ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

‘রবীন্দ্র আমি আর তুমি’ এবং ‘যুদ্ধ ও আমি’

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২০ জুলাই ২০১৮

‘রবীন্দ্র আমি আর তুমি’ এবং ‘যুদ্ধ ও আমি’

মমতাজ লতিফের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক বই ‘যুদ্ধ ও আমি’ প্রকাশ পায় ২০১৪ সালের নবেম্বরে। বেঙ্গল পাবলিকেশন প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। এক সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যিক পরিবারে জন্ম নেয়া মমতাজ লতিফ অতি শৈশবকাল থেকে যাঁদের সান্নিধ্য আর পরিচর্যায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন তাঁরা হলেন কথাসাহিত্যিক পিতা আবুল ফজলের মতো স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং নারী প্রগতির অন্যতম দিকপাল মা উমরতুল ফজল যার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নারী অধিকার ও সচেতনতা তৈরিতে যুগান্তকারী অবদান রাখার দাবিদার। এক অভিজাত পরিবারের সাংস্কৃতিক বলয় মেধা ও মনন বিকাশে যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে মমতাজ লতিফও সেই প্রবহমান ধারার প্রত্যক্ষ এবং সরাসরি অংশীদার। চট্টগ্রামে আবুল ফজলের ‘সাহিত্য নিকেতন’ ভবনটি সেই আমল থেকে জ্ঞানী-গুণীদের সদর্প বিচরণে মহিমান্বিত হয়েছে। সেই অমর কথাসাহিত্যিকের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যাসন্তান আলোচ্য গ্রন্থের লেখিকা। ‘যুদ্ধ ও আমি’ বইটি শুরুও করেছেন ঠিক এভাবে নিজের পরিচয়ের জবানিতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সর্ব বাঙালীর জীবনে যেমন রক্তের আলপনা এঁকে দেয় পাশাপাশি গৌরবান্বিত ইতিহাসকেই শুধু সমুজ্জ্বল করে না এক অদম্য সাহসিকতা এবং প্রবল প্রত্যয়ে নয় মাসের উদ্দীপ্ত মনোবলকে শাণিত করারও এক অবিচলিত শক্তি। গ্রন্থের রূপকার স্মৃতিবিজড়িত অগ্নিঝরা দিনের মাহাত্ম্য বর্ণনা করত গিয়ে আপন অনুভব আর মনোবলকে যেভাবে পাঠকের সামনে বিধৃত করেছেন সেখানে মনে হয় সবাইর কোন না কোনভাবে এই স্বাধীনতা অর্জনের দিনগুলোর অংশীদারিত্ব দাবি করা সঙ্গত। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া মমতাজ ’৬০-এর দশকের সমস্ত আন্দোলন আর স্বাধিকার অর্জনের একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের দুর্লভ অভিজ্ঞতারও সাক্ষাত শিষ্য। পারিবারিক বিশুদ্ধ আঙিনা যা কিনা একেবারেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া তা যে কোন মানুষকে কতখানি সমৃদ্ধ, আধুনিক এবং সময়োপযোগী করে তোলে সেটা বলাই বাহুল্য। সুস্থ রাজনৈতিক ধারা, ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক পরিম-ল তার চেয়েও বেশি দেশাত্মবোধের অনির্বাণ শিখা যদি পরিবার থেকেই প্রজ্বলিত হয় তার চেয়ে মঙ্গল জাতির জন্য অন্য কিছু হতে পারে না। তাই গ্রন্থাকারের ‘যুদ্ধ ও আমি’ বইটি পড়ার আনন্দই এক ভিন্নমাত্রার আবহ যা শুধু দেশ, জাতি কিংবা দুঃসময়ের ঘটনাগুলোর সঙ্গেই পরিচয় করায় না এক ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় আত্মপরিচয়ের ঐতিহ্যকেও সমুন্নত করে। পুরো বইতে স্বাধীনতা যুদ্ধ তার সঙ্গে সর্ব বাঙালীর সমর্পিত জীবন আর সম্পদকে যেভাবে একীভূত করা হয়েছে তাতে মনে হবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন ব্যতিরেকে আর কোন বৈভব তাকে প্রলুব্ধ করত পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি যখন তার হিংস্র থাবায় দেশটিকে