ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাদুড়বাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২১ জুলাই ২০১৮

 বাদুড়বাড়ি

পাখির মতো উড়লেও আকৃতির কারণে বাদুড়ের কদর নেই। নানা কল্প-কাহিনীর আতঙ্ক সৃষ্টিকারী প্রাণী হিসেবে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাই সৈয়দপুরের পল্লীতে নির্ভয়ে আবাস গড়েছে কয়েক লাখে বাদুড়। এতে উপজেলার বা্গংালীপুর ইউনিয়নের ভগতপাড়ার গ্রামটির প্রকৃতি আর আকাশ যেন অভয়ারণ্যতে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, দেড় শতাধিক বছর আগে এ এলাকার প্রায় ৩ একরের বাঁশঝাড় ও দুটি প্রাচীন বটগাছে বাদুড়ের বসবাস শুরু হয়। সংখ্যালঘু এই এলাকায় সৌভাগ্যের প্রতীক মেনে বাদুড়দের ভিন্নভাবে গ্রহণ করায় বংশবৃদ্ধি ঘটেছে। কয়েক যুগে তাই লাখে দাঁড়িয়েছে বাদুড়ের সংখ্যা। এভাবে এলাকাবাসীর সহায়তায় দেড় শতাধিক বছর অতিক্রান্তের পর এ এলাকাটি বাঁদুড়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বারো মাসজুড়ে বাঁশঝাড় আর দুটো বটগাছে নির্ব বসবাস করছে। এদের কিচির মিচির ডাকে কোলাহলপূর্ণ থাকে দিন। তবে রাতে খাদ্যের অন্বেষণে আবাস ছেড়ে দূর-দূরান্ত থেকে ফেরার পর ভোর বেলা আবারও শুরু হয় তাদের কল-কাকলি। এতে এলাকাবাসীর ঘুম ভেঙে যায়। গত শুক্রবার সরেজমিন উপজেলার বাঙালীপুর ইউনিয়নের ভগতপাড়ায় দেখা যায়, প্রচ তাপদাহে এ এলাকার স্বামী-স্ত্রীখ্যাত মিলিত বট-পাকুর গাছের শাখায় তাদের হুকের মতো পা দুটো আটকিয়ে নিস্তব্ধতায় ঝুলছে। ওজন প্রায় ২ থেকে ৩ কেজি। মাথায় হলুদ রং থাকলেও পুরো দেহটি কালো। একটু শব্দ হলেই দল বেঁধে পালক ছাড়া চামড়ায় মোড়ানো ডানা দিয়ে ঘুড়ির মতো কিচির-মিচির শব্দে নীরব স্থানে ঝুলে পড়ছে। রাতের অক্লান্ত শ্রমে যেন তারা শুধু একটু প্রশান্তির ঘুম খুঁজছে। এলাকাবাসী জানান, কখন, কীভাবে এখানে বাদুড় বসবাস শুরু হয়েছে। এ প্রজন্মের কেউ জানেন না। তবে ঝুলন্ত অবস্থায় তারা বিশ্রাম, ঘুম, মিলন এবং বাচ্চা জন্মদানের কাজগুলো করে। এ দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসছেন। তারা আরও জানান, এখানে বংশানুক্রমে প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে আবাস গড়ায় বাদুড়বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এ গ্রামটি। তবে কুসংস্কারের আচ্ছন্নতা এ বাদুড় নিয়ে। অনেকে সৌভাগ্যের চিহ্ন মনে করেন আবার অনেকে প্রাণনাশের। সর্বক্ষণ কিচির-মিচির শব্দে কান ঝালাপালা হলেও বাদুড়বাড়ির মানুষরা তাদের স্বজনে পরিণত হয়েছে। এ নিয়েই তাই তারা তৃপ্ত। ইউপি সদস্য অজিত চন্দ্র রায় বলেন, বাদুড় নিরীহ প্রাণী। এরা মাটিতে পড়ে গেলে আর উঠতে পারে না। মাটিতেই মারা যায়। এদের পা নেই। তবে পেটের নিচে দুটো হুক আছে। এ দিয়েই তারা ঝুলে থাকে। খাদ্যের অভাব মেটানো ছাড়া কোন ক্ষতি করে না। এরা সারাদিন ঘুমায়। সন্ধ্যায় বেরিয়ে যায় আহারের সন্ধানে। আবার ফিরে আসে ভোরে। চৌমহুনি বাজারের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেন, স্তন্যপায়ী প্রণীর মধ্যে বাদুড় দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী এবং এরাই একমাত্র উড়তে পারে। এরা নিশাচর। এদের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত কম। তাই চলাচলের সময় ক্রমাগত মুখ দিয়ে শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে আশপাশের সম্ভাব্য বাধা-বিঘ্ন সম্পর্কে ধারণা পেয়ে এগিয়ে চলে। তিনি আরও