ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে দুর্ঘটনা, যানজট

ফুটওভার ব্রিজ আছে তবুও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ জুলাই ২০১৮

 ফুটওভার ব্রিজ আছে তবুও ঝুঁকি  নিয়ে রাস্তা পারাপার

ওয়াজেদ হীরা ॥ সাত বছরের শিশু সিয়ামকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে নিজের একটি ব্যাগ নিয়ে শাহবাগে ব্যস্ত রাস্তা পার হন শাহিনুর বেগম (৩৮)। তখনও গাড়ি থামার সিগন্যাল দেয়নি ট্রাফিক। চলন্ত রাস্তায় যেকোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারত দুর্ঘটনা। অথচ পাশেই রয়েছে যাতায়াতের ফুটওভার ব্রিজও। রাস্তা পার হয়ে বলেন, সময় কমতো তাই ওঠা হয় না। এভাবেই যাতায়াত করি, অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এতে নিজের সঙ্গে সন্তানের জীবনও ঝুঁকিতে কী না সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নীরবে চলে যান এই গৃহিণী। রাজধানীর অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজের চিত্রই এমন। সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে রাজধানী জুড়ে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করলেও অসচেতনতার কারণে তা ব্যবহার করছে না নগরবাসী। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছে অনেকেই। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। অথচ নগরবাসীর একটু সচেতনতাই পারে এসব অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা কমাতে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ভ্রামমাণ আদালতের কাছে অনেকেই দিয়েছেন জরিমানাও। এত কিছুর পরেও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বাড়ছে না। এর ব্যবহার বাড়াতে জনগণের সচেতনতার অধিক প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টদের মতো। সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এবং পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটওভার ব্রিজগুলোর উচ্চতা বেশি হওয়ায়, এগুলোর নোংরা পরিবেশ, হকার, ভিক্ষুক ও মাদকসেবীদের দখলে থাকায় তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। এ ছাড়ও সন্ধ্যার পর ওভার ব্রিজে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এবং বখাটে যুবকরা আড্ডা জমায়। ফলে নারীরা এটি ব্যবহারে অনীহা দেখান। রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, নিউমার্কেট, প্রেসক্লাব এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও অনেককে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দেখা যায়। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই বলেন সহজে একটু দ্রুত পার হওয়া যায়। বাংলামোটরে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পার হচ্ছিলেন ব্যবসায়ী সামিউল হাসান। তিনি বলেন, আসলে কাজটি ঠিক হয়নি। তবে ওপরে উঠতে কষ্ট হয়, সময়ও নষ্ট হয়। শাহবাগে দায়িত্বর ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে ঢাকা সিটিতে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা হয় জনগণের অসচেতনতার কারণে। এত সুন্দর যাওয়া আসার জন্য ফুটওভার ব্রিজ আছে, কিন্তু ব্যবহারের মানুষ নেই। নিজেও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন এবং রাস্তায়ও যানজট লেগে যাচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার কারণে ভ্রামমাণ আদালতের কাছে অনেকেই জরিমানাও দিয়েছেন। জানা গেছে, ঢাকায় ৮৯ টি ফুটওভার ব্রিজ আছে। এর মধ্যে নির্জন এলাকারগুলো ব্যবহার হয় না। কালেভদ্রে দু একজন পারাপার করেন। এগুলো ছিন্নমূল মানুষের বসবাসের স্থান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এ দিকে, আন্ডারপাস আছে তিনটি। এ ছাড়াও কিছু জায়গায় লাগানো হয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। এ দিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কমাতে জনগণকে সচেতন করা ও নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন মানায় উদ্বুদ্ধ করতে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারকারীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে যাত্রী অধিকার আন্দোলন নামক একটি সংগঠন। শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর প্রেসক্লাব, পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারকারীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সংগঠনটির কর্মীরা যাত্রী, পথচারী ও চালকদের সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ করেন। এ সময় তারা রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে, পরিবহনে যাতায়াতের সময় যাত্রীদের হাত-মাথা বাইরে না নিতে, ঝুঁকি নিয়ে ও অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে পরিবহনে উঠতে সতর্ক করেন। ট্রাফিক আইন মানা এবং পরিবহনে হয়রানিতে জাতীয় হেল্প নম্বর ৯৯৯-এর মাধ্যমে পুলিশের সহায়তা নিতেও উদ্বুদ্ধ করেন তারা। কর্মসূচী বিষয়ে যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল বলেন, আমাদের দেশে সড়কে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ট্রাফিক আইন না মানা। আমরা