ক্ষত-বিক্ষত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত সেই উপযুক্ত পর্বে এমন একটি মূল্যবান গ্রন্থ পাঠককে, নতুন প্রজন্মকে নবউদ্দীপনায় জাগিয়ে তুলবে এই আশা ব্যক্ত করাই যায়। বইটির শেষ করছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সফল অভিজ্ঞতার উপহার হিসেবে অভিষিক্ত করে। অভিনন্দন লেখককে বাঙালীদের একান্ত বৈভব মুক্তিযুদ্ধকে আবারও সময়ের পথিকদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য। মমতাজ লতিফের অন্য একটি বই ‘রবীন্দ্র আমি আর তুমি’ প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের ভাষার মাসে। আবুল মনসুরের প্রচ্ছদে গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্বে ছিল আগামী প্রকাশনী। উৎসর্গ পত্রে লেখিকার সশ্রদ্ধ নিবেদন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবীকে বরণমাল্যে অর্ঘ্য সমর্পণ করা। রবীন্দ্রভক্ত লেখক স্মৃতির মিনারে হাতড়ে বেড়ান কবে থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও তার একান্ত প্রেরণাদাত্রী নতুন বৌঠানকে অনুভব করেছিলেন। উদীয়মান কিশোরী কিংবা উদ্দীপ্ত তরুণীর হৃদয়ের নিভৃত আঙিনায় শুধু রবির কিরণই নয় প্রায়ই সমবয়সী কাদম্বরী দেবীর করুণ আখ্যানও তাকে অনুক্ষণ উদ্বেলিত করে যিনি চিরতরে বিদায় নিয়েও কবির সৃষ্টির জগতকে নিরন্তর বিকশিত করেছেন। এ কথা সবারই জানা মাত্র ২২ বছর বয়সে কাদম্বরী নিজেকে মৃত্যুর কোলে সমর্পিত করেছেন স্বইচ্ছায়, অন্তর্নিহিত তাড়নায়। এই নিয়ে বহু কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে যার শেষ আজ অবধি হয়নি। তবে এই কথা অনস্বীকার্য কবির জীবন ও সাহিত্যে কাদম্বরীর স্থান চিরকালেরই শুধু নয় অম্লান ঐশ্বর্যও বটে যাকে কোন সরলীকরণে আবদ্ধ করা যায় না। লেখক সেদিকে যানওনি। বরং নিজেকে কাদম্বরী আদলে কল্পনা করে কবির মুখোমুখি হয়েছেন। সত্যিই হৃদয়স্নাত এক অভিনব অনুভব যা আবার নতুন করে রাবিন্দ্রীক ভুবনে কাদম্বরীকে হাজির করে। ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মাকে হারানো কবির প্রথম মৃত্যুশোক নতুন বৌঠানের আত্মহননের মধ্যেই। সেই কথাও পুনরুচ্চারিত হয়েছে মমতাজ লতিফের বাক্যালাপে। অতি বাল্যকালে ঠাকুর বাড়ির বধূ হয়ে আসার পর থেকে কাদম্বরীর সঙ্গে রবির সখ্য, হৃদ্যতা হরেক রকম নান্দনিক শব্দ চয়নে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে কবির ‘উপহার’ কবিতাটিও তুলে দেয়া হয় যেখানে কাদম্বরীর নাম না থাকা সত্ত্বেও মনে করা হচ্ছে তা নতুন বৌঠানকে নিয়েই রচিত। ১৯১৮ সালে ৫৭ বছর বয়সে এলাহাবাদে কাদম্বরীর ছবি প্রত্যক্ষ করে যে গানটি ‘বলাকা’ কাব্যে অন্তর্ভুক্ত সেই তুমি কি কেবলই ছবির কথাটি উল্লেখ করতে গ্রন্থকার ভোলেননি। রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানকে নিয়ে অনেক স্মৃতিময় রচনা যা আজও পাঠক সমাজকে আন্দোলিত করে তাও লেখককে নতুন অনুভবে আপ্লুত করেছে। খেলার সাথী, কবির সৃষ্টিময় জগতের সর্বক্ষণিক প্রেরণাদাত্রী কাদম্বরীকে কবি কতভাবেই না হৃদয়ের অর্ঘ্যে পুষ্পিত করেছেন তাও ভিন্ন মাত্রায়, অন্য আঙ্গিকে মমতাজ লতিফের নির্মল আবেগ আর অনুভূতির অনুষঙ্গ হয়েছে। জীবনব্যাপী রবীন্দ্র সৃষ্টিতে নিমগ্ন হওয়া একজন নিবেদিত পাঠকের পক্ষেই সম্ভব কবির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে এভাবে শৈল্পিক শৈলীতে পূর্ণ করা। গ্রন্থটিও পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে। দুটো বইয়েরই বহুল প্রচার আশা করছি।
×