ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ অপেক্ষা কিছু রক্তের

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২০ জুলাই ২০১৮

গল্প ॥ অপেক্ষা কিছু রক্তের

সুকু মিয়া লেন ধরে আগাতে সামনে পড়ল বড়সড় একটা গলিমুখ। সেটা পেরিয়ে আরও দু’চারটে ছোট গলিতে ভুল করে চক্কর মারল। সবশেষে ডান দিকে গণেশের সেলুন আর রাজনের মুদি দোকান পার হয়ে সামনে মিলল লোকটার কাক্সিক্ষত রাস্তার দেখা। গলির শুরুতে বহু পুরনো দুটো বাড়ি। এলাকার লোকেরা কানাঘুষা করেÑ এগুলো নাকি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। হতেও পারে আবার নাও পারে, সালতামামির খোঁজ রাখার তো কেউ নেই। কালের সাক্ষী বাড়ি দুটোর ভগ্নদশা বসবাসরত লোকের চিন্তায় ছাপ ফেলে না। খসে পড়ে যাওয়া আস্তর, চুনকাম উঠে বেরিয়ে পড়া কঙ্কাল, এমনকি কার্নিশে গজানো গাছের ব্যাপারগুলো, খুব স্বাভাবিক। পোড়াবাড়ির মতো হয়ে ওঠা এই বসতিদুটোর শেষটায় থাকে রজব আলী। লোকটাকে খুব দরকার মুসার। মুসা মিয়াকে আজকাল লোকে নুলা মুসা বলে জানে। দুপুর সময়ে রজব আলীর বাড়িতে থাকার কথা না। এটা জেনে বুঝেই সময় ঠিক করা। তবুও নিশ্চিত হতে দরজায় কড়া নাড়া। প্রত্যাশামাফিক সাড়া না মেলায় সে হাসে। বন্ধ দরজাকে সুবিধা মতো খোলতাই করার তরিকা খুব ভাল জানা তার। হাত সাফাইয়ের খেলের ম্যাজিক হলো যেন, খট করে শব্দ শোনা গেল। দরজাটা খুলে যেতেই নাকে লাগল বোটকা গন্ধ। গাঢ় রঙের পর্দা টানা জানলায়, এত পুরু যে রোদের টিকির দেখাটিও মেলে না। ছোট্ট দু’কামরার ঘরটায় বাতাস ঢোকার কোন সুযোগ নেই। গুমট আর বদ্ধ ঘরটায় ভ্যাপসা ভাব। বিছানাপত্র থেকেও আঁশটে গন্ধ বের হচ্ছে। ভেতর থেকে দরজা ভিজিয়ে লোকটা তালা বন্ধ করে দিল। এরপর শুধুই অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষা। রুদ্ধ নীরবতায়। চাপা অন্ধকারে। অপেক্ষা কিছু রক্তের। অপেক্ষা আরেকটি খুনের। আর এ অপেক্ষা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তির নাম। হাবিলকে মারার জন্যে কাবিলের গুহায় লুকিয়ে থাকার মতই দীর্ঘ ও অসহ্য। খুটখাট শব্দ। দরজার তালা খুলছে কেউ একজন। মাথাটা একটু ঢোকাতেই নেমে এলো ত্বরিত আঘাত। ঠিক মাথার তালুতে। তেমন ভারি কিছু নয়, সাধারণ একটা খোন্তা। রান্নাঘর থেকেই নিয়েছে মুসা মিয়া। প্রথম আঘাতেই কুপোকাত। বেশ ক’বার আঘাতের পর জ্ঞান হারাল রজব আলী। পুরোটা সময় অদ্ভুত সাবধানতায় ছিল নুলা মুসা। সিঁড়িতে পদশব্দ শোনামাত্রই রক্তে ছিলকে উঠছিল উত্তেজনা। ধমক মেরে যাচ্ছিল পাশবিকতা। যে ঘরে একজন মাত্র বাসিন্দা একজন, সেখানে চাবি মেরেই খুটখাট শব্দে লোকে দরজা খোলে। ভেতরে সমস্যা ওত পেতে বসে