ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জীবিত ৮ জনের নামে অভিযোগ দাখিল;###;তদন্তে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১৩ জনকে অব্যাহতি;###;দুই আসামি পলাতক;###;নর্থ সাউথের শিক্ষক হাসনাত করিমকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতি

চার্জশীট ॥ ৭৫২ দিন পর ॥ হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৪ জুলাই ২০১৮

চার্জশীট ॥ ৭৫২ দিন পর ॥ হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা

শংকর কুমার দে/ গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ ২ বছর ২২ দিনের (৭৫২ দিন) তদন্ত শেষে দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। আদালতে দাখিল করা চার্জশীটে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাওয়ার কথা উল্লেখ করে জীবিত ৮ জনের নামে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর থান্ডার বোল্ট অপারেশনে জঙ্গী হামলার সময়ে ঘটনাস্থলেই ৫ জন নিহত এবং মামলা তদন্তনাধীনকালে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৮ জনসহ নিহত ১৩ জনকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যে ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ৬ জন আটক ২ জন পলাতক রয়েছে। চার্জশীটে ৭৫ আলামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা আদালতে পাঠানো হয়েছে। চার্জশীটে মোট সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে ২১১ জনের। এর মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অফিসার, ফরেনসিক টেস্ট যারা করেছেন, তাদের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পায়নি উল্লেখ করে চার্জশীট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাকে। দেশকে অস্থিতিশীল করে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে সরকারকে কোণঠাসা করার মাধ্যমে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বিদেশী ক্রেতারা ফিরে যাওয়ার জন্য হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলা চালানো হয় বলে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটপ্রধান মনিরুল ইসলামের দাবি। চার্জশীটে উল্লেখ করা হয়, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় সরাসরি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি, কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা পেতে এই জঙ্গী হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্য ছিল এ হামলার উদ্দেশ্য। সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গী হামলাকারীরা ৬ মাস আগে থেকে বিভিন্ন জায়গায় রেকি করে হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করে। তদন্ত প্রতিবেদনে চিহ্নিত ২১ জনের মধ্যে ৫ জন সরাসরি হামলায় অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড) তামিম চৌধুরী, মূল প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেনার) মেজর জাহিদ কিংবা তানভির কাদেরী, নুরুল ইসলাম মারজান ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসামি। গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুই জঙ্গীকে নিয়োগ করেন রাজীব আর বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া ও জঙ্গীদের উদ্বুদ্ধও করেন তিনি। হাদিসুর রহমান সাগর সীমান্তের ওপার থকে আসা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছায়। বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফা হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন এবং সেই টাকা হামলায় ব্যবহৃত হয়। হলি আর্টিজানে প্রচুর বিদেশী নাগরিক খাওয়াদাওয়া করতে আসতেন। এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রায় ছিলই না। তাই এই রেস্টুরেন্টকে তারা বেছে নেয়। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় সহজে। এ ছাড়া সে দিন ছিল শুক্রবার, ২৭ রমজান, বেশি সওয়াব পেতে তারা ওই দিন হামলা চালায়। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এ ঘটনায় হাসনাত করিম, সাইফুল চৌকিদার ও শাওনের জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। যারা পালিয়ে আছেন, তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে আদালতে ওয়ারেন্ট ইস্যু করার দাবি জানানো হয়েছে। হলি আর্টিজানে হামলার সময়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত হন ৫ জন। এরা রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। দীর্ঘ দুই বছরাধিকালের তদন্তের বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৮ জন। তারা হলেন তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। জীবিত আটজনের মধ্যে ৬ জন কারাগারে আটক। তারা হলেন রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা। এ মামলায় পলাতক ২ আসামি হচ্ছে শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন। তিনি বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, আসামিরা ৫ মাস আগে থেকেই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গী রাষ্ট্র বানানো, সরকারকে চাপের মুখে ফেলা। সোমবার সকালে মিন্টো রোডে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা ওই অভিযোগপত্র আদালতে পাঠিয়েছেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে জঙ্গীরা হামলা চালায়। তারা অস্ত্রের মুখে দেশী-বিদেশী অতিথিদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে ৫ জঙ্গীসহ ৬ জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশীসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হলি আর্টিজানের একজন বেকারিকর্মী। হাসনাত করিমের নাম নেই ॥ হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় মামলার চার্জশীটে হাসনাত করিমের নাম নেই। একজন কোরিয়ান নাগরিকের গোপনে ধারণ করা ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর হাসনাত করিমের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। জঙ্গী হামলার পরদিন ভোরে ধারণ করা ওই ভিডিওতে হাসনাত করিমকে জঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গিয়েছিল। হলি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযান শুরুর আগের এক ছবিতে ক্যাফের ছাদে দুই ব্যক্তির সঙ্গে হাসনাত রেজাউল করিমকে দেখা যায়। কমান্ডো অভিযানে যে পাঁচ হামলাকারী নিহত হন, তাদের মধ্যে নিবরাজ ইসলাম নর্থসাউথের শিক্ষার্থী ছিলেন, যেখানে হাসনাত এক সময় পড়াতেন। জঙ্গী রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে হাসনাত করিম ও অস্ত্র হাতে তাহমিদ (কালো টি-শার্ট পরা) কমান্ডো অভিযানের আগের এই ছবি সোশাল মিডিয়ায় আলোড়ন তোলে। হাসনাতের সঙ্গে উদ্ধার তাহমিদ হাসিব খানকে নিয়েও দেখা দিয়েছিল সন্দেহ; কারণ ভিডিওতে তাকে অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছিল। তবে পরে পুলিশ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কানাডায় পড়াশোনারত তাহমিদকে। পরে তিনি মুক্তি পেলেও হাসনাত করিম আটকে আছেন। তবে হাসনাতের স্ত্রী জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, জিম্মি অবস্থায় তাদের বিভিন্ন নির্দেশ মেনে কাজ করতে হয়েছিল। হলি আর্টিজানের ছাদে হামলাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে তাকে আলাপচারিতায় দেখা যায় তাকে। তখন জঙ্গীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার, আগ্নেয়াস্ত্র নাড়াচাড়ারসহ অনেক জঙ্গী সম্পৃক্ততা ধারণ করা দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পরদিন সকালে উদ্ধারকৃত জিম্মিদের মধ্যে রহস্যজনক আচরণের কারণে হাসনাত করিমকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেয়া হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর হাসনাতকে ছেড়ে দেয়ার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলেও তাকে আর ছাড়া হয়নি। হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় ওই বছরের ৩ আগস্ট তাকে ৫৪ ধারায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। ৪ আগস্ট প্রথম দফায় হাসনাত করিমের আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৩ আগস্ট গুলশান হামলার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় এবং ২৪ আগস্ট হাসনাত করিমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। হাসনাত করিম বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন। যেভাবে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে ॥ ২০১৬ সালের ১ জুলাই, শুক্রবার। রাত প্রায় পৌনে নয়টা। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে স্প্যানিশ রেস্তরাঁ হলি আর্টিজানে কয়েক যুবক অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় গুলিও ছোড়ে তারা। তখন সেখানে পুলিশ গেলে তাদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। গুলি বিনিময়ের শুরুতেই গুলিতে প্রদীপ ও আলমগীর নামের পুলিশের দুজন কনস্টেবল ও আবদুর রাজ্জাক নামের এক পথচারী আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ ওই এলাকা ঘেরাও করে ফেলে। তখন রাত ১০টা। গুলি-বোমায় আহত হয় পুলিশ সদস্যরা। হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে একের পর এক গুলি ও বোমার আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ভেতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনসহ আহত কয়েক পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। রাত প্রায় ১১টায়, আইএসের দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করে। আর্টিজানে হামলাকারী উল্লেখ করে শুক্রবার রাত দেড়টায় পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গীগোষ্ঠীর ইন্টারনেট ভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এ তথ্য প্রকাশ করে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। এ সময় ঘটনাস্থলে আসেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের জানান, আর্টিজানের ভেতরে অন্তত ২০ বিদেশীসহ কয়েক বাংলাদেশীও আটকা পড়েছে। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই সঙ্গে অভিযানের ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার না করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি রাতেই সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযানে অংশ নেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্যে খবর প্রচার হয় শুক্রবার রাতেই ২০ জনকে হত্যা করা হয়। নিহত ২০ জনের মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশী। পরের দিন ২ জুলাই শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযানের শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে এ অভিযান থান্ডার বোল্ট। মাত্র ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব জঙ্গীদের নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অভিযানের মাধ্যমে একজন জাপানী, দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করার সাফল্য অর্জিত হয়। হামলাকারীরা ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। হলি আর্টিজানে ১২ ঘণ্টার এই জিম্মি ঘটনায় ২০ জিম্মি, ছয় সন্ত্রাসী, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৮ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০ পুলিশ সদস্য। শ্বাসরুদ্ধ কর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফিরে আসে গোটা দেশে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও শোক দিবস ॥ অভিযান শেষে ২ জুলাই শনিবার, রাত পৌনে ৮টায় রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। ৩ জুলাই ও ৪ জুলাই রাষ্ট্রীয় শোকের দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও জনগণকে কালো ব্যাজ ধারণ করতে বলা হয়। এ ছাড়া মসজিদে মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা করার কথা জানানো হয়। সেই সঙ্গে জঙ্গীদের নির্মূল করে বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেভাবে ২১ জনের সম্পৃক্ততা ॥ জঙ্গী হামলায় জড়িত ২১ জনের মধ্যে কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ ছাড়াও আরও আট জন বিভিন্ন সময় পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে মারা গেছে। গ্রেফতার হয়ে ছয় জঙ্গী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এখনও দুই জঙ্গী পলাতক রয়েছে। নিহত তামিম চৌধুরী ॥ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীকে গুলশান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তুরস্ক হয়ে দেশে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে জুনুদ আল তাওহিদ নামে একটি জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলে। পরে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা আব্দুস সামাদ মামু, মামুনুর রশীদ রিপন ও সরোয়ার জাহানের সঙ্গে মিশে নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠন গঠন করে। তার পরিকল্পনাতে হামলা হয়। হামলার দিন সে মিরপুরের একটি আস্তানায় বসে দুই সহযোগীসহ হামলার ঘটনা অনলাইনের মাধ্যমে দেখভাল করে। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ সদর দফতর ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে দুই সহযোগীসহ নিহত হয়। নিহত সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ॥ তিনি ছিলেন গুলশান হামলার শীর্ষ পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম। নব্য জেএমবির আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন। হামলার আগে তামিম চৌধুরীসহ পাঁচ হামলাকারীকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় বসে সর্বশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এক সময় পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ছিলেন। তামিম চৌধুরীর মাধ্যমে নব্য জেএমবিতে যোগাদান করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলি ইউনিয়নের নামো মুশরীভূজা গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে ছিলেন। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ার একটি বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানকালে পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালানোর সময় মারা যান। নিহত তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ ॥ হলি আর্টিজানের হামলাকারী জঙ্গীদের আশ্রয় ও অর্থ দেয়ার পাশাপাশি সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। হামলার আগে বিভিন্ন সময়ে নব্য জেএমবির জঙ্গীদের নিজ বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছেন। হামলার আগে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকের ৬ নম্বর সড়কের টেনামেন্ট নম্বর বাড়ির এ/৬ নম্বর ফ্ল্যাট হামলাকারী জঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। হামলার আগে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ওই বাসা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল পাঁচ জঙ্গী। হামলাকারী জঙ্গীরা যাওয়ার পর তিনি তার স্ত্রী ও সন্তান, তামিম চৌধুরী, মারজান ও রাজীব গান্ধী ওই বাসা ছেড়ে চলে যান। ডাচ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকাকালীন সময়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম বাটিকমারি গ্রামে তার বাড়ি। পিতার নাম বাতেন কাদেরী। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর এলাকায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক অভিযানে পুলিশের ওপর হামলার এক পর্যায়ে তিনি মারা যান। নিহত নূরুল ইসলাম মারজান ॥ গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি। শীর্ষ জঙ্গী নেতা তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা ছিল তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে পড়ার সময় জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের পর স্ত্রীকেও জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাড়ি পাবনা সদর থানার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়া গ্রামে। পিতার নাম নিজাম উদ্দিন। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যান তিনি। নিহত বাশারুজ্জামান চকোলেট ॥ শীর্ষ জঙ্গী নেতা তামিম চৌধুরীর সহযোগী ছিলেন তিনি। গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তামিম চৌধুরীর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে তথ্য আদান-প্রদান ও হামলাকারীদের দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গীকে একই রঙের গেঞ্জি, ট্র্যাক সু ও জুতো কিনে দিয়েছিলেন তিনি। তার পিতার নাম সিরাজ উদ্দিন। বাড়ি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার লালপুর গ্রামে। ঢাকার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রীধারী ছিলেন। তিনি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা তার শ্বশুরবাড়িতে থাকা অবস্থায় জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল শিবগঞ্জে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক জঙ্গী বিরোধী অভিযানে নিহত হন তিনি। নিহত মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান ॥ গুলশান হামলায় অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের কাজটি করেছিলেন তিনি। পুরনো জেএমবির সদস্য ছিলেন তিনি। পরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। তার প্রধান কাজ ছিল সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচার করে আনার পর তা বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানায় পৌঁছে দেয়া। তিনি আমের ঝুঁড়িতে করে অস্ত্রগুলো সীমান্ত থেকে ঢাকায় এনে হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে বাশারুজ্জামান চকোলেটের সঙ্গে তিনিও নিহত হন। নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ॥ গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের প্রশিক্ষক ছিলেন ছিলেন। তিনি নব্য জেএমবিতে ‘মেজর মুরাদ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানায় হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীদের শারীরিক ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের চাঁন্দপুর গ্রামে। পুলিশের সাবেক পরিদর্শক নুরুল ইসলামের ছেলে ছিলেন তিনি। কানাডা যাওয়ার কথা বলে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে নব্য জেএমবির আরেক নেতা মুসার মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রী ও সন্তানকে হিজরতের নামে সঙ্গে নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টার দিকে মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক অভিযানে নিহত হন তিনি। নিহত রায়হান কবির ওরফে তারেক ॥ গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের আরেক প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। গাইবান্ধায় নব্য জেএমবির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। তার বাড়ি রংপুর জেলার পীরগাছা থানার পাশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম শাহজাহান মিয়া। ২০১৩ সালে একই ইউনিয়নের দামুরচাকলা এলাকার দেওয়ান সালেহ আহম্মেদ মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। ঢাকায় এসে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই মিরপুরের কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আট সহযোগীসহ নিহত হয়। হামলায় অংশ নেয়া নিহত জঙ্গী রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ॥ হলি আর্টিজানে হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীর দলনেতা ছিলেন তিনি। তার সাংগঠনিক নাম ছিল আবু রাহিক আল বাঙালি। ঢাকার ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়া অবস্থায় অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঘর ছাড়েন। নব্য জেএমবির বিভিন্ন আস্তানায় প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে সরাসরি হামলায় অংশ নেন। তার পিতার নাম ইমতিয়াজ খান বাবুল। বাড়ি ঢাকার লালমাটিয়ার বি ব্লকের ৭/৯ নম্বর প্লটে। জঙ্গী হামলার পরদিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন তিনি।
×