ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় চাকা চুরমার, যাত্রীরা অক্ষত

শাহজালালে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেল থাই এয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৫ জুলাই ২০১৮

শাহজালালে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেল থাই এয়ার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ব্যাঙ্কক থেকে আসা থাই এয়ারওয়েজ (টিজি ৩২১) উড়োজাহাজের পেছনের ছয়টি চাকা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। অবিশ্বাস্য কায়দায় উড়োজাহাজটি নিরাপদে অবতরণ করে এবং ১৪৫ জন যাত্রী ও ১৮ জন ক্রু অক্ষত আছেন। মঙ্গলবার বেলা ১২টা ২১ মিনিটে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বিমানবন্দরের সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখতে হয় সোয়া দুই ঘণ্টা। তাতে ৮টি ফ্লাইটকে অন্য গন্তব্যে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সিভিল এভিয়েশনের সদস্য এয়ারকমোডর মোস্তাফিজুর রহমান জানান, উদ্ধারকর্মীদের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের দরুন খুব দ্রুততম সময়েই রানওয়ে পরিষ্কার করা সম্ভব হয় এবং সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেলা আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়- রানওয়ে ওপেন করার পর একের পর এক উড়োজাহাজ ওঠানামা করছে। দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়ের নিরাপদ স্থানে পার্কিং করা। যাত্রীদের সবাইকে নিরাপদে বের করে বিমানবন্দরে আনা হয়। দ্রুত তাদেরকে লাগেজ ডেলিভারি দিয়ে শান্ত করা হয়। এ সময় তাহমিদ নামের এক যাত্রী বলেন, এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আমরা ভেতরে থাকাবস্থায় সবগুলো চাকা ফেটে যাওযার পরও কিছুই ঘটেনি। তবে আমরা সব যাত্রীই খেয়াল করেছি পাইলট কয়েকবার চেষ্টা করেই অবতরণ করেছেন। এবং বিকট শব্দে টাচডাউন করার সময় বিকট শব্দে সব যাত্রীই আঁতকে ওঠেন। তারপর ডান বাম দিকে হেলে দুলেই যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় উড়োজাহাজটি। এটা মনে হচ্ছে অলৌকিক কিছু একটা...। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, উড়োজাহাজটি রানওয়েতে টাচডাউন করার সময় সামনের চাকা রানওয়েতে থাকলেও পেছনের চাকাগুলো ফেটে যাওয়ায় ছিটকে পড়ে রানওয়ের বাইরে কাদামাটিতে। এতে কাদামাটিসহই উড়োজাহাজটি সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে দ্রুত। এ সময় চাকার সঙ্গে কাদামাটি ও ঘাস লেগে জবুথবু অবস্থায় পড়লেও পাইলট অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে নিরাপদে রানওয়েতেই উড়োজাহাজটিকে ধরে রাখতে সক্ষম হন। যাত্রীরা এ মন অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে অনেকেই চিৎকার শুরু করেন। যাত্রী মাসুদের ভাষ্য মতে- রানওয়েতে পানি জমে থাকায় উড়োজাহাজটি রানওয়ের একটু পাশে অবতরণের চেষ্টা করে। ফলে এর একটি চাকা ফেটে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারী একটি বিমান সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে আমরা নিজেদের একটি ফ্লাইটের ইন্সপেকশন করছিলাম, তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি উড়োজাহাজটি অস্বাভাবিকভাবে ল্যান্ড করল। দেখে মনে হয়েছিল, হয়ত কোন কারণে উড়োজাহাজটি জরুরী অবতরণ করেছে। এদিকে খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (অপারেশন) এয়ারকমোডর মোস্তাফিজুর রহমান ও বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ ফারুক। তারা বৃষ্টির মাঝে ভিজে রানওয়েতে চলাচলপোযোগী করার কাজ তদারকি করেন। সিভিল এভিয়েশন প্রকৌশল, ফায়ার ও অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টার দরুন মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় তা