ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

জীবিকার প্রয়োজনে শেষ অবলম্বন

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৫ জুলাই ২০১৮

জীবিকার প্রয়োজনে শেষ অবলম্বন

১৯৪৯ সালের অক্টোবরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর দেশে পতিতাবৃত্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘদিন ধরে পতিতাবৃত্তিকে এক ধরনের শোষণ বলে অভিহিত করেছিল এই পেশায় জড়িত নারীদের ভাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ক্ষমতা দখলের পর পার্টি এই শ্রেণীর মেয়েদের অভিশপ্ত জীবন থেকে উদ্ধার করে। প্রথম কিছুদিন ওদের বিভিন্ন কেন্দ্রে রেখে চিন্তার সংস্কার করা হয়। পরে অর্থনীতির বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করা হয়। অচিরেই চীনে দেহ ব্যবসা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু চীন দেশ ও সমাজের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখলেও সেদিন থেকে পার্টির আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে পুঁজিবাদের পথে পা বাড়ায় সেদিন থেকে পতিতাবৃত্তির প্রত্যাবাসন ঘটতে শুরু করে। ১৯৭৮ সালে অর্থনীতির উদারিকীকরণের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের পুনর্বাসন ঘটতে থাকে। এ সময় সরকার বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করে। গ্রাম থেকে শহরে আগমনের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করে। গ্রামের নারীরা বেশি বেতনের কাজ সন্ধানের এই সুযোগ নেয়। হংকং, তাইওয়ান ও অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীরা ডংগুয়ানসহ বিভিন্ন স্থানে এসে জড়ো হয়ে কলকারখানা তৈরি করতে শুরু করে। নারীদের অনেকে নতুন নতুন কলকারখানায় চাকরি পেয়ে যায়। কেউ কেউ নতুন রেড-লাইট এলাকা তথা পতিতালয়ে কাজ খুঁজে নেয়। কালক্রমে ডংগুয়ান হয়ে ওঠে চীনের নতুন সেক্স ক্যাপিটাল বা দেহ ব্যবসার রাজধানী। দক্ষিণাঞ্চলীয় এই নগরীতে হাজার হাজার যৌনকর্মী এসে ভিড় জমায় এবং ব্যবসা ফেঁদে বসে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা কলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারী ও অন্যান্য পেশার মানুষকে যৌন কামনার পরিতৃপ্তি দিতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে। স্থানীয় সরকার সব ধরনের পাপাচারের বিরুদ্ধে প্রবল অভিযান শুরু করার পর। শুধু প্রথম দিনেই প্রায় ৬ হাজার পুলিশ ২ হাজার সাউনা, কারায়োকে বার এবং এ জাতীয় বিভিন্ন নামে পরিচালিত দেহ ব্যবসার কেন্দ্রগুলোতে হানা দিয়ে বহু কর্মচারী ও তাদের খদ্দেরকে গ্রেফতার করে। কিন্তু নারী মাংসের স্বাদ যারা পেতে চায় তাদের চিন্তার কারণ নেই। চার বছর পর তারা এখনও ডংগুয়ানে সেক্স কিনতে পারে- যেমনি পারে গোটা চীনে। দেহ ব্যবসায়ীদের অনেকেই আগে অভিজাত হোটেল ও সুপার সাউনাতে কাজ করত। এখন তারা মূলত গোপনে এই ব্যবসা করে। এ কাজে তাদের সাহায্য করে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা। আরোহীকে সে হয়ত টোপ দিয়ে বসে তার পরিচিত কোন নারীর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য। যাদের টোপ গেলার তারা গেলে। যোগাযোগ হয় এবং এমনিভাবে ব্যবসা চলে। কিন্তু তার পরও নগর কর্মকর্তারা এই ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযানে যতটুকু যা সাফল্য অর্জন করেছেন অনেকে তা আশাও করেননি। তারা তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এতে