ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিপুল আয়োজনে জাতীয় বৃক্ষমেলা

চিরহরিৎ গাছের জন্য মায়া, হৃদয়াবেগ সবুজে বাঁচার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৩ জুলাই ২০১৮

চিরহরিৎ গাছের জন্য মায়া, হৃদয়াবেগ সবুজে বাঁচার স্বপ্ন

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকায় বৃক্ষের পরিমাণ এত কম, এত যে, মনে হতে পারে এখানে কেউ সবুজ ভালবাসে না। সবুজের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে সবার। আদতে তা নয়। লোভী জমিদারের কথা বাদ দিলে, ভূমি দস্যুদের কথা না তুললে, বাকিরা বৃক্ষকে আদি প্রাণ জ্ঞান করেন। ভালবাসেন মন থেকে। প্রমাণÑ শহুরে বাসা বাড়ির বারান্দা। ছাদ। ছোট ছোট জায়গা টব দিয়ে সুন্দর সাজানো। সেখানে ফুলের গাছ। ফলের গাছ। পাতার বাহার। এ অংশটি সারাবছর নতুন নতুন গাছের সন্ধান করে। সংগ্রহ করে। এবং এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সহায়তা করে জাতীয় বৃক্ষ মেলা। শহুরে প্রজন্ম এ মেলা ঘুরে গাছ চেনার, গাছ সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। চলে নানা জাতের গাছ ও চারার প্রদর্শনী। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। একটু দেড়ি করে শুরু হলেও, মোটামুটি জমে উঠেছে মেলা। আগারগাঁয়ের যেখানে বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ১৮ জুলাই এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এখানে এখন গাছ আর গাছ। বিশাল জায়গা জুড়ে স্টল সাজানো হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নার্সারি মালিকরা গাছ ও চারা বহন করে এখানে নিয়ে এসেছেন। আছে সরকারী প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধ উপস্থাপনা। প্রথমেই চোখে পড়ে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের প্যাভিলিয়নটি। এখানে গাছগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টলের দায়িত্বে থাকা রইস উদ্দীন জানান, তাদের কাছে ৭৭ প্রজাতির ফলজ, ১০১ প্রজাতির বনজ, ১২৯ প্রজাতির ঔষধী, ২০ প্রজাতির ক্যাকটাস, ১৩০ প্রজাতির অর্নামেন্টাল, ২০ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। মেলায় আনা বনজ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে পশুর, দেশী গাব, বকুল, সেগুন, গর্জন, মেহগনি, আকাশমণি, রেইন ট্রি, তেলশূড়, শিশু, লোহাকাঠ, চাপালিশসহ বেশকিছু জাত। এসব গাছ সচরাচর দেখা যায় না। স্টলে গাছগুলো খুঁটিয়ে দেখা যাচ্ছে। ঔষধী গাছেরও বড় সংগ্রহ এখানে। আছে উলটচন্ডাল, আকন্দ, ফণিমনসা, নিম, অর্জুন, বাসক, হরীতকী, আমলকি, বহেড়া, কালো তুলশী, কাসুন্দি, লজ্জাবতী, শতমূলের মতো দুর্লভ নবীন গাছ। মসলা প্রজাতির গাছের মধ্যে রয়েছে মরিচ, দারুচিনি, আদা, পুদিনা, এলাচ, বিলাতি ধনে আরও কত কী! জলাশয়ের মতো করে কাটা মেঝেতে দেখা যাচ্ছে আমাজান লিলি। সাদা লাল নীল শাপলা। আছে কয়েক জাতের পদ্ম। কচু প্রজাতির গাছও রয়েছে। সব মিলিয়ে বড় সংগ্রহ। সময় নিয়ে দেখা চাই। সময় নিয়ে দেখা গেলে বাংলাদেশের বৃক্ষ সম্পর্কে একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ধারণা এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। মেলার বেশির ভাগ স্টল সাজিয়েছেন নার্সারি মালিকরা। তাদের প্রায় সব স্টলেই আছে ফুলের গাছ। ছোট ছোট গাছে হরেক রঙের ফুল ফুটে আছে। দেখে মন ভরে যায়। প্রায় সব স্টলের সামনেই কম বেশি গোলাপ দৃশ্যমান। কিছু ইন্ডিয়ান জাত। কিছু ইরানী। ঘ্রাণ কম হলেও, অনেকগুলো রং। সাদা, কমলা, বেগুনী, হলুদ রঙের গোলাপ পাশাপাশি সাজানো আছে। আকারে বড় ফুলের গাছ বিক্রিও হচ্ছে ভাল। জুঁই ফুলের এখন মৌসুম। মেলার একাধিক স্টলে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। মিষ্টি ঘ্রাণ। শহরের বাসা বাড়িতে ফুলটি কম দেখা যায়। তবে আগ্রহীরা মেলা থেকে গাছ সংগ্রহ করতে পারবেন। মধুমঞ্জরি লতা, অনেকেই