ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

পাল তুলে দাও নায়ে তোমার বৈঠা ধর শক্ত হাতে

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২৩ জুলাই ২০১৮

  পাল তুলে দাও নায়ে তোমার বৈঠা ধর শক্ত হাতে

শ্রাবণের আকাশ জুড়ে যখন সাদা মেঘের ভেলা ভাসছিল, তখন গণসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি সদর্পে উচ্চারণ করলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করাই তার একমাত্র লক্ষ্য। অর্থাৎ বাংলার মানুষের জীবনমান উন্নত করা, সুন্দর জীবন উপহার দেয়ার ব্রতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মেধা-মনন জ্ঞানকে দেশের কাজে লাগিয়ে একটি উন্নত জাতিতে রূপান্তরিত হোক বাংলার মানুষ কায়মনোবাক্যে সেই প্রার্থনাই তিনি করলেন। নিজের জীবন দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করার কথা আবারও উচ্চারণ করে জানান দিলেন। বাংলার মানুষ যেন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার পায়, দেশ যেন হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ, হাহাকারমুক্ত জীবন-যাপন যেন হয় বাংলাদেশের মানুষের- সেই লক্ষ্যে তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করে স্পষ্ট করলেন। পিতার আরাধ্য কাজ সম্পন্ন করতে নিজেকে নিবেদিত করেছেন। উপস্থিত জনগণ মনমুগ্ধের মতো তার সেই ভাষা শ্রবণ করে উদ্দীপনার জগতে নিজেদের সমর্পিত করেছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত গণসংবর্ধনার জবাবে বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও উন্নয়নের ভরসাস্থল শেখ হাসিনা হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল প্লাবিত করে স্মরণ করিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মানুষ যা কিছু অর্জন করছে, মহান ত্যাগের মাধ্যমেই তা অর্জন করেছে। বিনয়ের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি জনগণের জন্য কাজ করতে এসেছি। তাদের জন্য কাজ করছি। এদেশের মানুষের ভাগ্য যেদিন পরিবর্তন হবে, সেদিন নিজেকে সার্থক মনে করব।’ সার্থকতা তাকে এসে ধরা দেবেই। কারণ যে পথ ধরে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, সে পথেই বাজে মুক্তির গান। মুক্ত মানুষের স্বাধীনতা অধিকার ধ্বনিত হয় সেই পথ ধরেই। আর তিনি উচ্চারণ করতে পারেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ তার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ধ্বনিত হয়ে উঠতে পারে জীবনভর। আর বাংলার মানুষও প্রতিধ্বনি করে উঠতে পারে, ‘আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। বাংলার মানুষের যুগে যুগে তিনি হয়ে উঠেছেন তাদের একমাত্র আপনজন। তারই দিক নির্দেশনায় হতশ্রী দরিদ্র জাতি আজ লাভ করেছে শ্রীরূপ। আর সচ্ছলতার ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানবের স্তরে নিজেদের পৌঁছে দিতে পেরেছে। এই যে দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের পথে ক্রমশ যাচ্ছে এগিয়ে, সবই তো তাঁরই অবদান। তাঁর শ্রম, কর্মনিষ্ঠা, কুশলতা, জনজীবন সংশ্লিষ্টতায় নিম্ন আয়ের দেশটি আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে আর বসবাস করে না দেশের মানুষ। দু’বেলা দু’মুঠো আহার জোটাতে আর প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয় না। কচুঘেচু খেয়ে দিন কাটাতে হয় না মানুষকে। দুর্ভিক্ষ শব্দটাই মুছে গেছে যেন বাংলার অভিধান থেকে। যে শব্দটি সামরিক জান্তা শাসনমালে না খেয়ে মারা গেলেও বলা যেত না; বলতে হতো ‘ভিক্ষার অভাব’- সেই গ্লানিময় শব্দ আজ তাঁর হাতের ছোঁয়ায় মিইয়ে গেছে। বাংলার প্রতিঘর ভরে দিয়েছেন তিনি অন্নে। বস্ত্রহীন মানুষের করুণ চিত্র আর দেখা যায় না। জাল পরে থাকা নারীর বানোয়াট আলোকচিত্র নির্মাণে তাই ব্রতী হতে পারে না কোন আলোকচিত্র। দুয়ারে দুয়ারে ভাত আর ফেনের জন্য কোন চিৎকার ধ্বনি শোনা যায় না। ভিক্ষার হাতগুলোকে কর্মীর হাতে পরিণত করে মানুষের মর্যাদায় তাদের উন্নীত করার দিগন্ত তিনিই তৈরি