ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদ্ধ সময় এবং মুক্তবুুদ্ধির চর্চা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৫ জুলাই ২০১৮

আবদ্ধ সময় এবং মুক্তবুুদ্ধির চর্চা

আঠারো শতকে ফরাসী বিপ্লবের দার্শনিক পটভূমি সেখানকার মানুষদের মন আলোকিত করেছিল বলেই দ্রুত বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। সে যুগ ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে এজ অব এনলাইটেনমেন্ট হিসেবে। ফরাসী বিপ্লব শ্রেণী শোষণ বা ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করেনি, সামন্ততন্ত্রকে আঘাত করেছিল এবং সে সময় তাই ছিল তার প্রগতিশীল ভূমিকা। এর অশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ফ্রান্সের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের চেতনাকে শুধু নয়, গোটা ইউরোপকে এ বিপ্লব আলোড়িত করেছিল। ভাববাদী দর্শনের জায়গায় বস্তুবাদী দর্শন প্রতিস্থাপনের পথ তৈরি করেছিল। রুশো, দিদারো, এলেমবাট, হলবাক, ভলতেয়ার হেলবেটিয়াসরা ছিলেন সে সময়ের বস্তুবাদী দার্শনিক। সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এদের মতাদর্শিক সংগ্রাম চার্চ ও যাজকতন্ত্রের বাইরে এসে বিজ্ঞান মনস্কতার পথ দেখায়। সে পথ বেয়ে তারা পৌঁছেছে আধুনিকতার শীর্ষে। আঠারো শতকের আগে আরেক বস্তুবাদ ধর্ম ও ঈশ্বরতন্ত্র আঁকড়ে বিকশিত হয়েছিল ব্রিটেনে। ফরাসী বস্তুবাদ থেকে যা একেবারে আলাদা। যে কোন সমাজ বিকাশের পেছনে দর্শন ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার ভূমিকা অপরিহার্য। এ উপমহাদেশে তথাকথিত সভ্যতা ভব্যতার পাঠ এসেছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। রাজনীতির প্রায়োগিক পাঠও। প্রাচ্য দর্শনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এখানে থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে তার যোগ কখনই ছিল না। ব্রিটিশ বস্তুবাদের ভাবশিষ্য হয়েই এখানকার রাজনীতি এগিয়েছে। বিভাজনের রাজনীতি সেই যে তারা শিখিয়ে দিয়ে গেছে এ দেশে তার জের চলছে এখনও। অবিভক্ত ভারত তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর এদের বিকাশের গতি হয়েছে তিন রকম। ভারত বিভাজনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য বেড়েছে পাকিস্তানের। ভারতকে চাপে রাখার নেপথ্য কৌশলের এ সখ্য পাকিস্তানকে নিজেদের অনুগত করে এ অঞ্চলে সমাজতন্ত্রবিরোধী বলয় তৈরিতে ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কাজে তুরস্ক ও ইরান ছিল পাকিস্তানের সহযোগী এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। পাকিস্তান যখন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে আঁস্তাকুড়ে তলানোর বন্দোবস্ত করছে, ভারত তখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বিকাশ, ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির পাঠ নিয়ে পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছে। নিজস্ব শিল্প ভিত্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন ভারতের রাজনীতিকেও স্থিতিশীল রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য রেখেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে ক্রমশ। এখন যদিও তাদের রাজনীতির গতিমুখ উল্টে গেছে পুরোপুরি। বাংলাদেশ পথ চলেছে মিশ্র পদক্ষেপে। অনেক সময়ই ধনী দেশের গবেষণার কেন্দ্রে থেকেছে। এনজিও মডেলের সফল রূপকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বার বার সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতায় গেছে। অর্থনীতির গতিমুখ শেষ পর্যন্ত কৃষিপ্রধান থেকে সার্ভিস প্র্রাধান্যে বাঁক নিয়েছে। শিল্পের শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠার আগেই সার্ভিস সেক্টর বিকশিত হওয়ায় আমদানিনির্ভর ব্যবসার বিকাশ হয়েছে। প্রচুর সুপার মার্কেট, শপিং মল হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যের বিকাশ যে একেবারে হয়নি তাও নয়। গত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে দেশে আমদানি-রফতানি দুই-ই বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ নেয়ার হার