ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুকাইয়া খান অনামিকা

ক্যাম্পাস আমার প্রথম প্রেম ॥ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ ক্যাম্পাস লাইফ

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২২ জুলাই ২০১৮

ক্যাম্পাস আমার প্রথম প্রেম ॥ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ ক্যাম্পাস লাইফ

ভর্তিযুদ্ধ শেষ করে সুযোগ হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ক্যাম্পাস জীবনের মতো রঙিন আর সুন্দর সময় নাকি একজন শিক্ষার্থীর জীবনে খুব একটা আসে না। প্রচ- শীতের এক সকালে মনের ভেতর অস্থিরতা আর নানান চিন্তা নিয়ে মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাসকে ‘আমার ক্যাম্পাস’ বলে পরিচয় দেয়ার প্রথম দিনটা আসলে সহজ ছিল না। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়েছিলাম প্রথম দিনেই। কিন্তু সখ্য হতে সময় লেগেছিল আরও কিছুটা সময়। অপরিচিত পরিবেশ, অচেনা মুখের ভিড় আর হুট করে বদলে যাওয়া জীবন। বাবা একটা কথা বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা জায়গা যা ভাল খারাপ দুটোই সমানভাবে দিবে, দু’হাত ভরে যতটুকু পার ভালগুলো আঁকড়ে ধরবে’। স্বপ্নের মতো সুন্দর প্যারিস রোড দিয়ে হেঁটে রবীন্দ্রভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর মাথার মধ্যে সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল। ব্যবসায় অনুষদের ক্লাস রুমে ঢুকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরাচরিত ছবির সঙ্গে খুব একটা মিল পেলাম না। বেশ সুন্দর আধুনিক ক্লাস রুম দেখে মন ভাল হয়ে গেল। সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচয় হলো, যদি ও তখনও বুঝিনি এই অল্প পরিচিত সহপাঠীদের মাঝেই খুঁজে পাব বন্ধুত্বের নিñিদ্র সম্পর্ককে। ধীরে ধীরে সময় কাটতে শুরু করল সাবাস বাংলার মাঠে গল্পে খেলাধুলায়। রানা ভাইয়ের দোকানের চিনি ছাড়া কড়া লিকারের দুধ চা ছাড়া যেন সকালটা বেমানান লাগতো। সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে টুকিটাকির আড্ডাটা জমিয়ে চলত। কেউ বা ছাত্রনেতা, কেউবা সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া কবি, আবার ছিল কিছু মঞ্চ কাঁপানো অভিনেতা, কেউ আঁকে ছবি। সকল ভিন্নতার এক অভিন্ন জায়গা এই প্রিয় রাবি ক্যাম্পাস। টানা ক্লাসের মাঝে কোন এক ক্লাস পিরিয়ডের আগে ক্লাস রিপ্রেন্টেটিভের সেই কাক্সিক্ষত ঘোষণা ‘আজ ক্লাস হবে না’। সমস্বরে উল্লাস করে সাগর ক্যান্টিনের গরম পুড়ি সিঙ্গাড়ার আড্ডাগুলো দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আবার সারাবছর ক্লাস, এসাইনমেন্ট, ক্লাসটেস্ট এর পর পরীক্ষার সময়গুলোতে ফটোকপির দোকানে ভিড় জমানো, ঘুমিয়ে পাড় করা ক্লাসগুলোর লেকচার বন্ধুর কাছে ফটোকপি করার আকুতি। রেজাল্টের সময় কারও কাক্সিক্ষত ফলাফল আসা আবার কারও হতাশা এই দুই নিয়েই জীবনমুখী আলোচনা। পরের বার আরও ভাল করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। দিনের শেষে হলে ফেরার ছোটাছুটি, রিডিং রুমে ও পড়ার সঙ্গে আড্ডা চলে, হুট করে খিচুড়ি পিকনিকের ধুম ওঠে। হাই বিটের গানে নাচানাচি, কোন সিনিয়র আপুর চোখ রাঙানো দেখে কিছু সময় থেমে পরে আবার আরও জোরে ভলিউম দিয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি দুষ্টুমিরই অংশ হয়ে যায়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা ক্লাসের পর ক্যাম্পাসের খাবার দোকানগুলোর অর্ধসেদ্ধ ভাত, কয়েক পদের ভর্তা আর ডিমভাজিই অমৃতের মতো স্বাদ দেয়। কখনো কথা বলার ছলে বন্ধুর