মনে করি, যাত্রীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হলে দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমে আসবে। তাই যাত্রী, চালক ও পথচারীদের ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। সাধারণ জনগণ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা নিয়ে বলেন, অধিকাংশ পথচারী অলসতা এবং অনবধানতার কারণে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া ওভার ব্রিজগুলো অবৈধ দখলে থাকা, ছিনতাইকারী ও হিজড়াদের দৌরাত্ম্য এবং যথাযথ পরিবেশ না থাকায় ব্যবহার অনুপযুক্ত। যার কারণে অনেকেই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। সচেতনতার অভাবও বড় একটি কারণ বলেন তিনি। প্রেসক্লাব ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে গন্তব্যে যাওয়ার সময় কিছু তরুণের কাছ থেকে ফুল উপহার পান শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন বিষয়টি ভাল লেগেছে। আমি তো নিজের প্রয়োজনেই এটি ব্যবহার করেছি। পরে আবার উপহার হিসেবে তাজা ফুল। উপহার পেতে নয় নিজেদের প্রয়োজনে সবার সচেতন হওয়া জরুরী বলেও জানান তিনি। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারকারীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর কর্মসূচীতে সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক অন্তু মুজাহিদ, মুখপাত্র মাহমুদুল হাসান শাকুরী, সদস্য নাজমুস সাকিব, জিহাদ আরিফ, শাফি হাসান, বিল্লাল হোসাইন সাগর, এস এম সজিব, হুমায়ুন তামিম, সোহেল তাজ, মোঃ মোস্তাকিম, সাব্বির অর্ণব, রাকিব হাওলাদার, মুঈনুদ্দিন আরিফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনেক সময় দেখা যায় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে কেউ কেউ। এর চেয়ে রাজধানীর জেব্রা ক্রসিংগুলো ব্যবহার করতে পারে বলেও জানান অনেকে। একপাশের রাস্তার সিগন্যাল দিতে না দিতেই দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। এতে করে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সড়কের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার সমাধান হতে পারে জেব্রাক্রসিং। রাজধানীর অনেক ক্রসিংয়ে জেব্রা চিহ্ন থাকলেও তা জানেন না পথচারী ও চালকরাও। এ দিকে, ডিএমপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের বাধ্য করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করা হয়। ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি কোর্ট পরিচালিত হয়। এ সময় অসংখ্য মানুষকে জরিমানা করা হয়েছে। এত কিছুর পরও সচেতনতা যেন আসছেই না। এ বিষয়ে ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই সরকার কিছু জায়গায় চলন্ত সিঁড়ি করে দিয়েছে। কোন কষ্ট নাই তবুও ব্যবহার করে না। আইন প্রয়োগ করে ততক্ষণ সুফল আসবে না যতক্ষণ আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন না হবে। এরপরেও আমাদের মূল উদ্দেশ্য সচেতনতা সৃষ্টি। যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানোর জন্যই এই মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা হয়। অভিযানের সময় সবার মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের আগ্রহ বেশি দেখা যায় এবং পরে আর তা থাকে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা কেন্দ্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বছরে চার শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটে। যার ২৬ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে পথচারী রাস্তা পার হতে গিয়ে। গবেষণায় এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়। ফার্মগেট, নিউমার্কেট, মিরপুর এলাকার ওভার ব্রিজগুলো ব্যস্ত থাকলেও এগুলো হকারের দখলে। নিউমার্কেটের উভয় সেতুর সিঁড়ির ওপরেও পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। অন্যদিকে রাজধানীর ব্যস্তময় এলাকা ফার্মগেট ও কাওরান বাজারে দুটি সেতু এবং একটি আন্ডারপাস থাকার পরও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয় কাওরান বাজার এলাকার অনেক মানুষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম জানান, স্কুলের শিশু এবং হাসপাতালের রোগীদের জন্য রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা কঠিন। তবে তাদের এগুলো ব্যবহারে উৎসাহী করতে হবে এবং এগুলো ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। অন্যদিকে তরুণদের অবশ্যই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। এতে শহরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউিটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আইন থাকলেও অনেক সময় মানার অনিহা থাকে। আমরা দ্রুত যেটি পাই সেদিকে যাই। রাস্তার আইন আছে কিন্তু মানছি না। এতে করে অনেক সময় বড় ক্ষতি হচ্ছে। তবুও সচেতনতা আসছে না। তবে সম্প্রতি সময়ে তরুণরা বেশ আগ্রহী হচ্ছে এসব নিয়ে বলেন, আশা করছি যে সকল ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের করা যায় না তার দিকে কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি দিবে এবং রাজধানীবাসী নিজের প্রয়োজেনই ব্যবহার বাড়াবে।
×