আছে ছোবল মারার জন্য, এমন বিষম ধারণা কার মনে আসে; বাইরে থেকে যখন সব ঠিকঠাক? সাত রওজা রোডের তিনতলা বাড়িটার বদ্ধ খুপরিতে এই যে শেষবার রজব আলীর প্রবেশ, জানত শুধু মহাকাল। দীর্ঘ আট ঘণ্টা তেইশ মিনিটের অপেক্ষার অন্তিমে মোক্ষম সময় এলো। একটানা অপেক্ষায় মুসার শরীরে ঝিম ধরে যায়। কিন্তু তার মন ছিল পাথরের মতো ঋজু। স্থৈর্য নিয়ে বুকের গহীনে লুকানো বিষের চাষ করছিল। কম তো নয়, তিনটে বছর ধরে চাষ করা বিষ। আট ঘণ্টা তো আজকে, এই বখাটে জঞ্জালখানায় অপেক্ষা। এর আগে প্রায় তিন বছর ধরে চলেছে ইঁদুর বিড়ালে খেলা। রজব আলীকে দেখে নেবার পরীক্ষায়, আজ পাশ করবে নুলা মুসা। ধূর্ত মুসার চেয়ে রজব আলীও চালবাজিতে পিছিয়ে ছিল না। বারবার পিচ্ছিল বাইম মাছের মতো হাত ফসকে গেছে লোকটা। হিলি বন্দর থেকে রজব ওপারের দিনাজপুরে চলে গেল যেবার, অল্পের জন্য ধরতে পারেনি মুসা মিয়া। গত তিনমাসের নিখুঁত পরিকল্পনার কথা ভেবে মুসা নিজেই আনন্দে গদগদ হয়ে যায়। রজব আলীর মতো জাঁদরেল লোকের পিছে ভাড়াটে ছুঁচো লাগিয়ে রাখা, চাট্টিখানি কথা নয়। সাবধানী হরিণের মতো রজব আলী জায়গা বদলায় আর কেমন খোলস পাল্টায়। গত কয়েকমাস সরাসরি তাড়া না করে পিছে টিকটিকি লেলিয়ে দেয়া যে একটা মাস্টারপিস হয়েছে, সেটা বুঝতে পেরে সুখ সুখ অনুভূতি হয় মুসার। বিছানায় শুইয়ে হাত, পা আর মুখ বেঁধে নেয় মুসা। অজ্ঞান রজব আলী পাংশুমুখো, লোকটা দেখতেও বেঁটে খাটো। মুসার করুণার চোখ নেমে আসে শায়িত দেহে। চাউনিতে পরিমাণ মতো বিদ্বেষও লুকানো আছে। মানুষকে নগ্ন করা মানেই সমস্ত মুখোশ খুলে ফেলা। সমস্ত অহংকার, আভিজাত্য ধুলোয় উড়িয়ে দেয়া। ন্যাংটা রজব আলীর অসহায়ত্ত দেখে মুসা হাসে। ভাবে এই অবস্থায় দেখে কে বলবে একসময় পুরো উত্তরবঙ্গ দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই পাগলাচোদা শালা। মোরশেদ শিকদারের খাসচামচা ছিল যে লোক, তাকে মারার কথা ভাবা! কোথাকার কোন এক মুসা মিয়ার, এও কি সম্ভব! ‘সময় কেমন কইরা কামড় খেলে, কেউ কইবার পারে না। ওর হাতেই আমার মরণের কথা তিন বচ্ছর আগে আর আইজ ও মরতেছে আমারই হাতে। হা হা হা। আল্লাহ্ বইলা কেউ আছে তাহলে সত্যিই। নাইলে মোরশেদ শিকদারের ফাঁসি হয়?’ মুসা ভাবে আর হাসে। হাসতে হাসতে তার হেঁচকি উঠে যায়। হেঁচকির শব্দে আরও হাসি আসে। যেন যে সুখে পাগল হয়ে গেছে। সিগারেট ধরায় মুসা মিয়া। ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে যায়। আজ সে নুলা মুসা এই বাঞ্চোত রজব আলীর জন্যে। পা কেটে ফেলতে হয়েছে, না হয় মরতে হতো অকালে। কী শাস্তি দিয়ে মারা উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। তবে মারার আগে খেলা করা দরকার, এ নিয়ে মনে প্রশ্ন নেই। ভাবতে ভাবতেই আরেকটা সিগারেট ধরায়। সঙ্গে এক ছিলিম গাজা মিশিয়ে নেয়। ধোঁয়াটা ছাড়ে নগ্ন বন্দীর ঠিক মুখের উপরে। বেশ কয়েকবার। কাশি দিয়ে জেগে ওঠে রজব আলী। হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টার সঙ্গে বদ্ধ মুখের গোঙানি চলতে থাকে সমান তালে। এরমধ্যে শুরু নুলা মুসার অট্টহাসি, অপলাপÑ সালাম রজব সাব, ওঠেন ঘুম থেইকা ওঠেন। অহন আর লোহাগড়ায় গ্রামের বাড়িতে নাই। আপনের লাইগা কব্বরের আজাবের দিন আইজ। আরে আরে... চুপ করেন মেয়াভাই, উহুহু উহুম... কথা কওনের চেষ্টা কইরেন না, আইজ খালি শুনবেন। আপনের ছবক লওনের দিন এইটা। রজব সাব, জানেন নাকি মানুষের হাতের চামড়া সবচাইয়া পাতল। এই চামড়ায় যদি আগুনের ছ্যাঁক লাগে, এক্কেরে হগল শ্যাষ। মনডায় চায় হাতখান কাইটা ফালাই। আপনে কি জানেন এইটা? জানবার পারেন আবার নাও পারেন। আহেন আপনেরে এট্টু জানাইয়া দেই। এইসব বিষয়ে জ্ঞান থাকন ভালা... বলতে বলতেই ডানহাতটা চিৎ করে সিগারেট চেপে ধরল। একের পর এক দাগ পরতে শুরু করল আর শুরু হলো চাপা গোঙানি। কিচ্ছু করার নেই রজব আলীর। চেয়ে দেখছে হাত থেকে গোল গোল ধোঁয়া উঠছে আর দাগ বসে যাচ্ছে বাটিক প্রিন্টের মতো। আর শুনতে পাচ্ছে নুলা মুসার আক্রোশ ভরা কথাগুলোÑ শালা খানকির নাতি, তুই আমারে নুলা বানাইছস। মারতে চাইছিলি না? এখন দেখ কে কারে মারে। কে কারে বামন বানায় দেখ... কয়েক ঘণ্টা ধরে নানান রকম নির্যাতন চালিয়েছে মুসা মিয়া। জীবনীশক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে রজব আলীর। ইতিমধ্যে বাম পায়ের হাঁটুর চাকতিটা নিপুণ দক্ষতায় কেটে নেয় নুলা মুসা। মৃত্যুর আগে চিরশত্রুকেও নুলা বানাতে পিটিয়ে গুড়ো গুড়ো করে ওটাকে ভাঙে। রাত তিনটে বাজতে চললে মুসা মিয়া সিদ্ধান্ত নেয় রাস্তা মাপার। যাবার আগে আরও মজা করতে ইচ্ছে করছে। লোকটার মনে হয় খেলা হচ্ছে, আরও খেলা হবে। টয়লেটে এক বোতল হারপিক রাখা, ওটা ব্যবহারের সময় এসেছে এখন। কাটাকুটি করা পা, হাত আর শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢেলে দিল সমস্ত বোতল। রজব আলীর মনে হয় রক্তের ভেতরে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। গোঙানোর শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে। মৃত্যু তার অপেক্ষাকৃত সহজ। এত নির্যাতনের পর অবশিষ্ট ছিল না কিছু আর। বালিশ চাপায় শ্বাসরোধ, তুলনামূলক সহজ মুক্তি দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে। বদ্ধ ঘরে প্রায় আটদিন নিথর পড়ে রইল লাশটা। গন্ধ ছড়ানোর পর মহল্লাবাসীর অভিযোগে পুলিশ এসে তদন্তের আগ অব্দি।
×