ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস বাবর

ছোট-ছোট গল্পের কাফকা

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ২০ জুলাই ২০১৮

ছোট-ছোট গল্পের কাফকা

এ-বদ্বীপে পাঠকের ভাণ্ডারে তৃপ্তির অলঙ্কার হিসেবে যে ক’জন বৈদেশী লেখকের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় সেখানে নিশ্চিতভাবেই আমরা কাফকার নাম দেখে উঠি। তা অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিপত্তি, অর্থ-বৈভব, বইয়ের সংখ্যা, হেনতেন পুরস্কারের কারণে নয় একান্তই সৃজনের ওজনে! বিশ্বসাহিত্যে এমনকি ঘরের সাহিত্যেও আমরা এমনতর লেখকের দেখা পাই মাঝেমধ্যে। কাফকা সবচেয়ে বেশি আলোচিত ‘মেটামরফসিস’ এর কল্যাণে; তার বাগানে বিবিধ সুবাসিত ফুল অবশ্য আছেÑ সমালোচক ও পাঠক দ্বারা তা আলোচিত-সমালোচিতও। এখানকার তর্জমায় ও প্রতিবেশী দেশের তর্জমায় আমরা পড়ে কিংবা সরাসরি কাফকার চর্চিত ভাষায় পড়ে কেউবা অবাক হই, মাত্র একচল্লিশ বসন্ত পার করা লোকটি যদি জীবদ্দশায় ফিট শরীর পেতেন, তবে কেমন হতো? কোটি টাকার প্রশ্ন বটে, আসলে শিল্প-সাহিত্যে এমন হতাশা মানিয়ে যায় বেশ, একটু আক্ষেপ আর না-পাওয়ার বেদনা ছাড়া কেইবা বড় শিল্পী হতে পেরেছেন, কোন কালে? প্রায় একশো বছর আগে দেহত্যাগ করা কাফকাকে মনে রাখার মাজেজাই তো শিল্পের ভাবার্থ! আমরা অবশ্য ‘দি ট্রয়াল’, ‘দি কাসল’, ‘আমেরিকা’ কিংবা যে ‘মেটামরফসিস’-এ আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে চমক জাগানো লাইন দিয়ে শুরু প্রায়-উপন্যাস নিয়েও কথা বলবো না এখানে। তাহলে? সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সাহিত্য-আয়োজনের বিভিন্ন রচনা দেখলে যে বাস্তবতার চিত্র সম্মুখে আসে তার ভিত্তিতেই এগুনো যেতে পারে। তা কেমন? যুগ যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে কিংবা জীবন-জীবিকার তাগিদে সত্যিকার অর্থেই পাঠকের হাতে সময় তেমন নেই; সময়হীনতা ও নগরবৈচিত্রতার কারণেই হয়তো আমাদের সময়ের লেখকেরা ক্রমশ লেখাকে ছোট করে আনছেন। এই ছোট অবশ্য ভাবের ক্ষুদ্রতা নয়, আয়তনের, ফলে বিন্দুর ভেতর দিয়ে সিন্ধুর গভীরতার মুখোমুখোটি হওয়া দৈনন্দিন ঘটনা যেন। অনুগল্প কিংবা ছোট আয়তনের কবিতা পড়েও পাঠককুল তৃপ্তি পাচ্ছে বড়কিছু পড়ারÑ প্রায় একশ’ বছর আগে, কাফকাও কি বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বগ্রামের এ-ভাবনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন? ঊড়শিল্পী মাত্রই কাল সচেতন তো হনই, তাদের মানসদৃষ্টিতে প্রতিভাত হয় আগামীর দৃশ্যপট। কাফকাÑ আজকের দিনের অণুগল্পের সমান্তরালে বেশকিছু ‘ছোটগল্প’ লিখে আমাদের সময়হীনতায় সঙ্গ দেন যেনবা। প্রসঙ্গত বলা দরকার, এসব ‘ছোটগল্প’ কোনভাবেই ছোট’র তকমা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে না বাংলা তর্জমায় বরং পাঠকের হাহাকারের সঙ্গে, দীর্ঘশ্বাস আর ভাবনার সঙ্গে গলাগলি করে। কবীর চৌধুরী কাফকার সৃজন-দুনিয়া নিয়ে এমনটি বলেন, ‘কাফকার সাহিত্যকর্ম-বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা ও অর্থময়তায় সমৃদ্ধ। নানাস্তরে তাকে উপভোগ ও উপলব্ধি করা যায়। প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার তাঁর রচনাকে বৈশিষ্ট্য দান করছে। তাঁর রচনা থেকে প্রায়ই যে-জগতের ছবি উঠে আসে তা পারম্পর্যহীন চরম নৈরাজ্যের, ধোঁয়াটে ধুসরতার। সেখানে মানুষের পক্ষে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মানুষ শুধু সীমাহীন একাকীত্ব ও চরম শূন্যতার মধ্যে হাবুডুবু খায় যদিও তার মধ্যেও মাঝে মাঝে আশার চকিৎ আলো ঝলসে ওঠে।’ চৌধুরীর বক্তব্য থেকে আমরা শুধু ‘উপলব্ধি’ শব্দটি ধরেও এগুতে পারি কাফকার গল্পে। তাকে যত বেশি না পড়া দরকার তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন উপলব্ধি। উপলব্ধির স্তর উন্নত মননের না-হলে কাফকা পড়ে বদহজম হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে, যেমনি গ্রেগর সামসার আরশোলা হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। আসলেই, আমরা যতটা না উপরে সুস্থির দেখাই, ততোটা কি ভেতরেও? নিশ্চয়ই না যদি হয়, তবে একজন দায়িত্ববান মানুষ, যে কি না রাতে স্বাভাবিক আচরণ করেও সকালে আরশোলা হওয়াটা কি অস্বাভাবিক? পরিপার্শ্বের চাপ আর নানাবিধ তাপে আমরা আরশোলাইÑ ফারাক শুধু চিন্তায়, কাফকার মতো মহৎশিল্পীরা তা করতে পারেন অবলীলায়। এক্ষণে, মজার একটি গল্প মনে পড়ে গেল প্রিয় পাঠক, একদা, তারুণ্যমিশ্রিত চোখে গল্প লেখার বাতিক লেগে ছিল জোরেসোরে, ঠিক তখনই এক বন্ধুর মুখে শুনে উঠি, গল্পসাহিত্যের সবচেয়ে ছোটগল্পটি কেবল আড়াই লাইনের! এবং ও আড়াই লাইনে প্রোতিত আছে এক পিতার আহাজারি, জুতো বিক্রির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পিতৃত্বের বেদনা... হেমিংওয়ে রচিত সেই গল্প বিস্মরণ হবার নয় কিন্তু কাফকার ‘গাছ’ গল্প, যেটি কি না হেমিংওয়ের ছয় শব্দের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও গভীর রেখাপাত করা এক অত্যাশ্চর্য গল্প। গাছের সঙ্গে মানুষের জীবনের তুলনা কাব্যসাহিত্যে বেশ দেখা যায়, সাহিত্যের নানা মাধ্যমেও কিন্তু কাফকা ‘গাছ’ গল্পে বৃক্ষের সমান্তরালে মানুষেরও যে মায়া-প্রেম-মোহ আছে প্রবলভাবে তা মনে করিয়ে দেন গল্পকার। একটি গাছকে টোকা দিলেই উপড়ে যাবার সম্ভাবনা অনেকেই দেখেন কিন্তু বাস্তবতা তা নয়, মানুষও চায় নিজেকে উপড়ে নিতে বা দিতেÑ পারেন না নিজেরই নানা ভূমিকা ও সংশ্লের জন্যে, এটা আসলে পারা যায়ই না। কাফকার ‘ছোটগল্প’গুলো আয়তনে অসম্ভব ছোট অথচ ভাবনার বিস্তার প্রভুত। একজন পাঠককে নিমিষেই দ্বন্দ্বে ফেলে দেন কাফকা, তার বিপুল জীবনবীক্ষা ও দর্শনের কল্যাণে। ‘অবিবাহের বিড়ম্বনা’ গল্পটি পড়ে কাফকারই লেখা চিঠিপত্রের কথা মনে পড়ে যায় দারুণভাবে। কাফকা কম কথা বলা লোক, একেবারেই আত্মমুখী, সাহিত্য ছাড়া অন্যকিছুতে প্রবল অনীহা তার। এই অনীহাই কি কাফকাকে বিরত রাখত জাগতিক কোলাহল থেকে? বিয়েভাবনা থেকে দূরে থাকতে? একজন মানুষ একা থাকার প্ররোচনা তো তার নিজের মন থেকেই পান প্রথমতÑ কাফকা! শরীর তো কখনোই তার পক্ষে কথা বলতো না, ছিলেন নানা জটিল রোগে আক্রান্ত, অল্পবয়সে প্রয়াতÑ তার নিজের জীবনের ছায়াই পাঠক দেখতে পায় ‘অবিবাহের বিড়ম্বনা’ অণুগল্পটিতে। গল্পকার যেমন বলেন, ‘যখন অসুস্থ হয়ে পড়বেন, একা একাই শূন্য ঘরে অলসভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে এবং এইভাবে আপনার সপ্তাহ-ও পর সপ্তাহ কেটে যাবে। কেউ এলে তাঁকে সমানের দরজা থেকেই বিদায় জানাতে হবে। অন্য কারও স্ত্রীর পাশাপাশি আপনি একটি সিঁড়িও উঠতে পারবেন না বা আপনাকে নামতেও দেওয়া হবে না।’ গল্পটি আপাতদৃষ্টিতে সরল কিন্তু মানুষের নিঃশেষ হবার জন্যে একাকিত্বই দায়ী কিংবা যৌথযাপনের মতো মধুর কিছুই নেই এমন একটি বিষাদময় সমাপ্তিতে গল্পটি দাগ কেটে যায় পাঠকের মনে। কিংবা ‘রাত্রি’ গল্পের কথা কি আমরা ভুলে যাব? তারও আগে এক সমালোচকের বয়ান শোনা যাক, ‘কাফকার ভাষা প্রতীকী এবং বিষয়বস্তু আপাতভাবে অযৌক্তিক, অবাস্তব এবং ভিন্ন জগতের বলে মনে হলেও তা যুক্তি ও বাস্তবতার গভীর তল ছুঁয়ে, তুলে আনতে চেয়েছিল সমস্ত অন্যায়কে ধ্বংস করার তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো। এক অসীম মুক্ত জীবনই তাঁর প্রার্থিত ছিল।’ ‘রাত্রি’ গল্পে কি জীবনের ফারাক আর মানুষের স্তরবিন্যাস নিয়ে এজন্যই প্রশ্ন তোলেন কাফকা? আসলেই তো, মানুষ যদি প্রত্যেকে সমানই হয়, তবে এত ব্যবধান কেন? কেউবা শখ করে পোষা কুকুরকে খাওয়ায় বিলেতি খাবার আর কেউ অনাহারে পড়ে থাকে রাস্তার ধারে। কাফকা প্রশ্ন তোলেন গল্পে, তারই শিল্পের দুনিয়ায়, প্রত্যেক মানবিক শিল্পীই যেমন করেন তার সীমায়, তার শব্দে। ‘রাত্রি’ গল্পের একেবারে শেষে কাফকার প্রশ্নটি আজ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের দামী প্রশ্নÑ ‘অথচ কেন আপনার এই পাহারা? পাহারার জন্য তো আপনি নন? অন্য কেউ আছেন, অন্য কেউ।’ এই ‘অন্য কেউ’র জবাব আমাদের কাছে নেই, যেমনি নেই রক্তপিপাসু শাসকদের। ‘ছোটগল্প’ নামক অণুগল্পটি কাফকার দার্শনিক জিজ্ঞাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইঁদুরের বয়ানের মাধ্যমে, ইঁদুরের চিন্তা আর জীবনের মাধ্যমে কাফকা দেখান, ছোট সে যেই হোক না কেন তার জন্য বড় স্বপ্ন দেখতে নেই। শেষপর্যন্ত বিড়ালের ‘দিক পরিবর্তনের’ নসিহতের পরেই বিড়ালের খাদ্যে পরিণত হয় ইঁদুরটি। প্রিয় কাফকা, আপনার এই ভাবনা তো পৃথিবীর রক্তাক্ত অনুভূতি আর বেদনার মাধ্যমেই দেখতে পাই! এবং বাস্তুসংস্থানের তত্ত্ব পড়ানোর মাধ্যমে ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীরা জীবনের পাঠশালায় নামার আগেই শিখে নেয়, ছোটদের জন্ম বড়দের খাদ্য হবার জন্যেই! কাফকার গল্প নিয়ে, কথাসাহিত্য নিয়ে আলাপের শেষ নেই, বিশ্লেষণের রঙে তা ক্রমশই বহুবর্ণিল হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সময়হীনতার দায় যেহেতু কাফকা নিজেও বুঝে রচনা করছেন একগুচ্ছ ‘ছোটগল্প’ তাতেই আমাদের ভরসা! কাফকা শিল্পী হিসেবে যে সম্মান ও সমীহ আদায় করে নেন বাঙালী বা বিশ্বপাঠকের কাছ থেকে তার জন্যে প্রথমে শিল্পীকে এবং একজন ম্যাক্স ব্রডকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। ব্রড বন্ধুহীন কাফকার জীবনের প্রকৃত স্বজন এবং আশ্চর্য হতে হয়, কাফকাই ব্রডকে মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, যেন তার সমস্ত পা-ুলিপি পুুড়িয়ে ফেলেন! ভাবুন তো, ব্রড এমনটি করলে কেমন হতো? আসলে জীবন সবসময় আপনার চাহিদামতো চলে না, কাফকার গল্প ও জীবনের সৌন্দর্য মূলত এখানেই!
×