ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ বছর পর দুর্নীতিমুক্ত সোনামসজিদ বন্দর

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৪ জুলাই ২০১৮

১৮ বছর পর দুর্নীতিমুক্ত সোনামসজিদ বন্দর

ডি এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সময় নিয়েছে ১৮ বছর। বহু চেষ্টা করেও বন্দরটিকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাচ্ছিল না। যার কারণে এই আঠারো বছরে শতাধিক ব্যক্তি ও কাস্টম কর্মকর্তার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। বহু ব্যক্তি একেবারে শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছে। বহু কর্তাব্যক্তির নামে এক সময়ে বহু মামলা হলেও তা থেকে বেরিয়ে এসেছে টাকার জোরে। আর এসব দুর্নীতি বন্ধ হওয়ার কারণে সোনামসজিদ স্থলবন্দরটি বন্ধ হওয়ার পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২শ ৬৪ কোটি ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকার লোকসান দিয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫শ ৬৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। বিপরীতে আয় হয়েছে ৩শ ৯০ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বিশাল ঘাটতির কারণে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা ছুটে আসে বন্দরে। তদন্ত করে দেখে যে এক শ্রেণীর অসাধু সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরে পাড়ি জমিয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী ১৮ বছর ধরে বন্দর ব্যবহার করে রাতারাতি ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে জিরো থেকে হিরো হয়েছে তাদের বিল অব এন্ট্রি পেপার বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। দুর্নীতি ঠেকাতে এর কোন বিকল্প ছিল না। বিল অব এন্ট্রি পেপারের সুযোগ নিয়ে গত ১৮ বছরে বেশকিছু ব্যবসায়ী কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে। এখনও এই সম্পর্কিত বহু মামলা কোর্টে পড়ে রয়েছে। কিন্তু টাকা আদায় হয়নি রাজস্ব বিভাগের। তাই প্রথম চটেই বিল অব এন্ট্রি পেপার বিক্রি বন্ধ করে সোনামসজিদ কাস্টমস। সঙ্গে সঙ্গে সিএন্ডএফ এজেন্ট ও তাদের প্রতিনিধির পরিচয়পত্র ছাড়া কাস্টমস দফতরে বা অফিসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাস্টমস কর্মকর্তা জানান গত অর্থবছরে সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আমদানিকৃত পণ্য ছাড়ে ৯৫ ভাগ দুর্নীতিমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে তারা। বন্দর দুর্নীতিমুক্ত করতে গিয়ে বহু ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক সোনামসজিদ ছেড়ে অন্য বন্দরে পাড়ি জমিয়েছে। রাজশাহী কাস্টমস কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে সরকারী নীতিমালা মেনে চললে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা বন্দর ছাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পণ্য আমদানি কম হলে রাজস্ব আয় কম হওয়া স্বাভাবিক। শতভাগ রাজস্ব আদায় করায় গত অর্থবছর ছিল সোনামসজিদ স্থলবন্দর দুর্নীতমুক্ত। তিনি আরও জানান গত অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫ টন। কিন্তু শুল্কমুক্ত থাকায় এক পয়সাও রাজস্ব আসেনি। পাশাপাশি পাথর আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৩৮ টন। এতে থেকে রাজস্ব এসেছে ১শ ৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৩ হাজার টাকা। ভারতের সর্ববৃহত পাথর খনি বিহারের পাকুড়ে। সোনামসজিদ থেকে দূরত্ব কম হওয়ার কারণে আমদানিকারকরা এই বন্দর ব্যবহার করে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের দূরত্ব বেশি হলেও তারা সুযোগ সুবিধা বেশি দেয়ার কারণে ঐসব বন্দরে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ভিড় করছে। সকল বন্দরে রাজস্বের পরিমাণ একই হলেই সুবিধাভোগীরা সোনামসজিদেই পড়ে থাকত। যার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে অধিক পরিমাণ পাথরের ব্যবহার হলেও সুবিধাভোগীরা সোনামসজিদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। একই ভাবে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৪২ টন। রাজস্ব এসেছে ২৫ কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার টাকা। সোনামসজিদ বন্দর ও প্রধানত ফল আমদানির বন্দর। অথচ সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় ব্যবসায়ীরা অধিক সুযোগ-সুবিধার আশায় অন্য বন্দরে গিয়ে ভিড় করছে। তাছাড়া দীর্ঘ ১৮ বছর এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ঘোষণার বাহিরে মাল এনেছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ পণ্য যেমন মাদক ও ছোট ছোট সেফ অস্ত্র এনেছে গাদাগাদি করে। এ ছাড়াও আরও বহু ধরনের নিষিদ্ধ পণ্য এনেছে রাজস্ব বিভাগকে পকেটে পুরে। এখন এসব বন্ধ হবার কারণে রাজস্বের পরিমাণ প্রতি মাসেই কমছে। তবে আমদানি-রফতানিকারকরা ভিন্ন কথা বলছে। তাদের সভাপতি হারুন সাহেব বলেছেন ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য যথাসময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সময়ক্ষেপণ ও ছাড়করণে বিলম্ব করে থাকে এখানকার রাজস্ব বিভাগ। এছাড়াও কাস্টমসের অধিক কড়াকড়ি নিয়মিত পণ্য ছাড়ে বিলম্ব, সোনামসজিদ কাস্টমস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা না করেই আমদানিকৃত পণ্যের শুল্কায়ন মূল্যবৃদ্ধি করে থাকে। বন্দরের আমদানি-রফতানি গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক বলেন, ইচ্ছামতো এইচএস কোড পরিবর্তন করায় আমদানিকারকরা বাধ্য হয়ে পণ্য নিয়ে আনতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন এই বন্দর দিয়ে। ফলে তারা বন্দর ছাড়ছেন। শুল্কায়ন বৃদ্ধি ও কোর্ড পরিবর্তনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শুল্ক কর্তৃপক্ষের আলোচনার বিধান রয়েছে। সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের দাবি হচ্ছে বাংলাদেশের সকল বন্দর ব্যবহারকারীদের একই ধরনের নিয়ম না থাকায় সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা নানাভাবে প্রভাবিত ও দুর্নীতি করে বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করছে। এই প্রথা ও বিধান প্রত্যাহার করা মাত্র কোন বন্দর কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি করতে পারবে না। তারা আমদানি-রফতানি ও সিএন্ডএফ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন নানান ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ হবার কারণে তারা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে।
×