিট কার্ডে লাগামহীন চার্জ

রহিম শেখ ॥ নিয়মানুযায়ী ব্যাংক যে খাতে সর্বোচ্চ সুদ আদায় করবে ক্রেডিট কার্ডে তার চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি সুদ বা চার্জ আদায় করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কোন কোন ব্যাংক ১৫ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বেশি সুদ আদায় করছে। এ আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে সম্প্রতি ১৮টি ব্যাংককে জবাবদিহিতার আওতায় এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে ৩২টি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে উচ্চ সার্ভিস চার্জ নেয়ার অভিযোগ ছিল। সার্ভিস চার্জ গ্রহাকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটি গাইডলাইন দেয়া হয়। এতে বলা হয় ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড বাদে অন্য সেবাগুলোর মধ্যে যে সেবায় সর্বোচ্চ সুদ বা চার্জ আরোপ করে তার চেয়ে ৫ শতাংশের বেশি মুনাফ বা চার্জ আদায় করা যাবে না ক্রেডিট কার্ডের ওপর। যেমন, একটি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদ আদায় করে ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ২৩ (১৮+৫) শতাংশের বেশি সুদ বা চার্জ আদায় করা যাবে না। গত ১ জানুয়ারি থেকে এ নীতিমালা পরিপালনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। গত মে মাসে ব্যাংকগুলোর ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হার বিবরণী পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায় ৩২টি ব্যাংকের মধ্যে ১৮টি ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা মানেনি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে আলোচ্য ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করেছে ক্রেডিট কার্ডের ওপর। এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ সুদ আদায় করেছে ওয়ান ব্যাংক সাড়ে ৩১ শতাংশ। অন্য খাতে সর্বোচ্চ সুদ আদায় করা হয় ১৮ শতাংশ। এতে সর্বোচ্চ সুদের সঙ্গে পার্থক্য হয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ, যা ৫ শতাংশের নিচে থাকার কথা ছিল। এ ভাবে সর্বোচ্চ সুদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য হয়েছে এনসিসি ব্যাংকের ১৬ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১৫ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের ১৩ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১২ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংকের সাড়ে ১১ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের সাড়ে ১০ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের সাড়ে ৯ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯ শতাংশ, মধুমতি ব্যাংকের সাড়ে ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো সর্বমোট ৯ লাখ ৮০ হাজার ৭৩৫টি ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের দিয়েছে। সর্বশেষ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, ব্যাংকগুলো খাতভেদে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে। এর মধ্যে এসএমই ও ভোক্তা ঋণের সুদহার অনেক বেশি। ব্যাংকভেদে তা ১৫ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে এর সঙ্গে ৫ শতাংশ যোগ করে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডে সুদ আদায় করতে পারে। কিন্তু অনেক ব্যাংক বর্তমানে এ গাইডলাইন ভঙ্গ করে আরও বেশি সুদ আদায় করছে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ায় ব্যাংকগুলোও এটিকে তাদের বাড়তি আয়ের সেবা হিসেবে বেছে দিয়েছে। এ জন্য এ সেবার ওপর তারা নানা ধরনের ফি ও চার্জ আরোপ করছে। আদায় করছে বাড়তি সুদ। এ বিষয়ে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে প্রায়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নানা অভিযোগ আসছে। এগুলো তদন্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সত্যতাও পাচ্ছে। ফলে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় এ খাতে হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে এ খাতে সুদের হার বেঁধে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের সর্বোচ্চ সুদের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি সুদ এ খাতে নিতে পারবে। অর্থাৎ কোন ব্যাংকের কোন ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদ ১৮ শতাংশ হলে তারা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে নিতে পারবে সর্বোচ্চ ২৩ শতাংশ। কোন ক্রমেই এর বেশি সুদ দিতে পারবে না। আর ব্যাংকগুলো ঘোষিত সর্বোচ্চ সুদের হার ১৮ শতাংশ। এর বেশি নেয়ার কোন সুযোগও নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা মানছে না। তারা ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ২৭ থেকে ৩২ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। এর বাইরে রয়েছে আরও ২০ ধরনের চার্জ ও কমিশন। এগুলো মিলে সুদের হার গড়ে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়। অর্থাৎ ১০০ টাকা খরচ করলে ৪০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। টাকা খরচের ৩০ বা ৪০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করে দিলে কোন সুদ দিতে হয় না বলে ব্যাংকের যে প্রচার রয়েছে সেগুলোতেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ফলে ক্রেডিট কার্ড সেবা নিতে ব্যাংকের সুদ ও চার্জ থেকে গ্রাহকরা কোন বাড়তি ছাড় পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্রেডিট কার্ডের সেবার বিপরীতে গ্রাাহকদের কাছ থেকে আগ্রাসী সুদ আদায় করছে অধিকাংশ ব্যাংক। গত এপ্রিলের হিসাবে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৮.৫ থেকে ৩১.৫ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ৩০ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ৩০ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল ১৬ থেকে ৩০ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক ২৭ শতাংশ এবং ব্র্যাক ব্যাংক ২৪ থেকে ২৭ শতাংশ সুদ আদায় করেছে। এর বাইরেও আছে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন। এ বিষয়ে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এসএম মাসরুর আরেফিন বলেন, সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে তারা সীমার মধ্যেই রয়েছেন। ক্রেডিট কার্ড সেবার খরচ বেশি থাকার কারণে এ খাতে সুদের হারও বেশি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ আদায় করে। এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ডে প্রাথমিক খরচ বাবদ দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, বার্ষিক ফি ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, কার্ড পুনঃস্থাপন ফি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা, বিলম্বে পরিশোধ ফি ৩০০ থেকে ৭৫০ টাকা, অতিরিক্ত সীমা ফি ৪৫০ থেকে এক হাজার টাকা, চেক বা অটো ডেবিট রিটার্ন ফি ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা, ডুপ্লিকেট স্টেটমেন্ট ফি ১০০ টাকা, চার্জ স্লিপ রিট্রায়েভাল ফি ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা, পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি ৩০০ টাকা, সিআইবি প্রসেসিং ফি ১০০ টাকা, এনওসি সার্টিফিকেট চার্জ ৫০০ টাকা, একসেস টু এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ফি ২ হাজার টাকা, কার্ড চেক ফি ২৫০ টাকা, চেক প্রসেসিং ফি কার্ড চেকের মূল টাকার ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এসএমএস ব্যাংকিং ফি বছরে ২০০ টাকা, ফিন্যান্স চার্জেজ প্রতি মাসে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, নগদ ঋণ ফি অন্যান্য এটিএম খরচের ৩ শতাংশ, ইন্স্যুরেন্স ফি শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ, প্রিন্টেড স্টেটমেন্ট ফি ৫০ টাকা এবং পিওরিটি পাস রি-ইস্যু বাবদ ৫০০ টাকা ফি কাটা হয়। পুরো খরচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতের ভ্যাটও পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে।
×