ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাদক ব্যবসা, নারী পাচার অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের আঁতুড় ঘর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৫ জুলাই ২০১৮

মাদক ব্যবসা, নারী পাচার অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের আঁতুড় ঘর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকার কড়াইল বস্তি যেন বাতির নিচে অন্ধকার। ঢাকার রীতিমতো ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে বস্তিটি। গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার পাশের এই বস্তিটি ঢাকার বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু অভিজাত এলাকা নয়, পুরো ঢাকাসহ সারাদেশের চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, নারী পাচার, অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানা ধরনের অপরাধের আঁতুড় ঘর বস্তিটি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরাও দিব্যি বস্তিটিতে আরাম আয়েশে বসবাস করে। ধরার কোন উপায় নেই। কারণ বস্তিটিতে যাতায়াতের রাস্তা একেবারেই সরু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সেখানে অভিযান চালিয়ে কাউকে আটক করা রীতিমত দুরূহ ব্যাপার। বস্তির নানা অপরাধ আর মাদকের কারণে রীতিমতো অতিষ্ঠ সেখানে থাকা বিটিসিএল কলোনি, গুলশান, বনানীসহ আশপাশের বাসিন্দারা। এখানকার ভবিষ্যত প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মাদক নামের ভয়াবহ দানবীয় আগ্রাসনের মধ্যে। অধিকাংশ শিশু, কিশোর, কিশোরী মাদকের ভয়াবহ থাবার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। সন্ত্রাসীদের আনাগোনার কারণে এবং মাদক পাচার বন্ধে বস্তিতে যাতায়াতের জন্য একসময় চলাচল করা নৌকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকার মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে সামনে কিছুদূর গেলেই টিএন্ডটি স্কুল। স্কুলের সামান্য পূর্ব দিকেই কড়াইল বস্তিটির অবস্থান। বস্তিটির সামনে বিটিসিএলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। আর উত্তর দিকে মহাখালী ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মতো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থিত। ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটিতেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নানা কর্মকা- চলছে। দেশকে ডিজিটাল করতে সারাদেশে ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক স্থাপনের প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকা- চলছে। মূলত এখান থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। এজন্য চলছে নানা কর্মকা-। মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, দেশকে ডিজিটাল করতে যেমন কর্মযজ্ঞ চলছে, সেই কর্মযজ্ঞ চালানোর মতো পারিপার্শ্বিক সুবিধা নেই। ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটিতে যাতায়াত ও ভারি যন্ত্রপাতি এবং বড় বড় যানবাহন চলাচলের জন্য দুই পাশে ১০ ফুট ফুটপাথ আর ৫০ ফুট রাস্তা করা হয়েছে। রাস্তাটি স্কুলের সামনে থেকে এরশাদ বস্তি ও কড়াইল বস্তির সামনে দিয়ে সরাসরি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটিতে চলে গেছে। দুই পাশের ফুটপাথ দখল হয়ে গেছে। সেখানে বস্তির বাসিন্দারা চা, পান, বিড়ি সিগারেটের ভাসমান দোকান বসিয়েছে। আর রাস্তার দুই পাশের অন্তত দশ ফুট করে ২০ ফুট জায়গা বস্তির বাসিন্দারা পুরনো জিনিসপত্র, রিক্সা, ভ্যানসহ অন্যান্য মালামাল রেখে দখল করে রেখেছেন। ভারি যন্ত্রপাতি আনা নেয়া করা রীতিমত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে মূলত দুইটি বস্তি। কড়াইল বস্তির সামনে একটি ঝিলের ওপর এরশাদ বস্তি নামে একটি বস্তির অবস্থান। বস্তিটিতে অন্তত ৫০ হাজার ঘর আছে। সেখানে কমপক্ষে সোয়া লাখ লোকের বসবাস। অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। সেখানকার আনসার সদস্যসহ অন্যরা জানান, প্রায়ই জিনিসপত্র চুরি হয়ে যাচ্ছে। কাজ করার জন্য কোন জিনিস কয়েক মিনিটের জন্যও বাইরে রাখা যায় না। এসব জিনিসপত্র চুরি করার জন্য বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা বস্তিতেই আত্মগোপন করে থাকে। ধরার কোন পথ নেই। জিনিসপত্র নিমিষেই চুরি করে বস্তির ভেতরে নিয়ে যায়। বস্তির ভেতরে যাওয়ার পর সেসব জিনিস আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ বস্তিতে হাজার হাজার গলি। তারা জানান, জিনিসপত্র চুরি যাওয়ার প্রধান কারণ মাদক। যারা মাদক সেবন করে তারা সাধারণত সারাদিন ঘুমায়। রাতে জেগে থাকে। তারাই জিনিসপত্র চুরি করে বস্তির ভেতরে নিয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন কৌশলে তারা বাইরে বিক্রি করে দেয়। সেখানকার টিএন্ডটি কলোনির বাসিন্দারা জানান, বস্তির কারণে তাদের ছেলে মেয়েরা রীতিমতো বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। কারণ বস্তিতে হরহামেশাই মাদক পাওয়া যায়। সস্তায় হরহামেশাই মাদক পাওয়া যাওয়ার কারণে তাদের ছেলে মেয়েরাও অনেক