পাপের নগরী হিসেবে পরিচিত ডংগুয়ানে এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে আগত অনেক মেয়ে বাইরের এই ব্যবসা ছেড়ে আবার গ্রামে ফিরে গেছে। তাই বলে তো চীনে দেহ ব্যবসা নির্মূল হয়ে যায়নি। বিশেষজ্ঞ হিসেবে চীনে কয়েক লাখ যৌনকর্মী আছে যাদের বেশিরভাগই মহিলা। এই ব্যবসার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযান পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও গণিকাবৃত্তি চীনে অধিকতর প্রচলিত রূপ ধারণ করেছে। বেজিংয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ থেকে দেখা গেছে যে দেহ ব্যবসায়ে সংশ্লিষ্ট নারীকে উপভোগ করেছে বলে স্বীকার করা পুরুষের সংখ্যানুপাত ২০১৫ সাল পর্যন্ত এক দশকে দ্বিগুণ হয়ে প্রতি ৭ জনের একজন হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ এই অনুপাত ৬ জনে ১ জন হবে বলে জরিপকারীদের ধারণা। চীনে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তানই ঐতিহ্যগতভাবে অধিকতর কাম্য হওয়ার কারণে কমেছে। এই ঐতিহ্য অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে গর্ভের মেয়ে ভ্রƒণটিকে নষ্ট করে ফেলা হয়। লিঙ্গ অনুপাতের সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করে পরিবারে এক সন্তান নীতি অনুসরণের কারণে। অবশ্য এই নীতি বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে। যাইহোক, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় স্ত্রী হিসেবে জীবনসঙ্গী জুটিয়ে নিতে না পারা পুরুষদের বাণিজ্যিক সেক্সের। চীনে বেশিরভাগ যৌনকর্মী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করার চাইতে স্বাধীনভাবে এই ব্যবসা করার পথ বেছে নেয়। আবার কেউ কেউ এটাকে চাকরি হিসেবে নেয় যেমনটি সাধারণত বাঞ্ছনীয় মনে করে গ্রাম থেকে আগত গরিব মেয়েরা। দেহ ব্যবসায়ে আসার পেছনে তাদের যুক্তি হলো হোক এটা বেআইনী, তথাপি এতে টকিা পয়সা যোগানোর ভাল সুযোগ পাওয়া যায়। অন্যরা উপায়ন্তর না দেখে জীবিকার প্রয়োজনে শেষ অবলম্বন হিসেবে এই পেশায় আসে। চীনের যৌন ব্যবসার ওপর গবেষণা করেছেন লিজিয়া ঝাং। তিনি লিখেছেন যে দেশের সীমিত সামাজিক নিরাপত্তা জালের বাইরে যারা পড়ে যায় সেই সব বেকার এবং অত্যাচারী স্বামীদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো নারীদের দেহ ব্যবসায়ে নামা ছাড়া বিকল্প পথ খুব সামান্যই আছে। চীনে দেহ ব্যবসায়ের শাস্তি অতি কঠোর। যৌনকর্মী ও তাদের খদ্দেরদের জরিমানা হতে ও বিনাবিচারে ১৫ দিন পর্যন্ত জেল হতে পারে। বার বার এ কাজের জন্য ধরা পড়লে তাকে আটক ও শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়ে থাকে। এটা এক ধরনের জেলখানা যেখানে তাদের দু’বছর পর্যন্ত আটক রাখা হতে পারে। মেয়ের দালালদের কারাদ- হতে পারে ১০ বছর পর্যন্ত। জনসমক্ষে লজ্জা ও অপদস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে কম। আগে যৌনকর্মী, খদ্দের ও দালালদের পুলিশ রাস্তায় প্যারেড করিয়ে নিয়ে বেড়াত। এটাই ছিল তাদের শাস্তির অতি প্রচলিত রূপ। ২০১০ সালে সরকার পুলিশের এ ধরনের কর্মকা-ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পুলিশের আরও একটা রেওয়াজ আছে যে ম্যাসেজ পার্লার, চুল কাটার সেলুন বা কারাওক ক্লাবে হানা দিলে যদি কনডম ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সেখানকার মহিলা কর্মী দেহ ব্যবসায়ে লিপ্ত বলে তারা ধরে নেয়। এতে যৌনকর্মী কনডম ব্যবহার করতে বা রাখতে চায় না। এতে তাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ে। এমন কাহিনী প্রচুর আছে যে পুলিশ হঠাৎ করে হানা দিলে যৌনকর্মীরা ব্যবহৃত কনডম গিলে ফেলে। