ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি

উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ জুলাই ২০১৮

উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

রশিদ মামুন ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার তিনি এই নির্দেশ দেন বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র। এর আগে পেট্রোবাংলা খনি দুর্নীতির প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করে। এখন এই ঘটনা অনুসন্ধানে জ্বালানি বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করবে। ওই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধিকেও রাখতে হবে। এদিকে কয়লা কেলেঙ্কারি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে চুরি করে বেশি বিক্রি অথবা নির্দিষ্ট কোন সময়ে ঠিকাদার কোম্পানি কম কয়লা তুলে বেশি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে পারে। বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে কয়লা খোলা বাজারে বিক্রির সময়ই দুর্নীতি হয়েছে। তবে একটি সূত্র চীনা কোম্পানির কয়লা উত্তোলনের প্রকৃত পরিমাণ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এই পক্ষটি বলতে চায় খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ বেশি দেখিয়ে চীনা কোম্পানিটি বেশি অর্থ নিয়ে যেতে পারে। নির্দিষ্ট কোন সময়ে খনি কর্তৃপক্ষের ওপর পর্যায়ের কারও সঙ্গে কোম্পানিটির যোগসাজশে এমন দুর্নীতির ঘটনা ঘটতে পারে। কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে বৈঠক করতে প্রধানমন্ত্রী সোমবার সচিবালয়ে আসেন। মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বিদ্যুত জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদম বিপু ছাড়াও জ্বালানি সচিব আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফায়জুল্লাহ এনডিসি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর প্রতিমন্ত্রী বলেন, এক মাসের মধ্যে কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্রটির জ্বালানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তখন আর জ্বালানি সংকট থাকবে না। প্রসঙ্গত আগামী ১৫ আগস্ট নতুন স্তর থেকে কয়লা উত্তোলনের সময় নির্ধারিত রয়েছে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ। এখন শিফট পরিবর্তন করার জন্য খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিপুল পরিমাণ কয়লা কোথায় গেল এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। সে সময় সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি সকলকে জানানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের একটি সূত্র জানিয়েছে পেট্রোবাংলার গঠিত কমিটির পাশাপাশি আরও একটি কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার বিকেলে জ্বালানি বিভাগ থেকে পেট্রোবাংলাকে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রেখে কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর আগে পেট্রোবাংলা যে কমিটি গঠন করেছিল সেখানে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি। অন্যদিকে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করার বিষয়ে সোমবার বিকেল পর্যন্ত কিছু হয়নি বলে জ্বালানি বিভাগের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জ্বালানি বিভাগ এবং পেট্রোবাংলার প্রতিনিধি থাকার কথা রয়েছে। বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, গত ১৮ মার্চ বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লার চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে স্থানীয়ভাবে অন্য গ্রাহকদের কাছে কয়লা বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এর আগে ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ এবং ৩১ জুলাই ২০১৭ তারিখে অপর দুটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়লা বিক্রি করে খনি কর্তৃপক্ষ। বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদন বন্ধ রাখার সময় চাহিদা পূরণের সমান কয়লা মজুদ রাখার অনুরোধ করে বিদ্যুত উন্নয় বোর্ড (পিডিবি)। এর প্রেক্ষিতে খনি কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে জানায়, এক লাখ টন কয়লা মজুদ রয়েছে। এতে বিদ্যুত কেন্দ্রর জন্য কোন সংকট হবে না। পরবর্তীতে বিদ্যুত কেন্দ্রর পক্ষ থেকে কয়লা না থাকার বিষয়টি পিডিবিকে জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) সাঈদ আহমেদ পরিদর্শনে গিয়ে কয়লা না থাকার সত্যতা পায়। পিডিবির তরফ থেকে সরকারের ওপর মহলে বিষয়টি জানালে তোলপাড় শুরু হয়। জ্বালানি না থাকায় বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রটি রবিবার রাত ১০টা ২০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়। বড়পুকুরিয়া খনি সূত্র বলছে, ২০০৫-০৬ সালে এই স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এক কোটি ২২ হাজার ৯৩৩ মেট্রিকটন কয়লা তোলা হয়েছে। তবে এই ১৩ বছরে একবারও কয়লা পরিমাপ করা হয়নি। শুরুতে বছরে তিন লাখ তিন হাজার ১৫ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। তবে পরবর্তী বছর থেকে কয়লা তোলার পরিমাণ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। অর্থবছর ২০১৬-১৭ তে সর্বাধিক ১১ লাখ ৬০ হাজার ৬৫৭ মেট্রিকটন কয়লা তোলা হয়। