সাংবাদিক বেবী মওদুদ। আমাদের বেবী আপার আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, বড় বোনের প্রতীক। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করতাম বেবী আপার অধীনে। তাঁর স্নেহধন্য হওয়ায়, বহু স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সম্প্রতি এক অগ্রজ সাংবাদিক বেবী আপা সম্পাদিত ‘সততা ও দেশপ্রেমের জয়’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ আমাকে দিয়ে বললেন, দুলাল এই বইয়ে তোমার একটি লেখা আছে তথ্যনির্ভর- যা গবেষণায় কাজে লাগবে। বইটির প্রকাশিত হয়েছিল তপন মাহমুদের বিজয় প্রকাশ থেকে। বইটির ৮০ নং পৃষ্ঠায় ‘শেখ হাসিনার বিদেশে ৫২ দিন’ লেখাটি দেখে মনে পড়লÑ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায় সরকারের সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা জারির পর প্রতিদিনের কর্মসূচী নিয়ে পত্রিকার শিরোনাম। ১৯৯৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রকাশের পর আমি সেখানে যোগ দেই। সেই থেকে সিআরআইসহ এ রকম বহু কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ বেবী আপা আমাকে দিয়েছিলেন।
বেবী মওদুদ নানা পরিচয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নারীনেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী নানা অভিধায় তাঁকে মূল্যায়ন করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। নব্বই দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে ‘সাপ্তাহিক ললনা’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’ ও ‘বিবিসি বাংলা’য় কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ‘বাংলা বিভাগ’টি গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও। জীবনের শেষদিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের সোশ্যাল এ্যাফেয়ার সম্পাদক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন বেবী মওদুদ।
তিনি প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর আলাদা পরিচয় ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- মনে মনে (ছোটগল্প), শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, দীপ্তর জন্য ভালবাসা, পবিত্র রোকেয়া পাঠ, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, শান্তুর আনন্দ, এক যে ছেলে আনু, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার, আমার রোকেয়া ও কিশোর সাহিত্যসমগ্র, নিবন্ধসমগ্র ‘অন্তরে বাহিরে’। বিচিত্রার শেষের পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সঙ্কলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিল। শিশুতোষ বই ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বেবী আপার ছোট ছেলে শফিউল হাসান দীপ্তর (পুটু) জীবনের ছায়া অবলম্বনে। কাহিনী একজন প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার। লেখাটির প্রুফ দেখতে গিয়ে আমি অনেকবার কেঁদেছি। দীপ্তর জন্য ভালোবাসা বইটি ছোটদের জন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত হতে পারে।
বেবী আপা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথমদিককার কাজগুলোতে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম। আত্মজীবনী বাংলায় বিচিত্রা অফিসে কম্পোজের পর ইংরেজী করার জন্য ফখরুল স্যারের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বাসায় আমি পৌঁছে দিতাম।
বেবী আপার কাছে এক বড় আবেগের জায়গা ছিল শেখ হাসিনা। সুধাসদনকে মনে করতেন তাঁর সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন সুধাসদনে যাওয়া যেন বেবী আপার রুটিন ছিল। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তিনি প্রচ-ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। নিঃসঙ্গ মনে হতো তাঁকে। অসহায়ের মতো বিচিত্রা অফিসে আসতেন। সে সময় এক অজানা আতঙ্ক তার মাঝে বাসা বাঁধে। বিচিত্রা অফিসের চারদিকে সব সময়ই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ঘুর ঘুর করত। বিষয়টা আমরা বুঝতে পারতাম। সে সময় অনেকেই নানা রহস্যজনক কারণে বিচিত্রায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি আয়ের উৎস যে বিজ্ঞাপন তাও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল তখন। একদিন বেবী আপা বললেন, আর পারছি না। পত্রিকাটি বুঝি আর চালানো যাবে না। এক সময় গোয়েন্দাদের নজরদারি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে ছিল যে, নিজেকে আর নিরাপদ মনে করতেন না তিনি। তাই বিচিত্রা অফিসে আসা বন্ধ করে দেন। সে সময় তিনি কোথায় অবস্থান করতেন তা কেবল বিচিত্রার অফিস সহকারী মনির জানত। তাঁর এই আত্মগোপনের সময় অফিসের বিশেষ প্রয়োজনে মনিরকে সঙ্গে নিয়ে দুবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল আমার।
বিচিত্রার শেষ দিনকার কথা, একদিন সকালে মনির আমাকে বেবী আপার হাতের লেখা একটি চিঠি দিলো। সে চিঠির মাধ্যমে পত্রিকাটি তিনি স্থগিত ঘোষণা করেছেন। চিঠিতে লিখলেন, ‘যে যেভাবে পার কিছু করে বাঁচ। যদি কোনদিন সুদিন আসে সবাইকে ডেকে আনা হবে।’ চিঠিটি পেয়ে আমরা মিটিং করি, বেবী আপার সিদ্ধান্ত সবাইকে জানাই। ৩০ সেপ্টে¤া^র ২০০৭ থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রা স্থগিত ঘোষণার তারিখ নিধারিত হয়। ২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তন হলেও বিচিত্রা আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১০ সালের ঘটনাÑ অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘নিঃসঙ্গ কারাগারে শেখ হাসিনার ৩৩১ দিন’ বইটি প্রকাশের পর বেবী আপা একদিন আমাকে খবর পাঠালেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। একদিন সন্ধ্যায় তখনকার লালমাটিয়ার বিডিনিউজ অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে একটি খাম দিয়ে বললেন এটা রাখ, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে লেখক সম্মানি দিয়েছে। আমি তো অবাক! বেবী আপা বিষয়টা বুঝতে পারলেন, তিনি ড্রয়ার থেকে একটি বই বের করে বললেন নাও। এখানে প্রথম দিককার লেখাগুলো তোমার।
বেবী আপার মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে বাসসের বাংলা বিভাগে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তখন বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এহসানুল করিম হেলাল। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব। বিচিত্রার সুবাদে হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের এক সময় বেশ যোগাযোগ ছিল। নিয়োগ বোর্ডের অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। আপাকে বললাম, আপনি সুপারিশ করলে আমার চাকরিটা হবে। কারণ, ইন্টারভিউ পর্বটি ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। বেবী আপা তখন আক্ষেপ করে বললেন, দুলাল এখানে কেউ আমার কথা শোনে না। সেদিন অসহায়ের মতো বেবী আপার উক্তিটি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি তাঁর কথার অর্থ। পরে বুঝেছি ইচ্ছে থাকলেও যে তাঁর সাধ্য ছিল না। তারপরও আমি আশাবাদী ছিলাম বাসসে আমার চাকরি হবে, কিন্তু দুর্ভাগ্য নিয়োগ কর্তাদের আপনজন হওয়ার সুযোগ আমার হয়নি।
সীমিত আয় দিয়েও যে কিভাবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করা যায়; এই বিষয়টি আমরা বিচিত্রার অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কতটা আনন্দের হতে পারে বেবী আপাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করেছি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘জীবনে যত বেশি চাহিদা থাকবে জীবন তত জটিল হবে। তাই চাহিদাকে কমিয়ে এনে জীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোল।’ বেবী আপা, আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা কখনই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তার কাছে শিখেছি। আজ মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বেবী আপাকে।
[email protected]