গাফফার খান চৌধুরী ॥ একের পর এক তুঘলকি কান্ড ঘটিয়ে চলেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেন। যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বেয়াইয়ের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে গোপন বৈঠক করে আলোচনায় আসার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছেন। শুধুমাত্র আদর্শিক এবং তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেয়ায় ঢাকার মিরপুরের শাহআলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহর এমপিও বাতিল করার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছেন ডিজি বিল্লাল হোসেন। মাদ্রাসাটির সব শিক্ষকের বেতন দেয়ার অনুমতি দিলেও তার বেতন না দিতে অগ্রণী ব্যাংক বরাবর চিঠি দিয়ে আবারও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী ওই অধ্যক্ষের বেতন দেয়ার জন্য সুপারিশ করলেও তা আমলেই নিচ্ছেন না ডিজি। এ নিয়ে মাদ্রাসা অধিদফতরে রীতিমত শোরগোল চলছে। একজন মহাপরিচালক হয়ে সামান্য একজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়াকে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অশনিসংকেত বলে মনে করছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। জামায়াতের রাজনীতি না করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করায় এবং একটি বিশেষ জেলায় বাড়ি হওয়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই অধ্যক্ষ।
এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেনের জামায়াত কানেকশন ও যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বেয়াইয়ের সঙ্গে গোপন বৈঠকের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। মন্ত্রণালয়ের জামায়াতপন্থী আমলারা অভিযুক্ত ডিজিকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এদের চক্রান্তের কারণেই দেড়মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি। বরং তার জামায়াত কানেকশন ইস্যুতে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের যে কর্মকর্তা কর্মচারীরা সোচ্চার ছিলেন তাদের বদলি করে দেয়ার নানাভাবে চেষ্টা চলছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ মে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেন সব কর্মকর্তাকে বের করে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর বেয়াই নানা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ও বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব এবং টেলিভিশনের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জামায়াত নেতা কামাল উদ্দিন জাফরীর সঙ্গে বোরাক টাওয়ারের নিজ কার্যালয়ে গোপন বৈঠক করেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে রীতিমত হৈ চৈ পড়ে যায়। ঘটনা তদন্ত করতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মোহম্মদ আলমগীরকে নির্দেশ দেন।
সেই তদন্ত কমিটি মাদ্রাসা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেনের বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা, কর্মকর্তাদের সমিতির নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি মিরপুর শাহআলী বাগদাদী কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহর সাক্ষ্যও গ্রহণ করে। কমিটির কাছে মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন ছাড় করানোর জন্য জিডির পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করা, তাঁদের অপমান অপদস্ত করা থেকে শুরু করে ন্যূনতম সুযোগ পেলেই তাদের ক্ষতি করার মানসিকতা পোষণসহ নানা বিষয় জানান সাক্ষ্যদাতারা।
অধ্যক্ষ কে এম সাইফুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার রেশ ধরে মাদ্রাসাটির শিক্ষক জামায়াত নেতা আফজাল হোসাইন, স্থানীয় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা তাকে বেধড়ক মারধর করে। সেই মারের চিহ্ন এখনও তার শরীরে রয়েছে। মাঝে মধ্যেই সেই মারের যন্ত্রণায় তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। আফজাল হোসাইনের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের জিডির ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তার ওপর এভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এমনকি আফজাল হোসাইনের মাধ্যমে মাদ্রাসাটিতে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা আস্তানা গাড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আফজাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ ছাত্র জেএমবি সদস্য এমদাদ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।
তিনি বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের ডিজির বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেয়ায় জামায়াতের রাজনীতি না করা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করায় এবং গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় তিনি নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি সব শিক্ষকের বেতন দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেন। অথচ তার বেতন না দেয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংক বরাবর চিঠি দিয়েছেন তিনি। তার বেতন দিতে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিমন্ত্রী নিজে তার দরখাস্তে সুপারিশ করেছেন। ডিজি তা আমলেই নিচ্ছেন না। মাদ্রাসাটিতে জামায়াত-শিবির জঙ্গীদের প্রভাব বিস্তার করতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তদন্ত কমিটির কাছে দেয়া সাক্ষ্যে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের অঙ্গ সংগঠন স্বাধীনতা মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদের সভাপতি মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান নাঈম, সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল বাশার হাওলাদার ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদার্রেসীনের মহাসচিব মাওলানা সাব্বির আহমেদ মোমতাজীও এমন ঘটনায় রীতিমত উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা তদন্ত কমিটিকে জানান, বিল্লাল হোসেন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই দেশের মাদ্রাসাগুলোতে এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরকে স্বাধীনতাবিরোধীদের আখড়ায় পরিণত করেছেন। অধিদফতরকে ঘিরে স্বাধীনতাবিরোধীরা ব্যাপক তৎপর। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটির হাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বহু মাদ্রাসা শিক্ষককে নাজেহাল হতে হয়েছে। মহাপরিচালক নিজেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক শিক্ষককে অপমান অপদস্ত করেছেন। তারা ডিজির অপসারণসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন নানা অপকর্মের কারণে এখনও যুগ্মসচিব হিসেবেই রয়েছেন। তার ব্যাচের অধিকাংশই সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িত থাকায় তার পদোন্নতি হয়নি। এ ছাড়া মাদ্রাসায় নিয়োগবোর্ডে দুর্নীতিবাজদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িত অভিযোগে বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি ছাত্রশিবিরের গোয়েন্দা শাখার সদস্য ছিলেন।
ডিজি বিল্লাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ মিরপুর শাহআলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক আফজাল হোসাইন ১৯৯৫ সালে যাত্রাবাড়ীর তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করেন। অদ্যাবধি তিনি তার আসল সার্টিফিকেট মাদ্রাসায় জমা দেননি। এমনকি কোন প্রকার বিধি বিধানের তোয়াক্কা না করে তিনি মাদ্রাসাটিতে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েও বেআইনীভাবে ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি চাকরি নেন। অথচ কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে প্রভাষক হিসেবে ন্যূনতম ৬ বছরের অভিজ্ঞতা দরকার। তা না থাকা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষক হন। আফজাল হোসাইন জামায়াতের রোকন ছিলেন। তার পিতার নাম মুহম্মদ আজিজুল ইসলাম। বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা থানাধীন বেংগাড়ি গ্রামে। তিনি এলাকায় শীর্ষ জঙ্গী নেতা ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। যদিও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিল্লাল হোসেন ও মিরপুর শাহআলী বাগদাদী (রহ.) কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক আফজাল হোসাইন এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।