ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপাড়া কঠিনশিলা খনি সংকটের মুখে

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২৪ জুলাই ২০১৮

মধ্যপাড়া কঠিনশিলা খনি সংকটের মুখে

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর ॥ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির আওতায় দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল পাথরখনি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি থেকে ৬ বছরে ৯২ লাখ মে.টন পাথর উত্তোলনের কথা থাকলেও, ২ বছর ৪ মাসে পাথর উত্তোলন হয়েছে মাত্র ২১ লাখ মে.টন। এদিকে, ৬ বছরের চুক্তির মেয়াদের ইতিমধ্যে ৪ বছর ৪ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় চুক্তি নবায়ন কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হলে আগামী ১ বছর ৮ মাস সময়-সীমার মধ্যে নির্দ্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অবশিষ্ট ৭১ লাখ মে.টন পাথর উঠানো অসম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এতে খনিটি আবারও লোকসানের মুখে পড়বে। এ অবস্থায় খনি নতুন সংকটে পড়বে বলে আশংকা করেছেন খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া-ট্রেষ্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। খনি কর্তৃপক্ষ সময়মত খনির অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও খনির উন্নয়ন ডিজাইন সরবরাহ করতে না পারায়, ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ২ বছর পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। জানা গেছে, মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর বেলারুশের জেএসসি ট্রেষ্ট সকটোস্ট্রয় ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া-কর্পোরেশন লিঃ ঢাকা বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় জার্মানীয়া-ট্রেষ্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পেট্রোবাংলা’র সাথে এই কনসোর্টিয়াম-এর ৬ বছরে ৯২ লাখ মে.টন পাথর উত্তোলনের লক্ষ্যে খনির উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী জিটিসি খনির উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। তবে ওই সময় পাথর খনিতে শ্রমিক অসন্তোষ ও কর্মবিরতির কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। পুনরায় খনির উৎপাদন শুরু করতে নতুন জনবল নিয়োগ ও খনির অন্যান্য কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে ৬ মাস সময় পার হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খনির দায়িত্বভার গ্রহন করে ২৪ ফেব্র“য়ারী থেকে তাদের ব্যবস্থাপনায় নতুন উদ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। ২ মাসের মাথায় তারা দ্বিতীয় শিফট চালু করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ৭ মাসের মাথায় তারা খনির উৎপাদন ব্যবস্থা তিন শিফটে উন্নীত করে এবং দৈনিক পাথর উত্তোলনের পরিমান দাঁড়ায় সাড়ে ৪ হাজার টন। কোন কোন দিন তা ৫ হাজার মে.টন ছাড়িয়ে যায়। খনিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয় ৭০ রুশ খনি বিশেষজ্ঞ, ৩শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ৭শ’ শ্রমিকসহ প্রায় সহস্রাধিক মানুষের। এ সময় খনি থেকে তিন শিফটে পাথর উত্তোলন করা সম্ভব হলেও উত্তর কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘নামনাম’ বাস্তবায়িত এই খনিতে স্থাপিত মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরনো যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের কারনে অল্পদিনের মধ্যে উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। এ কারনে বর্তমান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসি ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে খনি কর্তৃপক্ষকে দ্রুত নতুন মেশিনপত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানী ও স্থাপনের জন্য লিখিত তাগিদ প্রদান করে। অন্যথায়, যে কোন সময় খনির উন্নয়ন ও পাথর উত্তোলন কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ সময়মত নতুন যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায়, ২০১৫ সালের ১ আগষ্ট তিন শিফটের উৎপাদন এক শিফটে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয় জিটিসি। এর প্রায় দুই মাস পর পাথর উৎপাদন পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সরকার ওই বছরের আগস্ট মাসে খনি কর্তৃপক্ষকে ১শ’ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ দেয় এবং অক্টোবর নভেম্বর মাসে খনি কর্তৃপক্ষ মালামাল আমদানীর এলসি খোলে। বিশ্বের ১৪টি উন্নত দেশ থেকে অত্যাধুনিক ও বিশ্ব মানের মেশিনারিজ যন্ত্রংশ সংগ্রহ করে তা অর্ডার দিয়ে মধ্যপাড়া খনিতে ব্যবহার উপযোগি হিসেবে তৈরী করে আমদানী করতে দুই বছরের বেশি সময় চলে যায়। এ সময় পাথর উৎপাদন ও খনির উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও জিটিসিকে বেলারুশ খনি বিশেষজ্ঞ দিয়ে খনির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা কার্যক্রম সচল রাখতে হয়। এতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসিকে কয়েক কোটি টাকা লোকসান গুণতে হয়। পরবর্তীতে খনিতে বিশ্ব মানের ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের ফলে দ্রুত গতিতে নতুন নতুন স্টোপ নির্মান করা সম্ভব হয়। উৎপাদনের গতি বাড়াতেও সক্ষম হয় জিটিসি। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি এক বছরের মধ্যে ৪টি নতুন স্টোপ নির্মান করে ও সেই সব স্টোপ থেকে এখন তিন শিফটে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৮শ’ মে. টন পাথর উত্তোলন করছে। বর্তমানে প্রতি মাসে ১ লাখ ২০ হাজার মে.টন পাথর উত্তোলেনর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জিটিসি খনির উন্নয়ন ও উৎপাদন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সরবরাহে নানা প্রতিকুলতার কারনে, জিটিসি চুক্তির সময়কালে দুই বছর লোকসানের সময়কাল আমলে নিয়ে চুক্তির মেয়াদ না বাড়ালে, ৯২ লাখ মে.টন পাথর উত্তোলনের লক্ষমাত্রা অর্জিত হবে না বলে খনি সংশিষ্টরা মনে করছেন। খনিটির উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পেট্রোবাংলা কর্তৃক গঠিত কমিটি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ৪ মে ত্রিপাক্ষিক (পেট্রোবাংলা, এমজিএমসিএল ও জিটিসি) বৈঠকে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর ফয়জুউল্যা কর্তৃক পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মোঃ আমিনুজ্জামানকে আহবায়ক করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মোঃ মাহমুদ খানকে। বৈঠকে গৃহিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করে ২০১৭ সালের ২৪ আগষ্ট পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুপারিশ অনুযায়ী চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কোন পদক্ষেপ নেয়নি খনি কর্তৃপক্ষ। এ ব্যপারে জানতে চাইলে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এসএম নুরুল আওরঙ্গজেব বলেন, জিটিসি সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছে। এ ব্যপারে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তাছাড়া চুক্তির মেয়াদ এখনও আছে। মেয়াদের শেষের দিকে এ ব্যপারে চিন্তাভাবনা করা হবে, সিদ্ধান্ত হবে। খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানীয়া-ট্রেষ্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)’র নির্বাহী পরিচালক জাবেদ সিদ্দিকী জানান, কমিটি চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে উপরে জানানো হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
×