ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

অভিমত ॥ সুন্দরবন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৪ জুলাই ২০১৮

অভিমত ॥ সুন্দরবন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রমুখী সীমানার নিকটবর্তী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মোহনায় অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্য সুন্দরবন। এটি প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি। দুই বাংলাব্যাপী এ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিস্তৃতি হলেও বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ০১৭ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। মোট দশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের অরণ্যটি ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ’ হিসেবে স্থান পেয়েছে। এই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর অরণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আর রোমাঞ্চকর বলেই হয়ত এ জঙ্গলের গুরুত্ব অপরিসীম পর্যটকদের কাছে। যার ফলে প্রকৃতির এ লীলাভূমি দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক ছুটে আসেন সুন্দরবন এলাকায়। ফলে পর্যটন খাতে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকি। শুধু পর্যটন খাতেই নয়, মৎস্য, মধু, গোলপাতা ও জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক ব্যবহৃত বহুবিধ জিনিসের মাধ্যমে সরকার প্রচুর রাজস্ব পেয়ে থাকে সুন্দরবন থেকে। সে দিকটি বিবেচনা করে সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছেন সুন্দরবনকে আগামী দশ বছরের জন্য সংরক্ষণ করার। সরকারের এই উদ্যোগের প্রশংসা না করে পাড়ি না আমরা। যদিও এ উদ্যোগটি নেয়া উচিত ছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর বয়ে যাওয়ার পর পরই। সুন্দরবন দেশের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি দেশের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। সেই সুবাদে অরণ্যটির গুরুত্ব ব্যাপক। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য দুর্লভ। সুন্দরবনে প্রায় ৪২৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রাণীদের মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। বিপন্ন প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনেরও বাস সুন্দরবনের জলজ সীমানায়। সব মিলিয়ে সুন্দরবনের আকর্ষণ যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে বহু প্রাপ্তিও। প্রাপ্তিটিও বিরাট অঙ্কের। বছরে প্রায় ৫ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট (আইএফই এসসিইউ) এক সমীক্ষায় জানিয়েছে ওই তথ্য। এর বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছে, পর্যটন থেকে বছরে আয় হয় ৪১৪ কোটি টাকা। বনজীবীদের আয় ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে ৩৮৮১ কোটি টাকার সম্পদ। সমীক্ষায় জানা যায়, পেশাজীবীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ জ্বালানি কাঠ, ৬.৩ শতাংশ মধু ও মোম, ৯.৪ শতাংশ গোলপাতা, ৫৪.৮ শতাংশ মাছ. ১৮ শতাংশ চিংড়ি, ২৯ শতাংশ কাঁকড়ার মাধ্যমে বছরে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হয়। এতে করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অপরদিকে দেশী-বিদেশী পর্যটন খাত থেকেও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব সরকারের ভা-ারে জমা হচ্ছে প্রতি বছর। বন বিভাগের এক গবেষণায় জানা যায়, সুন্দরবন বছরে প্রায় ১৬ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ধরে রাখতে সক্ষম। যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে বলতে পারি সুন্দরবন আমাদের জন্য প্রকৃতির এক বিশেষ অবদান। যার সঠিক ব্যবহারে আমরা আরো সমৃদ্ধ হতে পারি। সেটি করতে গেলে আমাদের প্রথমে বন রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বিশেষ করে অবাধে বৃক্ষ নিধন, গোলপাতা আহরণ, মৎস্য আহরণ এসবের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। চোরাকারবারীদের প্রতিহত করতে হবে। বাঘ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সর্বপ্রথম। বাঘকে শত্রু নয়, বন্ধু ভাবতে হবে। সুন্দরবন হচ্ছে আমাদের জাতীয় বন। এখানকার জঙ্গল দেশের অন্য সব জঙ্গলের মতো নয়; অত্যন্ত দুর্গম। এ জঙ্গল সম্পর্কে যারা জানেন তারাই বোধ করেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা। অথচ আমাদের দেশের দুর্গম এ অরণ্যে অপারেশনে যাওয়ার মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী নেই। নেই সুন্দরবনের অপরাধ নিধনের জন্য আলাদা কোন বাহিনী। তার পরেও সরকার বন রক্ষায় সচেষ্ট রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বনদস্যুদের উৎপাত অনেকাংশে দমন করেছেও। বিশেষ করে র‌্যাবের মাধ্যমে সুন্দরবনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আগের মতো জিম্মি বা অপহরণ এতদাঞ্চলে তেমন ঘটে না এখন। বিছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সেটি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট তৎপর থাকে। তাতে করে সুন্দরবন থেকে সরকারের রাজস্ব বাড়বে বৈ কমবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক বন্যপ্রাণী বিশারদ
×