ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিশুদের শিল্পের পাঠশালা ‘বাবুই’র ব্যতিক্রমী আয়োজন

কাগজের নৌকা ভাসিয়ে প্রতিবাদ- অনাথদের সঙ্গে ফল উৎসব

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২১ জুলাই ২০১৮

কাগজের নৌকা ভাসিয়ে প্রতিবাদ- অনাথদের সঙ্গে ফল উৎসব

সমুদ্র হক ॥ কথা, গল্প ও তরী। তিন বাবুই শিশুর নাম। এরা শিশুদের শিল্পের পাঠশালা বাবুইয়ের সদস্য। গল্প, কথা ও তরীর মতো অনেক বাবুই শিশু ছেলেবেলায় দেশ ও সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছে। বাবুই পাখি যেমন গাছের শাখায় খড়কুটা দিয়ে শিল্পের ছোঁয়ায় বাসা বানায়, এই শিশুরা ‘মানুষ’ হওয়ার দৃঢ় আকাক্সক্ষায় হৃদয়ে খেলাঘর বাঁধছে। এগিয়ে চলেছে সমুখ পানে। শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে এরা সঙ্গে নিয়েছে অনাথ শিশুদের। তিনশ’র বেশি শিশু সম্প্রতি ব্যতিক্রমী এক আয়োজনে জড়ো হয় বগুড়ায় করতোয়া নদীর তীরে। নদী রক্ষার দাবিতে প্রতীকীভাবে ভাসিয়ে দেয় প্রায় এক হাজার কাগজের নৌকা। ভরা নদীর তীরে শৈশব কাটানোর অধিকার হরণের প্রতিবাদ জানায় এভাবে। সঙ্গে বাংলার মধুমাসের ফল উৎসবকেও টেনে আনে। নাচের তালে, গানের সুরে আর কবিতার ছন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। পাখিদের মতো শিশুদের এমন কিচির মিচির শব্দ নগরীর শোরগোল চাপা দিয়ে পৌঁছে যায় জেলা প্রশাসকের বাংলো বাড়িতে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী তার অফিসের পূর্ব ধারে করতোয়া নদী তীরে এত শিশুদের দেখে ও কথা শুনে নিজেও ওদের সঙ্গে মিশে যান। ক্ষণিকের জন্য স্মৃতিতে ফিরে পান অতীতকে। এ সময় তিনিও হয়ে যান শিশু। আশ^াস দেন সকল শিশুদের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য ভুবন গড়ে তুলতে কাজ করবেন। বগুড়ায় শিশুদের এক শিল্পের পাঠশালা গড়ে ওঠে বছর কয়েক আগে। তরুণ রাকিবুল হাসান জুয়েল ‘বাবুই’ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শিশুদের এই শিল্পের এক ভুবন। যেখানে শিশুরা মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার মধ্যে গড়ে উঠছে। সঙ্গে আছে বাংলার ঐতিহ্যের সংস্কৃতি। তিনি মনে করেন যে জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতিতে যত উন্নত সেই জাতি বিশে^ মাথা উঁচু করে টিকে থাকে। এই ধারাতেই গড়ে উঠছে বাবুই পাঠশালার শিশুরা। বগুড়ায় করতোয়া নদী রক্ষায় নানা শ্রেণী পেশার মানুষ আন্দোলন করছে। বাবুইয়ের শিশুরাও আর বসে থাকেনি। বগুড়া ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী তরী বলল, তার নামের অর্থ নৌকা। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে অনেক নৌকা বানিয়েছে সে। প্রথম শ্রেণীর দুই মেয়ে শিশু-কথা ও গল্প বলল, নেচে নেচে তারা কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। নদীতে ঢেউ থাকলে নৌকাগুলোও নাচতো। কাগজের এই নৌকাগুলো নদীকে বলে দেবে নদী যেন ভরে উঠে ঢেউ তোলে। শিশুমনের এমন ভাবনার কথা শুনে বড়রা আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। ওদের মা ফারজানা নাইম বললেন, তাদের দুই মেয়ে কথা ও গল্প যেন গল্পকথার মতোই। এই দিনে আরও অনেক শিশু নদী তীরে সমবেত হয়েছিল। ক’জনের আর নাম বলা যায়। মিহিম, বুশরা, বিহিম, তিহবা বলল, কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে শিশু পরিবারের অনাথ শিশুদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালীর মধুমাসের ফল আম জাম কাঁঠাল উৎসবে মেতে উঠেছে তারা। বিহিম ও মিহিমের মা লুৎফুন্নেছা বললেন, অনাথ শিশুদের সঙ্গে থেকে শিশুবেলাতেই ওদের মনে মানবতার ধারা গড়ে উঠছে। এভাবেই ওরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে। বাবুইয়ের পরিচালক রাকিবুল হাসান জুয়েল জানালেন, একটা সময় বাঙালীর সংস্কৃতি নানা উৎসব হতো নদীকে ঘিরে। নদীর মরুপথের যাত্রায় বাঙালীর সেই ধারাও আর থাকছে না। বগুড়ার করতোয়া নদী দিনে দিনে মরা গাঙে পরিণত হচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে নদীভূমি। শিশুরা করতোয়ার তীরে এসে নদীর এই অবস্থা দেখে বুঝে ওঠার চেষ্টা করে ছবিতে দেখা নদীর সঙ্গে এই নদীর কত অমিল। নদীর তীরে শিশুদের জন্য বার্তা রাখা হয়েছে। সত্যিকার মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। যাতে শিশুরা কোন মানুষকে অবহেলা না করে। সকলকেই আপন করে নেয়। ফল উৎসবের আয়োজনের লক্ষ্য অনাথ শিশুদের নিয়ে আম জাম কাঁঠাল খেয়ে বুঝিয়ে দেয়া তারা সকলের সঙ্গেই আছে। কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই শিশুদের মন স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। খুঁজে পাবে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নের ঠিকানা।
×