ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

খনি দুর্নীতির প্রতিবেদন আজ দেবে তদন্ত কমিটি

চার কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৫ জুলাই ২০১৮

চার কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির চার কর্মকর্তাকে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার বিকেলে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এদিকে বড়পুকুরিয়া খনি দুর্নীতি নিয়ে পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির আজ বুধবার প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। রবিবার থেকে কার্যকর হওয়া তদন্ত কমিটি তিন কর্মদিবস সময় পেয়েছে। আজ প্রতিবেদন দেয়ার সময় নির্ধারিত রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার তদন্ত কমিটি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি পরিদর্শনে যায়। আর একই দিন কাওরান বাজারে পেট্রোবাংলা ভবনে যায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান দল। বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে যাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তারা হলো বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন কোম্পানি সচিব এবং জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবুল কাশেম প্রধানিয়া, জেনারেল ম্যানেজার (মাইন) আবু তাহের মোঃ নূরুজ্জামান এবং ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) একেএম খালেদুল ইমলাম। যদিও এদের বিরুদ্ধে আগেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ছিল পেট্রোবাংলা। এদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পেট্রোবাংলাকে সংযুক্ত করা হয়। প্রধানিয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে বদলি করা হয় আর অন্য দুজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের মুখপত্র জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার বল জানান, তাদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে দুদক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পেট্রোবাংলা চেয়াারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফায়জুল্লাহ এনডিসি মঙ্গলবার বিকেলে জানান, তদন্ত কমিটি বুধবার সকালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। আশা করেন তিনি একই দিন মন্ত্রণালয়ে তদন্ত রিপোর্টটি জমা দিতে পারবেন। তদন্ত কমিটিকে দেয়া সময়সীমা মঙ্গলবার শেষ হচ্ছে বলে জানান তিনি। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, কমিটিটি গঠন করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এখনও এ বিষয়ে আামদের কাছে কোন চিঠি আসেনি। যে নির্দেশনা দেয়া হবে পেট্রোবাংলা সেভাবে কাজ করবে। প্রসঙ্গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এদিন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বিদ্যুত জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ছাড়াও জ্বালানি সচিব এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে জ্বালানি খাতের সব থেকে বড় কেলেঙ্কারি বলে মনে করা হচ্ছে। খনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এই কয়লা গায়েব করা হচ্ছিল বলে জানা গেছে। এর বাইরে ঠিকাদার কোম্পানির কারসাজি থাকতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তবে আজ তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে মঙ্গলবার খনি এলাকা পরিদর্শন করে তদন্ত কমিটি। মঙ্গলবার বিকেলে তদন্ত কমিটির প্রধান পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এ্যান্ড মাইন) প্রকৌশলী মোঃ কামরুজ্জামান টেলিফোনে জানান, তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঢাকার পথে রয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন কবে দেয়া হবে জানতে চাইলে বলেন, আমরা কাজ করছি। কাজ শেষ হলেই দেয়া হবে। তদন্তে কি কি বিষয় উঠে এসেছে জানতে চাইলে তিনি জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। মঙ্গলবার সকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল পেট্রোবাংলায় যান। এ সময় পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের দেড় ঘণ্টার আলোচনা হয়। এই আলোচনায় তারা কয়লা গায়েব হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেন। এছাড়া কয়লার উৎপাদন মজুদ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। পেট্রোবাংলা থেকে বের হয়ে দুদকের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৫ দিন পর তারা এ বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে অনুসন্ধান দল পেট্রোবাংলায় যায়। কারও কারও বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এখনও তারা এ ধরেনর আশঙ্কা দেখছেন না। দুদক এ বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করার পর মামলা করা হবে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত চলবে। পেট্রোবাংলার একটি সূত্র বলছে দায়ী কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে দুদক আপত্তি তুলেছে। এর আগে সোমবার দুদকের একটি প্রতিনিধি দল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি পরিদর্শনে যায়। সেখানে তারা কয়লাখনিতে দুর্নীতির আলামত পাওয়া গিয়েছে বলে জানায়। প্রসঙ্গত ২০০৬ সাল থেকে কয়লা তুলে কোল ইয়ার্ডে জমা রাখা হচ্ছিল। কিন্তু বিক্রির পর বছরে কতটুকু কয়লা অবশিষ্ট থাকলে তা কখনও পরিমাপ করা হয়নি। এখন কাগজে কলমে অবিক্রিত এক লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কয়লা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টন। অর্থাৎ এক লাখ ৩০ হাজার টনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে বড়পুকুরিয়াতে। খনিমুখে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে জ্বালানি সঙ্কট দেখা দিলে কয়লা গায়েবের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। পেট্রোবাংলার অধীনস্ত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ খনিটি পরিচালনা করে। কিন্তু বছরে বছরে বিপুল পরিমাণ কয়লা গায়েবের বিষয়ে পেট্রোবাংলা কেন নজরদারি করল না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ পেট্রোবাংলার গাফিলতি থাকার কথা জানিয়েছেন। তদন্তের জাল ॥ শ.আ.ম হায়দার, পার্বতীপুর থেকে জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মে.ও পাওয়ার প্লান্ট কয়লা সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের দৃষ্টি পড়েছে এই খনির ওপরে। প্রধানমন্ত্রীর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতির উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়ার পরই পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। চারিদিকে হইচই পড়ে গেছে এখন পত্র-পত্রিকার প্রধান শিরোনাম বড়পুকুরিয়া। তবে তার আগে দুর্নীতি দমন প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে ঘটনা তদন্তে দিনাজপুর দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক বেনজির আহমেদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের টিম গত সোমবার খনিতে এসে অবস্থান করে তদন্ত শুরু করেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, খনি কর্তৃপক্ষ যে কাগজপত্র দিয়েছে সে হিসেবে খনির কোল ইয়ার্ডে ১ লাখ ৪৬ হাজার মে.টন কয়লা থাকার কথা। তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, যে পরিমাণ কয়লা রয়েছে তা ২ হাজার মে.টনের বেশি হবে না। এতে প্রাথমিকভাবে দুর্নীতি মনে হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না বলে তিনি জানান। সূত্র মতে, আগের ১ ও ২ ইউনিটের পরে ৩য় ইউনিট নির্মিত হয়ে তাপ বিদ্যুতের ক্ষমতা দাঁড়ায় ৫২৫ মে.ও। তাপ বিদ্যুতের প্রধান প্রকৌশলী আ. হাকিম সরকার ও বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের সচিব মিনা মাসুদ উজ্জামান জানিয়েছেন, বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মে.ও পাওয়ার প্লান্ট চালু রাখতে কয়লার চাহিদা জানিয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও খনি কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। বরং চিঠিতে কয়লার সমস্যা নেই, বিভিন্ন উৎস থেকে কয়লার মজুদের কথা জানিয়ে শান্তনা ও কালক্ষেপণ করা হয়েছে। অপরদিকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইটভাটাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয় ৩৩ লাখ ১৯ হাজার মে.টন, অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহার করে ১২ হাজার মে.টন। সিস্টেমলস দেখানো হয় ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। যার পরিমাণ ১ লাখ ৪২ মে.টন কয়লা। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার উৎসের বিষয়টি মাথায় নিয়ে নির্মিত হয় কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রটি। এটিকে চালু রাখার বিষয়টি উপেক্ষা ও গুরুত্ব না দিয়ে মজুদ উজাড় করে কেন তারা কয়লা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল ? তাপ বিদ্যুত বাদ দিয়ে সরকার কি খনি কর্তৃপক্ষকে কয়লা বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে? দেখে মনে হয় কারও কোন দায় ও জবাবদিহিতা নেই। সবাই যার যার মতো নিজ খেয়াল খুশি মতো যা কিছু করছে। তা না হলে পেট্রোবাংলা ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থাকার পরও কয়লা খনির এ অবস্থা কেন?
×