শেষ করা হয়। উদ্ধারকাজের জন্য ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বিমানবন্দরের রানওয়ে বন্ধ রাখা হয়। উড়োজাহাজটি সরিয়ে নেয়ার পর রানওয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এ সময় অবতরণ করতে না পেরে ৩টি ফ্লাইট কলকাতা, ৩টি সিলেট ও ৩টি ফ্লাইট চট্টগ্রামে ফিরে যায় এবং ৭টি ফ্লাইট বিলম্বের শিকার হয়। বিমানবন্দরের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এভাবে চাকা পাংচার হওয়ার পরও আল্লাহর অশেষ রহমতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছে উড়োজাহাজটি। সিভিল এভিয়েশানের জনসংযোগ কর্মকর্তা একেএম রেজাউল করিম জানান, থাই এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজটি নামার পর রানওয়ে আটকে থাকায় মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার পর আর কোন ফ্লাইট ওঠানামা করতে পারছিল না। বেলা আড়াইটার দিকে উড়োজাহাজটি সরিয়ে নিলে শাহজালালালে ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ব্যাঙ্কক থেকে আসা থাই এয়ারওয়েজের ওই ফ্লাইটটির নামার সিডিউল ছিল বেলা ১২টার দিকে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর বেলা প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে উড়োজাহাজটি নামার সময় রানওয়েতে পিছলে গিয়ে চাকা ফেটে যায়। বোয়িং ৭৭৭ এয়ারক্রাফটটি রানওয়ে থেকে পিছলে যাওয়ায় চাকা ঘাসের মধ্যে চলে গিয়েছিল। সিভিল এভিয়েশনের পরিদর্শন কর্মকর্তারা গিয়ে দেখেছেন, ডান পাশের সব চাকাই ফেটে গেছে। ওই ফ্লাইটে ঢাকায় আসা একজন যাত্রী বলেন, উড়োজাহাজটি যখন রানওয়েতে নামে তখন প্রচ- ঝাঁকুনিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই চিৎকার করতে থাকেন। অবস্থা ছিল খুবই খারাপ, তখনই মনে করলাম, পৃথিবীতে মনে হয় আর নাই। এমন একটা শব্দ যে কোন সময় আগুন ধরে যেতে পারত। লাকিলি আমরা সেইফলি নেমে আসছি। মোবাইল ফোনে ফেটে যাওয়া চাকার একটি ছবি দেখিয়ে ওই যাত্রী বলেন, তিনবারের চেষ্টায় পাইলট রানওয়েতে নামেন। সামনের চাকা রানওয়েতে নামলেও পেছনের চাকাটি ছিল মাটিতে। চাকা ‘ফেটে চৌচির’ হয়ে গেছে। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় এয়ারকমোডর মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বেলা সোয়া বারটায় ওই ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ১টা ২০ মিনিটে সেটা আবার ঢাকা থেকে ১৬৮ জন যাত্রী নিয়ে ফিরে যাবার সিডিউল ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের যাত্রা বিলম্বিত হয়েছে। এ জন্য থাইএয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ ওই যাত্রীদেরকে হোটেলে নিয়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তারা চেষ্টা করছে- রাতে যে কোন সময় থাইল্যান্ড থেকে যে কোন এয়ারক্রাফট এনে যাত্রীদের যথাসম্ভব দ্রুত নিয়ে যাওয়ার। এ ঘটনায় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, কেন এ ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তের আগে বলা সমীচীন হবে না। তবে সাধারণত ল্যান্ডিংয়ের সময় পাইলট যদি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) না মেনে হার্ড ব্রেক করে তাহলে চাকা ফেটে গিয়ে রানওয়ের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি তা না হয়ে থাকে- তাহলে হতে পারে এন্ট্রি স্কিড ফেইলিয়র। প্রত্যেক উড়োজাহাজেই এন্টি স্কিড থাকে যার কাজ হচ্ছে ল্যান্ডিং করার সময় স্বয়ংক্রিয় এক্টিভেট হয়ে চাকাগুলোকে সঠিক পথে রেখে ভারসাম্য বজায় রাখা। এক্ষেত্রে এন্টি স্কিড কাজ করেনি বলেই সবগুলো চাকা লকড হয়ে একে একে ফেটে গেছে। যা খুবই বিরল। সাধারণত একটা দুটো চাকা ফাটার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এক সঙ্গে সবকটি চাকাই একের পর এক ফেটে যাওয়ায় মনে হচ্ছে এন্টি স্কিড কাজ করেনি।
×