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২১ হাজার ৬৩৮ মেট্রিক টন। এভাবে প্রতিবছরই সাত থেকে নয় লাখ মেট্রিকটন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যে হিসেব দিয়েছে কোম্পানিটি তাতে বলা হচ্ছে ৭ লাখ ৮২ হাজার ২১৪ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিপুল পরিমাণ এই কয়লার মধ্য থেকে এক লাখ টন কয়লা বিক্রি করে দেয়া হলে কোন সমস্যা হবে না মনে করেই দীর্ঘ দিন থেকে এটা করা হতে পারে। তিনি জানান, এক বা দুই দিনে এই কাজ করা হয়নি। এটা করতে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ধরা যাক কোন ক্রেতা ১০০ টন কয়লা নিল তাকে ১০০ টনের স্থলে ১১০ টন কয়লা দেয়া হলো। এখানে ১০ টনের টাকা গ্রাহক এবং বিক্রয় প্রতিনিধির মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে থাকতে পারে। এতে উভয় পক্ষই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। সময়ের সঙ্গে কয়লার দাম বৃদ্ধি করা হয়। এতে বিক্রির প্রবণতা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুরুতে ২০০১ সালের ২৯ মে কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয় কর ছাড়া ৬১ দশমিক ৫০ ডলার। এরপর জুলাই ২০০৮ এ এই দাম বাড়িয়ে ৭১ দশমিক ৫০ ডলার করা হয়। এর পর ২০১২ এর ১ ফেব্রুয়ারি ১০৬ ডলার, ২০১৫ এর ১ মে ১৩১ দশমিক ৫০ ডলার এবং ২০১৭ এর ১ জুলাই ১৩০ ডলার (কর ব্যতীত) কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়। পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান সংস্থার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইন) প্রকৌশলী মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যচ্ছে না। তবে এই কয়লা চুরি করে বিক্রি করা হতে পারে বা চীনা কোম্পানি কয়লা নাও তুলতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি দ্বিমত পোষণ না করে বলেন, সবই হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে বড়পুকুরিয়া খনির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুজ্জামান চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন। কাগজে কলমে না হলেও তিনি পিআরএল এ থাকা অবস্থা থেকই ঠিকাদান কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছেন বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র। কয়লা খনির কেউ কেউ মনে করছেন ঠিকাদার কোম্পানির নির্দিষ্ট কোন সময়ে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাতে পারে। এতে কয়লা না তুলেই তারা অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। আগে প্রতি টন কয়লা তোলার বিপরীতে ঠিকাদার কোম্পানিতে শুরুতে ৫২ ডলার করে পরিশোধ করতে হতো এখন প্রতিটনের বিপরীতে ৮২ ডলার করে পরিশোধ করতে হয়। ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এমন কোন ব্যবস্থাপকের সময় এই দুর্নীতি ঘটতে পারে। কয়লা পরিমাপ করা হয়নি তাই এমন সুযোগ অতীতে কারও নেয়া অসম্ভব নয় বলে পেট্রোবাংলার সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। তিনি বলেন, এমন দুর্নীতি সব সময় জুড়েই হয় না। কোন কোন সময় কারও কারও ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে হয়ে থাকতে পারে। তিনি একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ঠিকাদার কোম্পানির সখ্যতার কথা জানান। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আমিনুজ্জামান এর কাছে এ বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে তিনি কাজ করছেন না। দুদকের অনুসন্ধান কমিটি গঠন ॥ এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন খনি দুর্নীতি তদন্তে তিন সদস্যর অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। সোমবার গঠিত তিন সদস্যর অনুসন্ধান কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে সংস্থার উপ-পরিচালক শামসুল আলমকে। এছাড়া কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক এএসএম সাজ্জাদ হোসেন এবং এএসএম তাজুল ইসলাম।
×