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, এসব দমন অভিযানের ফলে দেহ ব্যবসা সম্পর্কিত পুলিশী তদন্তের ঘটনা যেখানে ২০০১ সালে তুঙ্গে পৌঁছেছিল তা এখন দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। এর একটা কারণ হলো পুলিশ তাদের আদায় করা জরিমানার অর্থের একাংশ যেখানে কেটে রাখতে পারত এখন আর তা পারে না। এর ফলে তারা ছোটখাটো অপরাধীকে ধরার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। আটক ও শিক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যাও কমে এসেছে। ২০০০ সালে ছিল ১৮৩টি। এখন ১১৬টি। অনাচার বিরোধী অভিযানে না থাকলে কর্মকর্তারা এসব অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। বেজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে ইং ইং নামে এক মহিলা সেক্স বিক্রি করে এমন এক রুম থেকে যার দরজাটা সরাসরি কর্মব্যস্ত একটা লেনের দিকে খোলা যায়। রুমের একদিকে চুল কাটার জন্য একটা চেয়ার আছে যেখানে তিনি মাঝে মাঝে চুল কাটার কাজও করে থাকেন। রুমের আরেক দিকে আছে একটা সিঙ্গেল বেড যা লুকানো থাকে ছাদ থেকে ঝুলন্ত এক ভারি পর্দার আড়ালে। প্রতিবেশীরা জানে ওখানে কি হয়। পুলিশ অফিসাররাও জানে। কিন্তু জেনেও না জানার ভান করে। মহিলাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে পুলিশ অফিসাররা মনে করে তাঁর এই ছোটখাটো ব্যবসা পুলিশের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না। মাঝে মধ্যে দেহ ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালানো হয় তখন অবশ্য ভিন্ন কথা। একবার এমন এক অভিযানের সময় স্থানীয় অফিসাররা তাকে সেলুনের সাইন বোর্ড নামিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিল। ডংগুয়ানের কিছু কিছু অধিবাসীর ধারণা, কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্স ব্যবসাকে টার্গেট করার উদ্দেশ্য যত না দেহ ব্যবসাকে নির্মূল করা তার চেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শায়েস্তা করা। ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে শি জিনপিংয়ের একটা ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, সরকার পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দেয়ার কথা ভাবতে ইচ্ছুক। কিন্তু কিছু কর্মকর্তা হয়ত স্বীকার করেন যে যৌন ব্যবসা একটা সামাজিক অভিশাপ ছাড়া কিছুই না যা কমিউনিস্ট পার্টি সেই কোন্ যুগ থেকে বলে আসছে। তবে পার্টি অনেক সময় তার বিকশিত ভূমিকা পরিবর্তন করতে অনেক দেরিও করে থাকে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে আশঙ্কা করে। যেমনÑ এক সন্তান নীতি। মিডিয়ার ওপর শি জিনপিংয়ের নিয়ন্ত্রণ এত কঠোর যে পতিতাবৃত্তি নিয়ে মিডিয়াও প্রকাশ্যে আলোচনা করতে তেমন একটা উৎসাহিত বোধ করে না। চীনের সাংবাদিকরা সেক্স, লিঙ্গ বা যৌন রোগের মতো বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করতে অনীহা বোধ করে। নামজাদা একাডেমিক সাময়িকীগুলোতে সেক্স সংক্রান্ত গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করা কঠিনতর হয়ে উঠেছে। তবে চীনে যৌন ব্যবসার যতই দৃশ্যপটে আড়ালে চলে যাচ্ছে ততই আবার তার প্রসারও ঘটে চলেছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×