সময় মাদকের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এছাড়া মাদকাসক্তদের কারণে বাসায় প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটে। এছাড়া রাতে চলাফেরা করা রীতিমত কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ মাদকসেবী তরুণরা প্রায়ই রাতে ছিনতাই করে। এরা কোন জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। কারণ তারা মাদকের নেশার ঘুরে ছিনতাই করে থাকে। আর ছিনতাই করার পর এই বস্তি ছেড়ে অন্য বস্তিতে চলে যায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কড়াইল আর এরশাদ বস্তির কারণে মহাখালী, গুলশান ও বনানী এলাকায় চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়। তারা এসব অপরাধ সংঘটিত করার পর বস্তিতে আত্মগোপন করে। ফলে তারা ধরা পড়ে না। ঢাকার মাদকের বড় হাট এই বস্তিটি। এখান থেকেই ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ অন্যান্য মাদক ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে সরবরাহ হচ্ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক সন্ত্রাসীর বসবাস বস্তিটিতে। শুধু সন্ত্রাসী নয়, যেকোন ধরনের অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা বস্তিটি। সারাদেশে বড় বড় অপরাধ সংঘটিত করে সন্ত্রাসীরা বস্তিটিতে আশ্রয় নেয়। কোন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালেও তাদের গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ তখন তারা অনেক সময় অন্য বস্তিতে গিয়ে আত্মগোপন করে। আবার ঝিলের মধ্যে থাকা নৌকা দিয়ে পার হয়ে যায়। নোয়াখালীর বাসিন্দা রিক্সাচালক আবু তালেব (৫৬) বলছিলেন, তিনি ২০ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছেন। বস্তিতে মাদক আর মেয়ে মানুষের ব্যবসা অনেকটাই প্রকাশ্যেই চলে। বস্তিটিতে নানা ধরনের সন্ত্রাসীদের বসবাস। কোন কিছু বলার উপায় নেই। প্রায় ঘর থেকে টাকা পয়সা চুরি হয়ে যায়। অনেক সময় জোর করেই সন্ত্রাসীরা টাকা পয়সা নিয়ে যায়। হেন কোন অপরাধ নেই যা এই বস্তিতে সংঘটিত হয় না। বিশেষভাবে তৎপর নারী ও শিশু পাচারকারীরা। আর অস্ত্রগোলাবারুদ নিয়ে বস্তিতে মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। কড়াইল বস্তির মূল সড়কে মারুফ টেলিকম নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ করেন দোকানটির মালিক মারুফ হোসেন। বয়সে তরুণ এই ব্যবসায়ী বলছিলেন, বস্তিটিতে একটি বিদেশী সংস্থা জরিপ চালিয়েছে। তাদের জরিপ মোতাবেক এরশাদ বস্তি আর কড়াইল বস্তি মিলে প্রায় পৌনে চার লাখ লোকের বসবাস। দিনকে দিন লোকের সংখ্যা বাড়ছে। লোক সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ মাদক, সস্তায় বসবাস করার সুযোগ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপরাধ সংঘটিত করে বস্তিতে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ থাকাসহ নানা বিষয়াদি আছে। প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনার পাশাপাশি এখানে নানা ধরনের সুবিধা রয়েছে। বস্তির প্রতিটি ঘরে তিতাসের গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির চোরাই সংযোগ আছে। এখানকার বস্তিঘরগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি ক্ষমতার জোর খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিমাসে বস্তিটিতে শুধু কোটি কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হয়। এছাড়া নারী ও শিশু পাচার ব্যবসা, চোরাই মালামালের ব্যবসাসহ বহু ধরনের ব্যবসা আছে। ব্যবসায়ী মারুফ বলছিলেন, এরশাদ ও কড়াইল বস্তি দুইটি কমপক্ষে ৩শ’ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে। সব জায়গা টিএন্ডটির। এখন বেদখল করে তাতে বস্তি গড়ে উঠেছে। এসব দখল করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এরসঙ্গে সমাজের নানা শ্রেণী পেশার মানুষও জড়িত। কারণ তারা প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা বাড়তি রোজগার করে নিচ্ছেন। বস্তির কারণে পুরো এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে পুরো এলাকা। মাদকের প্রভাব পড়েছে বনানী, মহাখালী ও গুলশানেও। অভিজাত এলাকার অধিকাংশ মাদক বস্তিটি থেকে সরবরাহ হয় বলে বস্তির বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে বলছিলেন মারুফ। ঢাকার মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলছিলেন, শুধু কড়াইল বা এরশাদ বস্তি নয়, ঢাকার প্রতিটি বস্তিই অপরাধের আখড়া। এসব বস্তিতে অবস্থান করে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাদের সহজেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। কারণ অভিযানকালে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন গলিতে করে পালিয়ে যায়। আর বস্তিগুলোতে যে পরিমাণ গলি আর সরু রাস্তা তাতে করে কোন সন্ত্রাসীকে ধরাই দুরূহ ব্যাপার। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, বস্তিগুলো মাদক আর অপরাধীদের আঁতুড়ঘর। আঁতুড়ঘর ভাংতে না পারলে ঢাকার চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মাদকের ব্যবসা, মাদক সংক্রান্ত নানা ধরনের অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
×