বেড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরির আরও যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে রেমিটেন্স উল্লেখযোগ্য। দেশে একটা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যাদের হাতে প্রচুর টাকা এবং তা তাদের রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান করেছে। আমদানিনির্ভর পণ্যের ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে। ভোগবাদী মানসিকতার জনশক্তি তৈরি হয়েছে। শুধু মারাত্মকভাবে কমেছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বিকাশ। একাডেমিক পড়াশোনার বিষয় হিসেবে মার্কেটিং, এ্যাকাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদির দিকে ঝোঁক ক্রমশ বেড়েছে। পাশাপাশি গণিত অর্থনীতি দর্শন ইতিহাস সাহিত্য সমাজবিজ্ঞানের মতো মৌলিক বিষয়ে আগ্রহ কমছে। একই সঙ্গে রাজনীতিও মৌলিকত্ব হারিয়েছে। সেখানেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে অথবা এখনও কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে সাংগঠনিক চর্চার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছেন। কিন্তু সৃজনশীল রাজনৈতিক চর্চা এড়িয়ে যারা ‘ভিন্ন পন্থায়’ রাজনীতিতে এসেছেন তারা খেই হারিয়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দেশ-সমাজ, সময় না বুঝে তারা অন্ধের মতো চলছেন। শুধু ক্ষমতা বদল নয়, বদলানো সময়কে ধরতে পারাও সফল রাজনীতির শর্ত। সময়ের সঙ্গে কীভাবে একটি দেশ নিজেকে বদলে নেয় চীন তার উদাহরণ। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে পুরনো শাসকদের উচ্ছেদ করে যুগযুগান্তের প্রচলিত কুসংস্কার, নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন করে সে দেশে সমাজ বিপ্লব হয়। ১৫১৩ সালে পর্তুগীজরা চীনে পৌঁছানোর পর থেকেই ও দেশের প্রতি বিদেশীদের আগ্রহের শুরু। বিভিন্ন অপমানজনক ব্যবসায়িক চুক্তি ও শর্তে চীন এক লাভজনক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়, বিশেষ করে ইংরেজ ও ফরাসীদের কাছে। চীনের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের বীজ সঞ্চার মূলত তখন থেকে। শক্তিশালী বিদেশী দখলদারদের উৎখাত করেছিল চীনের সাধারণ মানুষ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে। পরের সমাজ বিপ্লব হয়েছিল মাঝের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও উৎকর্ষের পরিণতি হিসেবে। মাঞ্চুরাজ বংশসহ অন্যান্য সামন্ত প্রভুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চীন সময়ের সুর ধরে সমাজ বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তার পর তারা শুধু সামনে এগিয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনীতি ও রাজনীতির বাঁক ঘুরিয়ে চীন আজ কোথায় পৌঁছেছে! এত বিশাল জনসংখ্যার দেশ যদি সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে পারে তাহলে আমাদের অসুবিধা কোথায়? আমাদের রাজনীতিকরা নিজেদের একটু বদলালে একটু সময়ানুগ হলে রাজনীতি গতি পায়। যদিও তা কঠিন। কেননা এদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ অন্যখানে। অনেক সময় পেরিয়ে বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে ও দেশের রাজনীতি ট্রাইবাল টোটেমেই আটকে আছে। টোটেম বন্দনায় ফিলোসফি নেই ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার নিম্নমানের কৌশল ছাড়া। জনগণ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে হতে রাজনীতি এখন আধিপতিদের পকেটে হেলছে দুলছে। সাধারণ মানুষ সেখানে একেবারেই গৌণ। এ বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়েছে। একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি দুর্বলতা থাকলেও সমাজে মুক্তবুদ্ধি চর্চা করার অনেক ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ছিল। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিল। এখন মনে হয় সে সব একেবারে শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। মুখ খুললেই টোটেম বন্দনা। হয় এদিক নয় ওদিক। মাঝখানে যারা থাকেন তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে দু’দিকের তর্জন গর্জনে। [email protected]
×