পেটের ভাল মাংসের পিসটা নিজের পেটে তুলে নেয়া আর সেই নিয়ে কি তুমুল ঝগড়া। অবশ্য পরক্ষণেই ‘ছাড় না দোস্ত’ বলে মিটমাট। ক্লাসে স্যারদের পড়া জিজ্ঞেস করার হাত থেকে রক্ষা পেতে সবার চোখ লুকোচুরি আবার কখনও ধরা খেয়ে স্যারদের সেই বিখ্যাত লাইন শোনা ‘কনসেপ্ট ক্লেয়ার নেই, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’। লাইব্রেরির বারান্দায় পড়াশোনা, ল’ ডিপার্টমেন্ট এর পাশ থেকে কাঠগোলাপ এর গাছ থেকে প্রিয় ফুলটা এনে বই এ গুঁজে রাখা বা হাঁটতে গিয়ে কাসুন্দি দিয়ে পেয়ারা মাখানো খাওয়া প্রত্যেক দিনের ক্যাম্পাসের জীবনের অংশ। রাবি ক্যাম্পাসের জীবনটা দারুণ বর্ণিল। কোন ব্যাচের নবীণ বরণ বা কোন ব্যাচের র‌্যাগ ডে, আজ কনসার্ট তো কাল ফানুশ উৎসব। এ যেন কখনও পড়াশোনায় একঁঘেয়েমি আসতে দেয় না। পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি চলে বেশ আগে থেকেই। রঙিন মুখোশ, ফেস্টুন, স্টেজ সাজানো, আলপনা আঁকা সবকিছুই ছাত্র শিক্ষক একসঙ্গে মিলে করি আমরা। এতে করা শিক্ষকদের সাথে শ্রদ্ধার সম্পর্কে বন্ধুত্বের ছোঁয়াও পাওয়া যায়। বিপদে আপদে সহজেই তাদের পাশে পাওয়া যায়। আবার ঠিক একইভাবে শহীদ শামসুজোহা স্যারের রক্ত মেশানো এই পবিত্র ভূমিতে জাতীয় দিবসগুলোও পালন করি যথাযথ মর্যাদায়। প্রত্যেক বছরের প্রভাতফেরী বা বিজয় র‌্যালি আমাদের মনে করিয়ে দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নোয়াবো না। পড়াশোনার মাঝে ক্যাম্পাসে খেলাধুলার চর্চাটাও বেশ চোখে পড়ার মতো। চমৎকার স্টেডিয়াম রয়েছে আমাদের। যেখানে নিজেদের সেরা প্রমাণে সারা বছর ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল আন্তঃডিপার্টমেন্ট খেলা চলতে থাকে। নিজের ডিপার্টমেন্টের খেলা দেখতে আমরা হাজির হই সদলবল নিয়ে। সঙ্গে থাকেন শিক্ষক রা ও। ভুভুজেলা বাজিয়ে, হাতে লেখা ব্যানার নিয়ে চলতে থাকে গ্যালারিতে উৎসব। খেলা শেষে জিতে গেলে বীরদর্পে গ্যালারি ছাড়া। সারি সারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল সাদা বাসে করে কখনও বা আমরা বেরিয়ে পড়ি শহর ঘুরতে। হুট করে বানেশ্বরের কালাভুনা আর গরম ভাত খাওয়া কখনও বা পদ্মার ধারে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া, কোন বন্ধুর জন্মদিন পালন। আবার কখনও কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাম্বুলেন্স এ হাসপাতালে যাওয়া নির্ঘুম রাত কাটানো। এসবই পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে থাকা কতগুলো মেধাবী তরুণদের হাসি কান্নার গল্প। প্রায় ৩০ হাজার সদস্যের একটি পরিবার আমাদের। শহীদ শামসুজোহা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুখরঞ্জন সমাদ্দারসহ আরও কত গুণী মানুষদের উত্তরসূরি আমরা। ক্যাম্পাসের কাজলা গেট দিয়ে ঢুকেই হলুদ গোলাপি সোনালু ফুলের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না, বিশাল গাছের সমারোহে প্যারিস রোডের সৌন্দর্য এর প্রেমে না পড়ে থাকা যায় না। বধ্যভূমির নিশ্চুপ নীরবতায় ইতিহাসের ভয়াবহতা ভেবে শিহরিত হতে হয়। সাবাস বাংলার ভাস্কর্য তারুণ্যের আলোড়ন জাগিয়ে দেয়। শহীদ মিনার, বুদ্ধিজীবী চত্বর, জোহা স্যার এর কবর সম্মানে মাথা নোয়াতে বাধ্য করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আবেগ, অনুভূতি, আন্তরিকতা আর ভালবাসা দিয়ে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পাসগুলোর অন্যতম। যেখান থেকে প্রতি বছর অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী দেশ বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের শোভা বাড়াচ্ছে।
×