করেছেন। ডাক দিয়েছিলেন তিনি নয় বছর আগে দিন বদলের, সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে ষোলো কোটি মানুষ। তাই দেশ তার অগ্রগতির পথে, সমৃদ্ধির রথে চড়ে আরও প্রাগ্রসর হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। যেন এপথ শুধু এগিয়ে চলার, নয়কো থামার। থেমে থাকা মানে অকর্মণ্য; আর জড়তায় স্থির হয়ে থাকা। কিন্তু তার দিন বদলের পালায় জড়তার কোন ঠাঁই নেই, নেই অকর্মণ্য মানুষের ভিড়। সব হাত আজ তাই কর্মীর হাতে পরিণত। যে হাতগুলো শক্তিমত্তায় বলিষ্ঠতায় জাতিকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির শিখরে। উন্নয়নের সোপানে তাই লিখে রাখে বাঙালী বাংলাদেশের নাম। এই জাতির জানা যে ‘আমাদের পথ চলা মুজিবের পথ বেয়ে।’ সেই পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলার মানুষ। স্বপ্ন তাদের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালীর কণ্ঠে বেজে উঠেছিল ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে’, তারও আগে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ বলে সামরিক জান্তা শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই শ্মশান থেকে, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ ফিনিক্স পাখির মতো আবার জেগে উঠেছে। শুধু জাগা নয়, শ্মশানের ভেতর গড়ে তুলেছে স্বপ্নের বাংলা। সোনায় মোড়ানো বাংলা আবার ফিরে এসেছে। সেই ১৯০৫ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠেছিলেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুণ্য হোক।’ শতবর্ষ পেরিয়ে শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলা আজ পুণ্য প্রাণের জোয়ারে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণতা লাভ করছে বাংলার মানুষ, বাংলার প্রকৃতি। সেই একাশি সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে তিনি বলেছিলেন ‘আমার বাবার প্রতি দেশের জনগণের প্রচ- ভালবাসা ও মমতা রয়েছে। জাতির জন্য তার যে স্বপ্ন, তা আমি পূরণ করব।’ সে দিনটিতে সমস্ত প্রকৃতি কেঁদে উঠেছিল একযোগে ‘ইলেক্টার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে’ যেন, প্রবল বর্ষণের মধ্যে সিক্ত তিনি এক নতুন জন্মলাভ করেছিলেন। বাংলার ভাগ্য পরিবর্তনের দায়ভার তুলে নিয়েছিলেন নিজ স্কন্ধে। বাংলার মানুষের সিঞ্চিত শ্রদ্ধা-ভালবাসায় লাভ করেছিলেন নবরূপ। নেতৃত্বের ভার তার হাতে তুলে দিয়েছিল এই বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। দেশ তখন ক্ষমতা দখলকারী জান্তা শাসকের হাতে ক্রমশ নিষ্পেষিত প্রায়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন ভূলুণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা দেশ তার হারিয়েছিল গৌরব। বহু যুগের সাধনা শেষে সেই গৌরবকে ফিরিয়ে এনেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের হৃদয় হতে উৎসারিত হয়ে ওঠে তারই নাম। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, মধুমতি, তিস্তাসহ দেশের সব নদ-নদী থেকে উঠে আসা তরঙ্গের ভেতর বহমান প্রাণপ্রবাহ তাকে উদ্দীপিত করে তোলে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গীকৃত করে তোলার জন্য। একুশবারের বেশি হামলা হয়েছিল তাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু ঘাতকরা জানে না, বাংলার প্রতিইঞ্চি মাটিজুড়ে, প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনে তারই প্রাণ স্পন্দন প্রবহমান। তাই জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য হয়ে আছে শেখ হাসিনার জীবনপ্রবাহে। গণসংবর্ধনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন শেখ হাসিনা ‘মৃত্যু’ যখন আসবে তখন মৃত্যু আসবেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে আমি মরতে রাজি নই। তার আগে যতক্ষণ জীবন আছে বাংলার মানুষের সেবা করে যাব।’ দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি কত ভালবাসা থাকলে তিনি নিবেদিত হতে পারেন তা তার গত চার দশকের জীবন চলার পথের বাঁকে বাঁকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জেল-জুলুমেও তাকে রোখা যায়নি। গর্জে উঠেছেন পিতার মতোই। শাণিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন ‘এই দেশেতেই জন্ম আমার, যেন এই দেশেতেই মরি।’ স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন বাংলার মানুষকে, সেই স্বপ্নপূরণে ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছেন আলোর মশাল হাতে। দিগদিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন স্বর্ণালোকিত জীবনের পিদিম শিখা। দেশবাসী জানে, জাতির পিতার কাছ থেকে পাওয়া রাজনৈতিক শিক্ষার আলোকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়াই তার লক্ষ্য। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশকে গড়ে তুলেছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, প্রতিটি গ্রামকে শহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে। অর্থাৎ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, আলোহীন, বুভুক্ষু জনপদ আর থাকবে না। অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা, বঞ্চনা, অভাব কুরে কুরে খাবে না গ্রামীণ জনপদের মানুষকে। ঝাড়-ফুঁক, টোটকা চিকিৎসায় আর মৃত্যুকে বরণ করতে হবে না। অনালোকিত গ্রামীণ মানুষকে নাগরিক সুবিধার আওতায় নিয়ে এসে বিশ্ব মানবের উন্নত জীবন ধারায় সংযুক্ত করার এই প্রয়াস সহস্র বছরের হতশ্রী, দরিদ্র বাঙালীর জীবনে এক নতুন মাত্রা এনে দেবে। শিক্ষা-দীক্ষায় সব দিক থেকে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে। ক্ষুধা আর হাহাকার থাকবে না। থাকবে না গৃহহারা কোন মানুষ। প্রতিটি বাঙালী পাবে উন্নত জীবন। যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের সম্পদ ও মানুষের অধিকার যার কাছে বড় তিনিই তো পারেন না আগামীর চলার পথ যে পথে হেঁটে যাবে বাঙালী দৃপ্তপায়ে, বলিষ্ঠ কণ্ঠে গাইবে ‘মুজিব পথে পেয়েছি যে, এই জীবনের সত্য মানে।’ প্রতিশ্রুতি পূরণে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই আজ বাঙালী দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও উচ্চাসনে। এসবই তার একক কৃতিত্ব। মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও সাহসী নেতৃত্বের জন্য বাংলার মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সবুজ মাঠ পেরিয়ে আজ তিনি বিশ্ব প্রান্তরে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। বিশ্বে খুব কম রাষ্ট্রনায়ক আছেন, যাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দেশের সমানÑ শেখ হাসিনা তেমনই একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, একজন নন্দিত নেতা। বাঙালীর ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকবেন শুধু নয়, স্বর্ণাক্ষরে গ্রন্থিত হবে তার কর্মময় জীবন ও শ্রম, নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা। এই বাংলার মানুষ তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে এক সময়ের হত্যা, সন্ত্রাস, ষড়যন্ত্র, জঙ্গীবাদ, অর্থপাচার ও দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আজ বিশ্বের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। শেখ হাসিনা সেই মডেলের স্রষ্টা। বাঙালীর চিরকালের সম্পদ তিনি। সোহরাওয়ার্দী-হক-ভাসানী-মুজিবের নৌকার কা-ারি তিনি গত চারদশক ধরে। দেশের জনগণ ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৭৩ সালে এই নৌকাকে ভোট দিয়েছিল। আবার ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ সালেও এই নৌকাকেই বেছে নিয়েছিল এদেশের জনগণ। ২০১৮ সালের শেষ অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বাঙলার মানুষ এই নৌকাতেই চড়বেÑ এমন প্রত্যাশা সবার। শেখ হাসিনা হাল ধরে আছেন যে নৌকার। তাই গেয়ে উঠতে পারি অতীতে লেখা আমার সেই কাব্যÑ ‘শেখ হাসিনা তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে/ পাল তুলে দাও নায়ে তোমার বৈঠা ধর শক্ত হাতে।’
×