ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা সেবা ছাড়াও দেয়া হচ্ছে আইনী সহায়তা

নির্যাতিত নারী ও শিশুদের পাশে ঢামেকসহ সারাদেশে ৬০ ওসিসি

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২১ জুলাই ২০১৮

 নির্যাতিত নারী ও শিশুদের পাশে ঢামেকসহ সারাদেশে ৬০ ওসিসি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারসহ (ওসিসি) দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানাবিধ কারণে সমাজে নারী ও শিশু নির্যাতন থামানো যাচ্ছে না। তবে নির্যাতিত এ সব নারী ও শিশুদের সাহায্যার্থে সরকার গঠন করেছে ওসিসি। যেখানে সমাজের নির্যাতিত নারী ও শিশুরা সেবা পেয়ে থাকে। ওসিসি’র উদ্দেশ্য চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি আইনী সহায়তাও দেয়া। চিকিৎসাধীন কোন ব্যক্তি মামলা করতে চাইলে ওসিসির পক্ষ থেকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় এবং ওসিসির নিজস্ব আইনজীবী দিয়ে মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়া হয়। সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে ৬০টি ওসিসি রয়েছে। যার মধ্যে ৪০ টি জেলা সদর হাসপাতালে এবং বাকি ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ১ জুলাই বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মীরপুরের তাসমিয়াকে (ছদ্মনাম) (১৫) ধর্ষণ করে গোদাবাড়ি উপজেলার বাবুপুর গ্রামের জামাল হোসেনের ছেলে মারুফ হোসেন (২১)। তাসমিয়ার বাবা সাইফুল ইসলাম পেশায় একজন রিক্সা চালক। তিনি ঘটনার দিনই মেয়েকে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে নিয়ে যান। সেখানে তিনদিন ভর্তি থাকে। এ বিষয়ে তিনি জানান, ডাক্তারী পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। ৩ জুলাই আমরা মামলা করেছি। তবে এখনও অপরাধী ধরা পড়েনি। দেশের অনেক জায়গায়ই নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৫৯২টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৮ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ জনকে, এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৬১ জনকে। যেমন সিলেটের মাহবুবা (ছদ্মনাম)। বয়স মাত্র আট বছর। এই শিশুকে ধর্ষণ করেছে তারই গৃহ শিক্ষক তেইশ বছর বয়সী কাওসার। পরে সে তার মাকে সব ঘটনা জানালে তার মা জকিগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করে। পুলিশ পরে কাওসারকে গ্রেফতার করে। বেশ কয়েকদিন মাহবুবা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন ছিল। মাহবুবার মায়ের একটাই দাবি দোষী কাওসারের সর্বোচ্চ শাস্তি যেন মৃত্যুদ- হয়। প্রায় প্রতিদিনই ঢামেকের ওসিসিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন নারী ও শিশুরা। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সত্ত্বেও নারী নির্যাতন কমছে না। এর সঙ্গে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। এ বিষয়ে ওসিসির সমন্বয়ক ডাঃ বিলকিস বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি মূলত অপরাধীদের উসকে দিচ্ছে। অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে এর কোন বিচার হয় না। আর যেখানে অপরাধের কোন বিচার নেই, সেখানে অপরাধ বাড়বেই। শিশুরা ধর্ষণের বড় শিকার। কারণ তারা কিছুই বলতে পারে না, অসহায় থাকে ধর্ষণের সময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এটা শুনতে কোন অভিভাবকেরই ভাল লাগে না, একইসঙ্গে সমাজ এখনও নির্যাতিতদের ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়। আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো সমাজ তার দিকেই আঙ্গুল তুলবে, এ ভয়েই অনেক পরিবার ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে না। আবার অনেক সময় মামলা করলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীদের ঠিকমতো বিচার হয় না।’ ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার নিজ উদ্যোগে ডিএনএ টেস্ট, ফরেনসিক টেস্ট, মামলা করা, সাক্ষী জোগাড় করাসহ সব কিছু করলেও কোথায় গিয়ে যেন মামলাগুলো আটকে যায় বলে হতাশা প্রকাশ করেনন ডাঃ বিলকিস বেগম। দেশে শিশু নির্যাতনের আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে মন্তব্য করেন এই চিকিৎসক। বর্তমানে সাতটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে এবং ফরিদপুরে ওসিসি স্থাপন করা হয়েছে। ‘মাল্টি সেক্টোরাল প্রোগ্রাম অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন’ এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠিত এইসব সেন্টারে মূলত মহিলা ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানসহ আইনী ও পুলিশী সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা, মানসিক কাউন্সেলিং, আশ্রয় এবং সমাজে পুনর্বাসনের সহায়তা প্রদান করা হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশ এবং ডেনমার্কের সহযোগিতায় মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জাতীয় ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করেছে যার মাধ্যমে নিপীড়িত নারীদের কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয়। যেসব নারীরা হতাশার মধ্যে ভুগছে অথবা আত্মহত্যা করতে চাইছে, উদ্বিগ্ন অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সেসব নারী এখান হতে কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারেন। এছাড়াও যেসব মহিলা ও শিশু যারা নির্যাতনের শিকার তাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতার লক্ষ্যে সরকার চালু করেছেন জাতীয় হেল্প সেন্টার। নির্যাতনের শিকার এসব নারী ও শিশুর সরাসরি টোল ফ্রি ১০৯ এই নাম্বারে কল করে যেকোন ধরনের সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন। ওসিসির চিকিৎসাসেবা বিষয়ে ড. বিলকিস বেগম বলেন, ‘২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক নারী এবং শিশু এই সেন্টার হতে সেবা গ্রহণ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই তাদের এখানে নিয়ে এসেছেন আবার অনেকেই পুলিশের মাধ্যমে এসেছেন। তিনি বলেন, মহিলা ও শিশুদের সেবা দিতে সরকার সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এ পর্যন্ত ৬০টি ওসিসি স্থাপন করেছে। যার মধ্যে ৪০টি জেলা সদর হাসপাতালে এবং বাকি ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি বলেন, ওসিসি সেলের কার্যক্রম চালু হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। আর ওএসসি সেল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী ও শিশুদের দ্রুত বিচার পেতে সহযোগিতা করে। এছাড়াও যেসব নারী ও শিশু শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার, যৌন নির্যাতনের শিকার, অগ্নিদগ্ধ এবং এসিড নিক্ষেপের শিকার হওয়াদের নিয়ে কাজ করে ওসিসি সেল। ওসিস’র প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন মূলত পরিবারে অশান্তি, পূর্ব শত্রুতা, জমি-জমা বিরোধ এবং যৌতুকের কারণে। সেইসঙ্গে অনেকেই নিজেদের দোষী ভেবে মামলা করেন না। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানের ৬০টি ওসিসিতে এখন ভিকটিমরা সেবা নিতে পারছেন।
×