জানান, আকৃতি আর অবস্থানের কারণে ভ্রান্ত ধারণা বা কুসংস্কার রয়েছে এ নিরীহ প্রাণীটিকে নিয়ে। অনেকে সুযোগ পেলে হত্যাও করে। বিশ্বনাথ নামে এক এলাকাবাসী জানান, এর মাংস খেলে হাঁপানি রোগ ভাল হয়। এই অজুহাতে অনেকে আসছে বাদুড় মারতে। তবে বাদুড়ের নানা গল্প নিয়ে এলাকায় আতংক রয়েছে। যেমন, বাদুড় চোখে দেখে না তাই মানুষের রক্ত খায়, তার ঘরে প্রবেশ হচ্ছে অশুভ লক্ষণ, এরা সৃষ্ট শব্দ প্রতিধ্বনি অনুযায়ী চলে ও শিকার করে, পরস্পরের শত্রু। এ রকম নানান কুসংস্কার এর সংরক্ষণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণী হিসেবে বাদুড় প্রকৃতিতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। কথাটা সত্যি নয়। বরং পরাগায়নের মাধ্যম হিসেবে বাদুড় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, কলা আর অ্যাভোকাডোসহ প্রায় ৩০০ রকমের গাছের বীজ ছড়াতে সাহায্য করে বাদুড়। এছাড়া বাদুড় কীটপতঙ্গ খেয়ে এগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফসল রক্ষা করে। সৈয়দপুর মহাবিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মতিউর রহমান জানান, এদের প্রচলিত নাম ভারতীয় উড়ক্কু (indian flying bat) এর বৈজ্ঞানিক নাম Pteropus giganticus। এরা frugivorus স্বভাবের। এরা পাকা আম, কলা,লিচু, ফুলের মধু, পেয়ারা, ডুমুরসহ অন্যান্য ফলমূল খেয়ে থাকে। দলবেঁধে বট, ডুমুর এবং তেঁতুলজাতীয় গাছে এক সাথেই বসবাস করে। পানির উৎসর পাশাপাশি আবাস স্থলে তারা বেশি থাকে। এরা রাতে সক্রিয় থাকে। এ বাদুড়ের স্থানীয় নাম বড় বাদুড়, চম্পা বাদুড়, ইংরেজী নাম ভারতীয় উড়ন্ত ফক্স, ভারতীয় ফল বাদুড়। এদের লম্বা লোম মাথার ওপরে এলোমেলোভাবে বিন্যস্ত থাকে। মাথায় মুকুটের মতো সোনালি বাদামি বর্ণের রং আছে। একই গাছে বসবাস করায় সামাজিক বাদুড় হিসেবে পরিচিতি আছে। পুরুষ বাদুড়গুলো অন্য বাদুড়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং অশ্রয়স্থল ও সহযোগী স্ত্রী বাদুড়গুলোকে বহিরাগতদের থেকে রক্ষা করে। স্তন্যপায়ী এ প্রাণী আকাশে উড়ে বেড়াতে পারলেও এটি কোন পাখি নয়। পৃথিবীর একমাত্র উড্ডয়ন ক্ষমতাবিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণীটি পৃথিবীজুড়ে বিচরণ করছে। প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বাদুড়ের সংখ্যাই ২০ ভাগ। এর মধ্যে ৭০ ভাগ বাদুড় পতঙ্গ-ভুক। বাকিরা ফলমূল খায়। এরা নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলায় অন্ধকার স্থানে উলটো হয়ে ঝুলে থাকে। শ্রবণশক্তির ওপর নির্ভর করে এরা চলাচল করে। সম্প্রতি কিছু অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, দেশে দেশে মানুষের মতোই ভাষা বদলায় বাদুড়। সে দেশের বাদুড়রা স্থানীয় ভাষাতেই কথাবার্তা চালায়। তাহলে বাংলাদেশের বাদুড় হয়তো বাংলাভাষায় কথা বলে। অস্ট্রেলিয়ান ফরেস্ট সায়েন্স সেন্টারের গবেষক ব্র্যাড ল জানিয়েছেন, নিউসাউথ ওয়েলসের পূর্ব উপকূলজুড়ে থাকা বনের বাদুড়দের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্যের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। বাদুড়ের ভাষায় আঞ্চলিকতা নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণাটিতেই প্রথম প্রমাণ মিলল। শুধু মানুষ নয়, বাদুড়েরও রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা। একেক অঞ্চলের বাদুড় তাদের সেই আঞ্চলিক বাঁদুড়ে ভাষাতেই কথা বলায় অভ্যস্ত। -এম আর মহসিন, সৈয়দপুর থেকে
×