ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভিয়েতনামে ৮৭ ভাগ মানুষ ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের আওতায়

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশে চালু হচ্ছে স্বাস্থ্য বীমা কার্যক্রম

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২১ জুলাই ২০১৮

  সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশে চালু হচ্ছে স্বাস্থ্য বীমা কার্যক্রম

ভিয়েতনাম থেকে ফিরে নিখিল মানখিন ॥ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভিয়েতনামে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে স্বাস্থ্য বীমা কার্যক্রম। ৮৭ ভাগ মানুষ ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের (ইউএইচসি) আওতাভুক্ত। অর্থাৎ স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে দেশটির মানুষ তাদের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। ওই দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ স্বাস্থ্য বীমার সমান সুবিধা পেয়ে থাকে। ওই বীমার আওতায় ক্যান্সার, কিডনি বিকল কিংবা এইচআইভি-এইডস, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসাব্যয়ও মেটানো হয়। ভিয়েতনাম সরকারের উদ্যোগে দেশের সব সরকারী- বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন হচ্ছে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ কার্যক্রমের আওতায় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচী। চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে হতাশায় ভুগতে হয় না ভিয়েতনামীদের। ওই দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম দেখে বাংলাদেশও অনুপ্রাণিত। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য বীমা সুবিধার আওতায় দরিদ্র মানুষের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কার্যক্রম ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ভিয়েতনামের রাজধানীতে অবস্থিত হ্যানয় মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশের সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে এসব তথ্য জানানো হয়। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সরেজমিন ঘুরে এমন বাস্তব চিত্র খুঁজে পায়। হ্যানয় মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফরেন এ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান ড. ভ্যান থ্যান জানান, ভিয়েতনামে ১৯৯২ সাল থেকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বীমা অন্তর্ভুক্ত হয়। শুরুতে কভারেজের আওতায় ছিল মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ। ১৯৯৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। ২০০৫ সালে ৪৬ শতাংশ, ২০১০ সালে ৬৫ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৭০ শতাংশ এবং বর্তমানে ৮৭ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা ভোগ করছে। তিনি জানান, সেই দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে জিডিপির ১০ ভাগই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হয়। ড. ভ্যান জানান, স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা পেতে দেশের সচ্ছল মানুষের মোট আয়ের ৪ দশমিক ৫ ভাগ হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হয়। তবে দরিদ্রদের প্রিমিয়ামের টাকা সরকার দিয়ে থাকে। এছাড়া স্বল্প আয়ের লোকদের প্রিমিয়ামের ৭০ ভাগ এবং শিক্ষার্থীদের ৩০ ভাগ সরকার দিয়ে থাকে। রোগ এবং রোগীর অবস্থান বিবেচনায় ৮০ থেকে ১০০ ভাগ কভারেজ দেয়া হয়। তিনি জানান, ভিয়েতনামে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য একজন উচ্চ শিক্ষিত চিকিৎসক রয়েছেন। তুলনামূলক চিকিৎসক কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি, সংখ্যার ওপর নয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সম্প্রতি সেই দেশে বেসরকারী উদ্যোগে হাসপাতাল গড়ে উঠলেও সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি। রয়েছে চার স্তরের চিকিৎসা ব্যবস্থা। যার উচ্চপর্যায়ে রয়েছে বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং নি¤œ পর্যায়ে কমিউনিটি মেডিক্যাল সেন্টার। হ্যানয় মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে বেশ কয়েকটি কমিউনিটি মেডিক্যাল সেন্টার পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, প্রতি ৮ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে। কমিউনিটি মেডিক্যাল সেন্টারে একজন গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, একজন নার্স এবং ৭ জন মেডিক্যাল বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী থাকেন। সাধারণত অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী এসব সেন্টারে গিয়ে থাকেন। এসব সেন্টারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব সেন্টারে যারা চিকিৎসা নিতে যান তারা সবাই বীমা কভারেজের আওতাভুক্ত। তাই চিকিৎসা নিতে তাদের কোন ব্যয় করতে হয় না। গড়ে সেন্টারগুলোয় ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। তবে এমন কোন রোগী যদি আসেন যাদের চিকিৎসা এসব সেন্টারে করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে রোগীকে এ্যাম্বুলেন্সে জেলা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হ্যানয় মেডিক্যল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে বাছ মাই ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল পরিদর্শনে নিয়ে যান। হাসপাতালের ভাইস ডিরেক্টর অধ্যাপক মিন থং (এমডি, পিএইচডি) জানান, হাসপাতালটি ৩ হাজার শয্যার। এখানে রোগীর সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালের বহির্বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৭টায় এবং শেষ হয় বিকেল ৫টায়। তবে শীতকালে বিকেল ৫টার পরিবর্তে ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। অধ্যাপক মিন থং প্রতিনিধি দলকে হাসপাতালের বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখান। সম্পূর্ণ হাসপাতাল অটোমেশনের আওতাভুক্ত। সেখানে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ জরুরী বিভাগ, যেখানে জরুরী ভিত্তিতে রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব(বাজেট) মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছে। এই প্রকল্প সফলতার মুখ দেখলে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম ॥ বাংলাদেশেও উদ্বোধন করা হয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর পাইলট প্রকল্প। গত ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানায় হেলথ কার্ড বিতরণের মাধ্যমে এই কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে মধুপুর, কালিহাতি ও ঘাটাইল থানায়। টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় স্বাস্থ্য কার্ড প্রদানের লক্ষ্যে রেজিস্ট্রেশন পরিচালিত হয় । রেজিস্ট্রেশন শেষে উদ্বোধন করা হয়েছে হেলথ কার্ড বিরতণ কার্যক্রম। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনামূল্যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা দিতে এই পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বর্তমান সরকার দরিদ্রবান্ধব সরকার। দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী গ্রহণসহ নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। ফলে কয়েক বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। তিনি বলেন, সরকার গরিব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে যেসব কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তার সুফল জনগণ পাচ্ছে। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অতি দরিদ্র মানুষ যেন জটিল রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করতে পারে সেলক্ষ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচীর কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, মধুপুর ও কালিহাতিতে অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে ওই তিন উপজেলায় প্রায় এক লাখ মানুষকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা সুবিধা দিতে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ করা হবে। কার্ডধারী ব্যক্তিরা কয়েকটি নির্দিষ্ট জটিল রোগের চিকিৎসাসেবা পাবেন উপজেলা, জেলা পর্যায়ের সরকারী হাসপাতাল থেকে। পরিবার প্রতি একজন এই কার্ড পাবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষ জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ৫০ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাবেন। এই চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিবার প্রতি বছরে ১ হাজার টাকা প্রিমিয়াম হিসেবে প্রদান করবে সরকার। আর প্রতি পরিবার বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা লাভ করবে। এই কর্মসূচীর অধীনে নির্দিষ্ট সূচক ব্যবহার করে পাইলট এলাকায় দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী ১ লাখ পরিবার চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব পরিবারকে একটি হেলথ কার্ড প্রদান করা হবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়।
×