একে ভুল করে মাধবী লতা বলে থাকেন, মেলায় এ ফুলটিও দারুণ মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। পলিপ্যাকে দিব্যি ফুটে আছে জারবেরা। মানিকগঞ্জ নার্সারি নামের একটি স্টলে লাল ছাড়াও, পাওয়া গেল গোলাপী ও বাদামী রঙের জবা ফুল। স্টলের কর্মী তৈয়ব জানালেন, এগুলো থাই জবা। পলি প্যাকে রাখা গাছের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। শহুরে সৌখিন মানুষের কাছে অর্কিডের আলাদা চাহিদা রয়েছে। মেলা ঘুরে অন্তত ৫টি স্টল খুঁজে পাওয়া গেল, যেগুলো শতভাগ অর্কিড দিয়ে সাজানো। তেমন একটি স্টলের নাম ডানকানস অর্কিড। এখানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরারও মুগ্ধ হয়ে অর্কিড দেখছিল। স্টলের কর্মী হৃদয় জানালেন, তারা শুধুই অর্কিড নিয়ে কাজ করেন। পাঁচ প্রজাতির অর্কিড প্রদর্শন করা হচ্ছে মেলায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেন্ড্রোডিয়াম সনিয়া, ডেন্ড্রোডিয়াম সাথো পিঙ্ক, ডেন্ড্রোডিয়াম সাকুরা পিঙ্ক, ডেন্ড্রোডিয়াম হুয়াইট ও রেডবল নামের অর্কিড। দাম একটু বেশি। তবে সৌন্দর্যের তুলনায় সে দাম অতি অবশ্যই নগন্য। পাতাবাহার নিয়েও আগ্রহ আছে শহুরেদের। ঘর সাজাতে পাতাবাহার খুব কাজে আসে। তাই নানা রকমের পাতাবাহার রাখা হয়েছে স্টলে। মেলায় আরও আছে বহু বছর বয়সী ক্যাকটাস। কাঁটায় ঘেরা ক্যাকটাস এমনিতেই দেখতে সুন্দর। তার উপর ফুলও হয়। প্রমি গার্ডেন নামের একটি স্টলে প্রতিবছরই সাজিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন জাতের ক্যাকটাস। এবারও আছে। স্টলের দায়িত্বে থাকা মুরাদ জানলেন, কয়েক লাখ টাকা দামের ক্যাকটাস আছে তাদের সংগ্রহে। আবার ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকায়ও কেনা যাবে ক্যাকটাস। মেলায় আছে নানা জাতের ফলের গাছ। কাঁঠাল, লিচু, কামরাঙ্গা, করমচা, জলপাই, আমড়াসহ প্রায় সব দেশী ফলর চারা পাওয়া যাচ্ছে। স্ট্রবেরি, ড্রাগনের মতো বিদেশী ফলের গাছও আছে। ছোট ছোট গাছে বড় বড় ফল। পেটকাটা ড্রামে মাটি ভর্তি করে এসব গাছ লাগানো হয়েছে। এই টুকুন গাছের ফলন দেখে চোখ কপালে ওঠতে বাধ্য। আমটাই বেশি দেখা যায়। ডিসি নার্সারি এ্যান্ড সার্ভিসেস নামের একটি স্টলের সামনে অনেক আম গাছ। প্রত্যেকটিতে রিষ্টপুষ্ট পাকা আম ঝুলে আছে। দৃশ্যটি দেখার মতো। স্টলের কর্মী অশোক দেবনাথ জানালেন, তাদের এখানে আমের ৫৫ থেকে ৬০টি ভ্যারাইটি রয়েছে। আরও মজার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, নিজের ছাদ বাগানে ৮ থেকে ১০ জাতের আম গাছ রাখা গেলে বারো মাসই ফল খাওয়া যাবে। স্বাদও নাকি ভাল। মেলা থেকে ফল ধরা অবস্থায় একটি গাছ ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কেনা যাবে বলে জানান তিনি। পল্লী নার্সারিতে পাওয়া গেল গাছ ভর্তি পেঁপে। বড় টবে লাগানো গাছে ১০ থেকে ১২টি করে পেঁপে ধরে আছে। প্রতি গাছের দাম ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। পাশের একটি গাছে ধরে আছে বড় বড় শরিফা। বিক্রয় কর্মী মোঃ তৈয়ব জানান, এক একটি ফলের ওজন দেড় কেজি থেকে পৌনে দুই কেজি। আর গাছের দাম? ৭০ হাজার টাকা। এখন লটকনের সময়। মেলার বিভিন্ন স্টলে আছে লটকন গাছ। ফল ধরা অবস্থায় দেখতে বেশ লাগে। হাত দিয়ে পেড়ে খাওয়ার ইচ্ছে হয়। আছে লেবু গাছও। কলম্ব নামের একটি লেবু তো পেঁপের মতো বড় দেখতে। বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এর স্বাদ অন্য লেবুর মতো টক নয়। কিছুটা মিষ্টি। শুধু রস নয়, মোটা বাকলও খাওয়া যায় বলে জানান তিনি। লেবুসহ গাছের দাম ১৫ হাজার টাকা। মেলায় আরও পাওয়া যাচ্ছে বনসাই। অল্প জায়গায় পরিপক্ষ বৃক্ষের আদল। দেখে বিস্মিত হতে হয়। সব মিলিয়ে বৃহৎ এবং চমৎকার একটি মেলা। সব গাছ কিনে ঘরে তুলতে মন চাইবে। তাই যাব যাব নয়। যান। ঘুরে আসুন। গাছের সঙ্গে থাকার কী যে প্রশান্তি, না গেলে উপলব্ধি করতে পারবেন না।
×